
দেশে কোরবানি দিতে একসময় পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত ও মায়ানমারের ২২ থেকে ২৫ লাখ গরু আমদানি করতে হতো। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৪ সালে ভারত সরকার বাংলাদেশে গরু রপ্তানি নিষিদ্ধ করলে বিপাকে পড়তে হয়। তবে কয়েক বছরের মধ্যেই ঘুরে দাঁড়ায় বাংলাদেশ। তারই ধারবাহিকতায় এবারের কোরবানিতে চাহিদার অতিরিক্ত ২০ লাখ ৬৮ হাজার পশু উদ্বৃত্ত থাকবে।
ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার সেতু ডেইরি ফার্মের স্বত্বাধিকারী সাজ্জাদ হোসেন সেতু কোরবানির ঈদকে সামনে রেখে কয়েক মাস ধরে ১২টি গরু লালন-পালন করছেন। এর মধ্যে গত রোজার ঈদে ছয়টি গরু বেশ ভালো দামে বিক্রি করেন।
বাংলাদেশে গরু রপ্তানি ঠেকাতে ২০১৪ সালের এপ্রিলে ভারতের তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর নির্দেশের পর বৈধ পথে বাংলাদেশে ভারতীয় গরু আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। বাংলাদেশে গরু রপ্তানি বন্ধের আগে ২০১৩ সালে ভারত থেকে আমদানি করা হয়েছিল ২৩ লাখ। কিন্তু কয়েক বছরের মধ্যেই এই চাহিদা শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হয় দেশীয় খামারিদের উদ্যোগে। তবে অবৈধভাবে দেশের তিন-চারটি করিডর দিয়ে গরু প্রবেশের চেষ্টা করা হয়। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর দৃঢ় পদক্ষেপের কারণে সেটিও কমিয়ে আনা সম্ভব হয়েছে। চলতি ২০২৫ সালে কোরবানির জন্য আট লাখ ৮৭ হাজার ৫৪৪টি খামারে এক কোটি ২৪ লাখ ৪৭ হাজার ৩৩৭টি কোরবানির পশু প্রস্তুত রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহীতেই রয়েছে ৪৩ লাখ ৪৪ হাজার ৪৯টি, দ্বিতীয় অবস্থানে চট্টগ্রাম বিভাগে ১৯ লাখ ৭৪ হাজার ৭৪টি এবং খুলনা বিভাগে ১৪ লাখ ৩৪ হাজার ৫৮৭টি। রাজশাহী, চট্টগ্রাম ও খুলনা এই তিন বিভাগে মোট কোরবানির পশুর প্রায় ৭০ শতাংশ জোগান দেবে। এর মধ্যে ৩৫ শতাংশ আসবে শুধু রাজশাহী বিভাগের বিভিন্ন জেলা থেকে। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের (ডিএলএস) প্রাথমিক হিসাবে দেশে এবার ৬৭ হাজার কোটি টাকার কোরবানির পশু বিক্রি হবে। এর মধ্যে অনলাইনে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি পশু বিক্রির সম্ভাবনা রয়েছে। বাংলাদেশ কৃষি সাংবাদিক ফোরামের (বিএজেএফ) গবেষণা তথ্য বলছে, পশু বিক্রির পাশাপাশি এ সময়ে অর্থনীতির নানা সূচক আবর্তিত হয়। গ্রামীণ অর্থনীতি বিকশিত করা, কর্মসংস্থান সৃষ্টি ছাড়াও নারীর ক্ষমতায়নের অন্যতম মাধ্যম এখন কোরবানির পশু লালন-পালন।
কোরবানির ঈদকে ঘিরে পশু বিক্রির পাশাপাশি জড়িত আছে মসলা, পশুখাদ্য বা ফিড মিল, লবণ, পরিচর্যায় নিয়োজিত শ্রম, ওষুধ ও ব্যবস্থাপনা, পরিবহন ছাড়াও চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য উৎপাদন, ডিউরেবল পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, ভ্রমণ ও বিনোদন খাত। এর পাশাপাশি কোরবানিকে ঘিরে এ সময় ইলেকট্রনিক পণ্যের বড় বাণিজ্য হয়। কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ, বিক্রয় ও ব্যবহার উপলক্ষে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষের কর্ম সৃষ্টি হয়। কোরবানির সময় বিভিন্ন পশুর ৯০ থেকে এক কোটি চামড়া সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে মোট চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ সরবরাহ করা হয় কোরবানির ঈদে। সব মিলিয়ে এবারের কোরবানির অর্থনীতি ছাড়াতে পারে এক লাখ কোটি টাকা।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা ফরিদা আখতার কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘দেশীয় পশুতেই এবারের কোরবানি করা সম্ভব হবে। ঘুরে দাঁড়িয়েছে স্থানীয় খামারিরা। স্থানীয় পর্যায়ে পশু উৎপাদন বেড়েছে। যার কারণে পশু আমদানি প্রায় শূন্যের কোটায় নেমে এসেছে। অবৈধভাবে পশু অনুপ্রবেশে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করা হয়েছে। দেশের কোরবানির পশু নিরাপদ রাখতে মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা নেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া পশুর হাটে পশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে। সব মিলিয়ে এবারের কোরবানির অর্থনীতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়াবে।’ কৃষি অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএলআরআই) সাবেক মহাপরিচালক ড. জাহাঙ্গীর আলম খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘সরকারের ধারণা করা চাহিদার চেয়ে প্রকৃত চাহিদা বেশি হতে পারে। ইফেকটিভ চাহিদা বাড়াতে পশুর দাম আরো সহনীয় করতে হবে। পশু লালন-পালন ও ব্যবস্থাপনা খরচ বেশি হওয়ার কারণে মাংসের দাম কমানো যাচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে পশু খাদ্যের দাম কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে। কম সময়ে বা কম খাবারে গরুর মাংস ও দুধ উৎপাদন ক্ষমতা যাতে বৃদ্ধি করা যায়, সে লক্ষ্যে পশু প্রজননের উন্নত সিমেন (বীজ) ব্যবহার করতে হবে। বেসরকারি খাতকে সঠিকভাবে কাজে লাগাতে হবে। খামারিদের উৎপাদন খরচ কমাতে আর্থিক প্রণোদনার বিষয়ে ভাবতে হবে।’
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (চলতি দায়িত্ব) ডা. মো. বয়জার রহমান বলেন, ‘পশু লালন-পালনের স্বনির্ভরতার পেছনে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন, বিশেষ করে গরু মোটাতাজাকরণ, কৃত্রিম প্রজনন ও মানসম্পন্ন ব্রিডের সম্প্রসারণ, খামারিদের সহায়তা প্রদানে সরকারের নানামুখী উদ্যোগ ও বেসরকারি খাতের ভূমিকা রয়েছে। দেশের মানুষের যে হারে মাংসের চাহিদা বাড়ছে, তাতে কৃত্রিম প্রজননকে আরো বেগবান করতে হবে। কিন্তু আমরা চাই দেশীয় পশুর জাত সংরক্ষণ করতে। এ ছাড়া গরু মোটাতাজা করতে এন্টিবায়োটিক ও স্টেরয়েডজাতীয় পাম ট্যাবলেট ব্যবহার বন্ধে কঠোর অবস্থান নেওয়া হচ্ছে। দেশের সব পশুর হাট মনিটর করা হচ্ছে। বাজারে কোনো ধরনের অসুস্থ পশু যাতে আসতে না পারে, তার জন্য উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। কোরবানির পশুর স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বাজারগুলোয় পর্যাপ্ত সুরক্ষাব্যবস্থা রাখা হবে।