
রাষ্ট্র সংস্কারে মতামত নিতে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ করছে অন্তর্বর্তী সরকার। সরকার গঠিত জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের তত্ত্বাবধানে প্রথম ধাপে প্রায় দুই মাস ধরে ৩৩ দল ও জোটের সঙ্গে সংলাপ হয়েছে। এতে অনেক বিষয়ে ঐকমত্য ও আংশিক ঐকমত্য হলেও কমিশনের মৌলিক কিছু প্রস্তাব এবং গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক ইস্যুতে একমত হয়নি দলগুলো। সেসব বিষয়ে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে ঐকমত্য তৈরি করে আগামী মাসে জুলাই সনদ দিতে চায় সরকার।
আজ সোমবার বিকেল সাড়ে ৪টায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের উদ্বোধন করবেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সভাপতি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা, কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ এবং রাজনৈতিক দলগুলোর প্রতিনিধিদের মধ্যে কয়েকজনের বক্তব্যের মাধ্যমে শেষ হবে প্রথম দিনের সংলাপ পর্ব। এরপর মঙ্গলবার থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে বসবে কমিশন। দিনব্যাপী সংলাপের জন্য ২৮টি দল ও জোটকে ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। মঙ্গলবারের সংলাপ পর্ব শেষে ঈদের ছুটির পরে পরবর্তী সংলাপ হবে। দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের সব অধিবেশন ফরেন সার্ভিস একাডেমিতেই করার পরিকল্পনা রয়েছে।
গতকাল রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার আজ সংলাপের উদ্বোধন হওয়ার কথা জানিয়ে বলেন, ‘আমরা আশা করছি, দ্বিতীয় দফার আলোচনা খুব শিগগিরই শেষ হবে এবং তারপর জুলাই সনদ নিয়ে সুস্পষ্ট ঘোষণা দেওয়া হবে।’
জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ২০ মার্চ থেকে ১৯ মে পর্যন্ত ৩৩টি রাজনৈতিক দল ও জোটের সঙ্গে ৪৫টি অধিবেশনে সংলাপ করেছে। দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, বাংলাদেশ বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক পার্টি, ইউনাইটেড পিপলস ডেমোক্রেটিক পার্টি (ইউপিডিএফ) এবং গণতান্ত্রিক বাম ঐক্যকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি বলে সূত্রে জানা গেছে। এর মধ্যে ইউপিডিএফকে বাদ দেওয়া হয়েছে ‘বিতর্ক ওঠায়’।
ঐকমত্য কমিশন সূত্রে জানা গেছে, আমন্ত্রিত দলগুলোর মধ্যে বিএনপির প্রতিনিধিদলে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ইসমাইল জবিউল্লাহ, নির্বাহী কমিটির সদস্য রুহুল কুদ্দুস কাজল এবং জামায়াতে ইসলামীর প্রতিনিধিদলে নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের, সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল রফিকুল ইসলাম খান ও হামিদুর রহমান আজাদ এবং এনসিপির প্রতিনিধিদলে আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, সদস্যসচিব আখতার হোসেন ও যুগ্ম আহ্বায়ক সরোয়ার তুষার সংলাপে অংশ নিতে পারেন বলে জানা গেছে। এ ছাড়া এলডিপি, এবি পার্টি, নাগরিক ঐক্য, ১২ দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ এবং সিপিবির দুজন করে প্রতিনিধির অংশ নেওয়ার কথা রয়েছে। বাকি ১৯ দলের একজন করে প্রতিনিধির সংলাপে অংশ নেওয়ার কথা।
কমিশন থেকে বলা হয়েছে, বিষয়ভিত্তিক আলোচনা করে সুপারিশগুলো নিষ্পত্তি করার চেষ্টা করা হবে। ২৮টি দল ও জোটের একাধিক প্রতিনিধি একসঙ্গে সংলাপে থাকায় সুপারিশের নিষ্পত্তি হতে সময় লাগবে বলে মনে করেছেন তাঁরা। এ ক্ষেত্রে প্রথম চারটি সুপারিশ নিয়ে একাধিক দিন আলোচনা হতে পারে।
ঐকমত্য কমিশনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে তাদের এখনো গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক প্রশ্নে ঐকমত্য হয়নি। বিশেষ করে বিচার বিভাগ বিকেন্দ্রীকরণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নিয়োগ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি), প্রধানমন্ত্রী পদে থাকার সর্বোচ্চ মেয়াদ, একজন সংসদ সদস্যের ধারণ করা পদের সংখ্যা, রাষ্ট্রপতি নির্বাচন ও সংবিধান সংশোধনপ্রক্রিয়াসহ মৌলিক অনেক বিষয়ে এখনো দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা রয়েছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে মৌলিক প্রস্তাব ও গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক বিষয়ে আলোচনার জন্য দ্বিতীয় ধাপে কমপক্ষে ১৩ সুপারিশ নিয়ে সংলাপ হবে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনে সমন্বয়ের দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দার আজকের পত্রিকাকে বলেন, ‘দ্বিতীয় ধাপের সংলাপে নির্দিষ্টসংখ্যক সুপারিশ নিয়ে আলোচনা হবে এবং সেগুলো নিষ্পত্তি করার চেষ্টা হবে।’
আজকের সংলাপ প্রসঙ্গে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা বৈঠক ডেকেছেন। আমরা যাব। গেলেও আমরা আর কী বলব? আমরা তো আগেই সংস্কার কর্মসূচি দিয়ে রেখেছি। আমরা মনে করি, মিনিমাম (ন্যূনতম) সকল দল যেখানে একমত হবে, সেটাকে ঐকমত্য ঘোষণা করে নির্বাচনের দিকে যাওয়া উচিত।’
দ্বিতীয় ধাপের সংলাপের লক্ষ্যের বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ আজকের পত্রিকাকে বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এখনো যে মতপার্থক্য রয়েছে, তা কীভাবে আরও কমানো যায়, ঐকমত্য তৈরি করা যায় কি না, সেই চেষ্টা করব। আগে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হয়েছে, তা আরও স্পষ্ট করে তোলা, যাতে করে সনদে উল্লেখ করা যায়।’