Image description

পাবনার ঈশ্বরদীতে রূপপুর পরমাণু বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প দেশের সবচেয়ে স্পর্শকাতর ও ব্যয়বহুল কর্মযজ্ঞ। সেখানে প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছেন বিদায়ী প্রকল্প পরিচালক ড. জাহেদুল হাছান।

একই সঙ্গে তিনি বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পরিচালনা ও রক্ষণাবেক্ষণের জন্য গঠিত নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্ট কোম্পানি বাংলাদেশ লিমিটেডের (এনপিসিবিএল) শীর্ষপদও দখল করেছিলেন। তার বিরুদ্ধে অনিয়ম-দুর্নীতির পাহাড়সম অভিযোগ ও বিভিন্ন বিতর্ক সত্ত্বেও তাকে এ কোম্পানির অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) নিয়োগ দেওয়া হয়েছে বলে গতকাল বুধবার জানা গেছে।

জানা গেছে, শুধু প্রকল্প পরিচালক ও কোম্পানির এমডির পদই নয়, ড. জাহেদুল স্টেশন ডিরেক্টর, মানবসম্পদ, অর্থ ও প্রশাসন বিভাগের প্রধানের পদ কুক্ষিগত করে রেখেছেন। তার অদূরদর্শী পরিচালনা ও চরম অব্যবস্থাপনায় প্রকল্পটি বর্তমানে নানা সংকটে নিমজ্জিত। ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনার সরকারের সময় প্রকল্প পরিচালক পদে নিয়োগ পাওয়া ড. জাহেদুল এমডি পদে স্থায়ী নিয়োগ পেতে তৎপরতা চালাচ্ছেন।

কর্মকর্তাদের অভিযোগ, ড. জাহেদুল প্রতিষ্ঠানটির বিদ্যমান সংকটগুলো সমাধান না করে কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মিথ্যা আশ্বাস প্রদান, অযথা কারণ দর্শানোর নোটিস প্রদান, সিন্ডিকেট তৈরির মাধ্যমে প্রাতিষ্ঠানিক ফ্যাসিবাদ কায়েম এবং অব্যাহত অপেশাদার আচরণে স্বাভাবিক, সুষ্ঠু কর্মপরিবেশ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হচ্ছে। এতে এনপিসিবিএলের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম চরমভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক হতাশা ও অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

গত ২৫ মে রূপপুর প্রকল্পের পরিচালক (পিডি) পদ পরমাণু শক্তি কমিশনের মানবসম্পদ বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. কবীর হোসেনকে নিয়োগ দেয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়। আর গতকাল ড. জাহেদুলকে এনপিসিবিএলের অন্তর্বর্তীকালীন এমডির দায়িত্ব দেওয়া হয়।

এনপিসিবিএল ২০১৫ সালে গঠিত হয়। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে ড. জাহেদুল একযোগে কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক, স্টেশন ডিরেক্টর, মানবসম্পদ, অর্থ ও প্রশাসন বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন। কর্মকর্তারা বলছেন, এর কারণে প্রাতিষ্ঠানিক ভারসাম্য নষ্ট হয়েছে এবং প্রকল্প পরিচালনায় স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি অনুপস্থিত।

সম্প্রতি প্রকাশিত এক অডিট রিপোর্টে দেখা গেছে, প্রকল্পের বিভিন্ন যন্ত্রপাতির পরিদর্শনের জন্য রাশিয়া সফরের ক্ষেত্রে প্রকল্প পরিচালক অনুমোদনহীনভাবে প্রায় দুই কোটি ৮০ লাখ টাকা উত্তোলন করেছেন। যদিও রাশিয়ার তিনটি অঞ্চলে প্রকল্প কর্মকর্তাদের জন্য নির্ধারিত আবাসন সুবিধা রয়েছে, তিনি সেখানে না থেকে হোটেল ভাড়া দেখিয়ে এই অর্থ উত্তোলন করেন। শুধু তাই নয়, ব্যক্তিগত বাসা ভাড়ার নামে রাশিয়া সফরে আরো প্রায় ৭৭ লাখ টাকা আত্মসাৎ করেছেন।

২০১৮ থেকে ২০২৪ সালের মধ্যে ড. জাহেদুল রাশিয়া সফর করেছেন ৬২ বার। প্রকল্পের কর্মকর্তারা অভিযোগ করেছেন, এসব সফরে যন্ত্রপাতি সঠিকভাবে পরীক্ষা না করে অনুমোদন দিয়েছেন তিনি। এমনকি যোগ্যতার বিবেচনা ছাড়াই পছন্দের ব্যক্তিদের রাশিয়ায় পরিদর্শনে পাঠানোর অভিযোগও উঠেছে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল প্রকল্পের বাইরেও বাড়তি প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে, যার মধ্যে রয়েছে বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ প্রকল্প, বিটিসিএলের সঙ্গে যৌথভাবে এইআরএমএস, এলডব্লিউএস ও ডব্লিউএমএস পদ্ধতি স্থাপন ইত্যাদি। অথচ এসব ব্যবস্থা মূল রুশ চুক্তির মধ্যেই থাকার কথা ছিল। চুক্তির সময় প্রধান আলোচক ছিলেন ড. জাহেদুল। অনেকে মনে করছেন, তার অদক্ষতা ও অদূরদর্শিতার কারণে প্রকল্প ব্যয় অপ্রয়োজনে বাড়ছে।

প্রকল্পটি ২০২৪ সালে চালু হওয়ার কথা থাকলেও এখনো তা সম্ভব হয়নি। সরকারি উচ্চপর্যায়ের পরিদর্শনের পরও প্রকল্প পরিচালক প্রকৃত সময়সীমা জানাতে পারেননি। পিজিসিবির পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, তারা এ বছর থেকেই বিদ্যুৎ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত। কিন্তু প্রকল্প কর্তৃপক্ষ এখনো বাণিজ্যিক উৎপাদনের দিনক্ষণ জানাতে পারেনি।

গত ৬ মে প্রকল্প নিয়ে মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলন করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। তারা অভিযোগ করেন, শৃঙ্খলার প্রশ্ন না থাকলেও তাদের ওপর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। ৮ মে সকালে বিনা নোটিসে ১৮ কর্মকর্তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। পরে আরো ১১ জনকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। অব্যাহতিপত্রে শুধু লেখা হয়Ñ ‘আপনার সার্ভিসের আর প্রয়োজন নেই।’ অথচ তাদের প্রশিক্ষণে প্রতিজনের পেছনে সরকারের ব্যয় হয়েছে কোটি টাকার বেশি।

বহিষ্কৃত কর্মকর্তারা বলেন, তারা প্রকল্পে নিজেরা কাজ করতে চেয়েছিলেন, চেয়েছিলেন মানবিক পরিবেশ, যেমন—পর্যাপ্ত বসার জায়গা, চিকিৎসা ভাতা, ক্যান্টিন সুবিধা, অপারেশন স্পেয়ার পার্টস ও ওয়্যারহাউস সুবিধা। এর প্রতিক্রিয়ায়ই তাদের বরখাস্ত করা হয়।

এ ঘটনার প্রতিবাদে ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) ও ইনস্টিটিউশন অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স (আইডিইবি) বিবৃতি দিয়ে বলে, কোনো কারণ ছাড়া প্রকৌশলীদের বরখাস্ত মৌলিক অধিকার লঙ্ঘনের শামিল এবং প্রকল্প পরিচালনার স্বচ্ছতা বিঘ্নিত করছে।

এদিকে প্রকল্প কর্মকর্তাদের অভিযোগ, নিরাপত্তা বাহিনীর একটি দল ব্যক্তিগত সোশ্যাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট জোর করে চেক করছে। কেউ অস্বীকৃতি জানালে ডিউটি থেকে সরিয়ে দেওয়ার হুমকি দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এটি গোপনীয়তা ও মানবাধিকারের পরিপন্থী।

প্রকল্পের পরিবেশ আরো উত্তপ্ত হয়ে ওঠে যখন অভিযোগ ওঠে, ১৫ মে ঈশ্বরদীতে স্থানীয় কিছু লোকজন দিয়ে প্রকল্প কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মানববন্ধনের আয়োজন করেন ড. জাহেদুল। এতে দাবি করা হয়, প্রকল্প বন্ধের ষড়যন্ত্র চলছে। কর্মকর্তারা বলেন, প্রকৃতপক্ষে ওই কর্মসূচি ছিল প্রকল্পের তৎকালীন পরিচালকের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগ আড়াল করার কৌশল।

অভিযোগ রয়েছে, ড. জাহেদুল ধর্মীয় ছুটির বিষয়েও বৈষম্য করেন। ওমরাহ বা হজ পালনের অনুমতি বা হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থযাত্রায় অনাপত্তিপত্র দিতে অনিচ্ছুক তিনি। প্রতিষ্ঠানে উচ্চপদে আবেদন করতেও বাধা দেওয়া হয়, যা মানবাধিকারের লঙ্ঘন।

বিগত শেখ হাসিনা সরকারের সময় ২০২৪ সালের ৩১ জুলাই একটি অফিস আদেশে কর্মীদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সরকারবিরোধী কোনো পোস্ট, শেয়ার বা মন্তব্য না করতে বলা হয়। পরে কোনো সংবাদমাধ্যম বা সোশ্যাল মিডিয়ায় বক্তব্য দেওয়া থেকেও বিরত থাকতে বলা হয়, যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতার পরিপন্থী।

প্রকল্পসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশ বলছে, প্রকল্প পরিচালক থাকাকালে ড. জাহেদুলের একনায়কতান্ত্রিক আচরণ, স্বজনপ্রীতি, দায়িত্বে অবহেলা এবং দুর্নীতির অভিযোগগুলো এখন আর অজানা কিছু নয়। প্রকল্প ও দেশের স্বার্থেই তার অপসারণ জরুরি।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে ড. জাহেদুলের মোবাইল ফোনে কল দিলে তিনি মিটিংয়ে আছেন বলে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন। পরে আবারও কল দিলে তিনি বলেন, আপনার সঙ্গে সাক্ষাতে কথা বলব।

ড. জাহেদুলের এমডি নিয়োগ অবৈধ

গত ২৬ মে ২২৩তম বোর্ডসভায় ড. জাহেদুলকে এনপিসিবিএলের অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। গতকাল এ সংক্রান্ত একটি বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ হয়েছে।

ড. জাহেদুলকে অন্তর্বর্তীকালীন এমডি নিয়োগ করায় কোম্পানি আইন অমান্য করা হয়েছে বলে অভিযোগ করেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। কোম্পানি আইন-২০১৫-এর ৯(৪) অনুযায়ী রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের (১ম পর্যায়) প্রথম প্রকল্প পরিচালক কোম্পানির প্রথম ব্যবস্থাপনা পরিচালক হতে পারবেন।

কিন্তু প্রথম পর্যায়ের কাজ শেষ হয়েছিল ২০১৭ সালের ১ ডিসেম্বর। সম্প্রতি এক অডিট রিপোর্টে উঠে এসেছে, সার্কুলার অনুযায়ী কোম্পানির পরবর্তী ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ না হওয়ায় এমডির কর্মকাল আইনগত বৈধতা হারিয়েছে।

কোম্পানি আইন অনুযায়ী এখনো কোনো ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগ হয়নি। ড. জাহেদুলের বিগত সময়ে ওই পদে থাকাও আইনগত অবৈধ।