Image description

সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ-২০২৫ বাতিল দাবি করছেন সব মত ও পথের সরকারি কর্মচারীরা। তাদের দাবি, আইনটি নিবর্তনমূলক ও সংবিধান পরিপন্থী। কর্তৃপক্ষ চাইলে এটির অপব্যবহার করতে পারবে।

আইনের খসড়া তৈরির সঙ্গে যুক্ত সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মতে, এটি কোনো নতুন আইন নয়। প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চাকরিতে শৃঙ্খলা বিধান, দায়বদ্ধতা ও পেশাদারিত্ব রক্ষা এবং সেবা নিশ্চিতে ১৯৭৯ সালে এ আইনটি করা হয়েছিল। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ২০১৮ সালের রাতের ভোটের কদিন আগে তড়িঘড়ি করে আইনটি সংশোধন করে।

এর মাধ্যমে মূলত রাতের ভোটের কারিগরদের দায়মুক্তির বিধান করা হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মধ্যে চেইন অব কমান্ড এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে আইনটি সংশোধন করা হয়েছে। আইনটি অপব্যবহারের কোনো সুযোগ নেই। সব পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীর পাশাপাশি দেশের সেবাপ্রার্থী নাগরিকরা এতে উপকৃত হবেন।

প্রজাতন্ত্রের কর্মচারীদের মধ্যে শৃঙ্খলা বজায় রাখা, দলীয় লেজুড়বৃত্তি পরিহার ও সেবার মানসিকতা তৈরির জন্য একটি কঠোর আইনের প্রয়োজন রয়েছে। তবে সাম্প্রতিক জারি করা অধ্যাদেশটিতে কিছু অসংগতি রয়েছে। অধ্যাদেশটি জারির আগে আইন বিশেষজ্ঞসহ স্টেকহোল্ডারদের (অংশীজন) মতামত গ্রহণ ও আইন মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে ভালোভাবে ভেটিং করা উচিত ছিল। অধ্যাদেশের কিছু পরিভাষা সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলেও মনে করছেন তারা।

অধ্যাদেশে যা আছে

‘সরকারি চাকরি আইন, ২০১৮-এর অধিকতর সংশোধন করে ‘সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ, ২০২৫ নামে গত রোববার রাষ্ট্রপতির আদেশে আইন মন্ত্রণালয় এই অধ্যাদেশ জারি করে। অধ্যাদেশের খসড়াটি ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদে অনুমোদন দেওয়া হয়।

অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, ‘সরকারি কর্মচারী যদি এমন কোনো কাজে লিপ্ত হন, যা অনানুগত্যের শামিল বা যা অন্য যে কোনো সরকারি কর্মচারীর মধ্যে অনানুগত্য সৃষ্টি করে বা শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধার সৃষ্টি করে; অন্যান্য কর্মচারীর সঙ্গে সমবেতভাবে বা এককভাবে ছুটি ছাড়া বা কোনো যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া নিজ কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকেন বা বিরত থাকেন বা কর্তব্য সম্পাদনে ব্যর্থ হন;

অন্য যে কোনো কর্মচারীকে তার কর্ম থেকে অনুপস্থিত থাকতে বা বিরত থাকতে বা তার কর্তব্য পালন না করার জন্য উসকানি দেন বা প্ররোচিত করেন; এবং যে কোনো সরকারি কর্মচারীকে তার কর্মে উপস্থিত হতে বা কর্তব্য সম্পাদনে বাধাগ্রস্ত করেন, তাহলে তিনি অসদাচরণের দায়ে দণ্ডিত হবেন।’

অধ্যাদেশে আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ

অভিযুক্ত কর্মচারীদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযোগ দিয়ে অধ্যাদেশে আরো বলা হয়, অভিযোগ গঠনের সাত দিনের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হবে। আর অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হলে তাকে কেন দণ্ড আরোপ করা হবে না, সে বিষয়ে আরো সাত কর্মদিবসের মধ্যে কারণ দর্শানোর নোটিস দেওয়া হবে।

তার ভিত্তিতে দণ্ড আরোপ করা যাবে। এভাবে দণ্ড আরোপ করা হলে দোষী কর্মচারী ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে সেই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করতে পারবেন। তবে রাষ্ট্রপতির দেওয়া আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা যাবে না। যদিও আদেশ পুনর্বিবেচনার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারবেন।

রাতের ভোটের আমলাদের দায়মুক্তি দিতে ২০১৮ সালের আইন

‘রাতের ভোট’ হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা হয়। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ওই নির্বাচনটি দিনের বেলায় হওয়ার কথা থাকলেও হয়েছে রাতে।

আর ওই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সরকারের নিয়ামক শক্তি হিসেবে কাজ করেছেন ডিসি, এসপি, বিভাগীয় কমিশনারসহ দায়িত্বে থাকা সরকারি কর্মকর্তারা। সরকারি কর্মকর্তাদের দায়মুক্তি দেওয়ার জন্য ওই সময় আইনটি করা হয় বলেও অভিমত তাদের।

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মো. ফিরোজ মিয়া জানান, ২০১৮ সালে আইনটি করা হয় দুর্নীতিকে প্রশ্রয় দিয়ে। লক্ষ্যই ছিল সরকারি কর্মকর্তাদের রাজনৈতিকভাবে অপব্যবহার করার হীন উদ্দেশ্য। ওই আইনের কয়েকটি ধারা উল্লেখ করে ফিরোজ মিয়া বলেন, ২০১৮ সালের রাতের ভোটের আগে আইনটি করা হয়। এতে ১৯৭৯ সালের আইনটি রহিত করা হয়।

আইনে বলা হয়েছে, কোনো সরকারি কর্মকর্তা দুর্নীতির দায়ে এক বছরের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলেও তার চাকরি যাবে না। জেল খাটার পর তিনি আবার চাকরিতে বহাল হবেন।

ওই আইনটিকে দুর্নীতিসহায়ক উল্লেখ করে তিনি বলেন, কোনো কর্মকর্তা এক হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি করার পর টাকা ফেরত দিলে চাকরিতে বহাল থাকবেন। পরবর্তীতে তিনি আবারও দুই হাজার কোটি টাকা লুটপাট করতে পারবেন। কোনো সভ্য দেশ এমন আইন করতে পারে না বলেও জানান সাবেক এই আমলা।

নতুন অধ্যাদেশ বাতিলে একজোট, উচ্ছৃঙ্খলতা

২০১৮ সালের আইনটি সংশোধন করে বিতর্কিত ধারাগুলো বাদ দিয়ে ‘সরকারি চাকরি অধ্যাদেশ, ২০২৫ জারি করা হয় গত রোববার রাতে। শনিবার থেকে সচিবালয়ে এ অধ্যাদেশের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ শুরু করেন বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। অধ্যাদেশটি বাতিলের দাবি জানিয়ে সচিবালয়ে প্রথম দিকে বিএনপি ও জামায়াত অনুসারী কর্মচারী হিসেবে পরিচিত কর্মচারীরা আন্দোলন শুরু করেন।

প্রথম দুদিনে সীমিতসংখ্যক কর্মচারী অংশ নেন। নিয়মতান্ত্রিকভাবে দুদিন সমাবেশ করে নিজ নিজ মন্ত্রণালয়ের সচিবদের কাছে দাবিদাওয়া তুলে ধরেন তারা। আন্দোলনের তৃতীয় দিনে (সোমবার) বিভিন্ন মন্ত্রণালয় থেকে কর্মচারীরা মিছিল নিয়ে ব্যাপকভাবে অংশ নিতে থাকেন। এক পর্যায়ে তারা জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের জন্য নির্মিত নতুন ভবনের নিচে জড়ো হয়ে সরকারবিরোধী উসকানিমূলক স্লোগানও দেন।

কর্মচারীরা জানান, সোমবার দুপুরের পর সচিবালয়ে কর্মচারীদের আন্দোলন বিএনপি ও জামায়াত অনুসারী হিসেবে পরিচিত কর্মচারীদের হাতে ছিল না। বিগত সরকারের সুবিধাভোগী হিসেবে চিহ্নিত ও আওয়ামীপন্থী হিসেবে পরিচিত কর্মচারীরা মিছিলে অংশ নিয়ে উচ্ছৃঙ্খল আচরণ করেন।

দুপুরের পর কর্মচারীরা সচিবালয়ের বিদ্যুৎ ও পানির লাইনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেন। এক পর্যায়ে তারা সবগুলো গেট বন্ধ করে দিয়ে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও উপদেষ্টাদের জিম্মি করে দাবি আদায়ের চেষ্টা করেন। কয়েকজন উপদেষ্টা সচিবালয়ে প্রবেশ করতে না পেরে বাসায় ফিরে যান।

জনস্বার্থে নয়, গোষ্ঠীস্বার্থে এ আন্দোলন

ব্যক্তি ও গোষ্ঠীস্বার্থে কর্মচারীদের কেউ কেউ আন্দোলনে যুক্ত হয়েছেন উল্লেখ করে জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মো. ফিরোজ মিয়া বলেন, গত কয়েক মাস ধরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে যখন-তখন আন্দোলনে নেমে পড়ছেন। এসব আন্দোলন জনগণ কিংবা রাষ্ট্রের স্বার্থে হচ্ছে না। এগুলো ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত আন্দোলন। আন্তঃক্যাডার দ্বন্দ্ব ও প্রশাসনে এমন বিশৃঙ্খলায় মানুষ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ফিরোজ মিয়া বলেন, প্রশাসনে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে একটি কার্যকর ও যুগোপযোগী আইনের প্রয়োজন। তবে যে অধ্যাদেশটি করা হয়েছে, সেটাতে বেশকিছু অস্পষ্টতা রয়েছে। অস্পষ্ট ধারাগুলো পরিষ্কার হওয়া উচিত। আইনটিকে সংবিধানের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করারও পরামর্শ দেন তিনি।

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের শৃঙ্খলা বিধানে একটি কঠোর আইন প্রয়োজন রয়েছে। এটি যেমন কর্মচারীদের জন্য প্রয়োজন, তেমনি দেশের নাগরিকদের জন্যও প্রয়োজন। কারণ, সরকারি চাকরিজীবীদের বিষয়ে দেশের মানুষের ধারণা খুব সুখকর নয়। এখান থেকে তাদের বেরিয়ে আসা জরুরি। তাছাড়া ২০১৮ সালের আইনটিতে সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতি ও অব্যবস্থাপনায় জড়িয়ে পড়তে আরো উসকে দিয়েছিল। ওই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসাটা জরুরি ছিল। অন্তর্বর্তী সরকার সে জায়গাটিতে হাত দিয়েছে। এমন একটি অধ্যাদেশ অবশ্যই প্রয়োজন, তবে প্রক্রিয়া ও প্রয়োগের বিষয়ে কোনো প্রশ্ন থাকলে সেগুলো বিবেচনায় নেওয়াও উচিত বলে মনে করেন খ্যাতিমান এ লেখক।