Image description

মঙ্গলবার সকাল সাড়ে ৯টা। মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী মো. মাহমুদুল ইসলাম (৫৫) ২২ লাখ টাকা নিয়ে বাসা থেকে বের হন। তার গন্তব্য ছিল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান মিরপুর-১০ নম্বর। কিন্তু সকাল ১০টার দিকে তিনি স্টেডিয়ামের সুইমিংপুল ও ফায়ার সার্ভিসের মাঝামাঝি আব্দুল বাতেন সড়কে পৌঁছালে রাস্তায় দুই মোটরসাইকেলে করে আসা ছয়জন লোক তার পথরোধ করে। তারপর প্রকাশ্য গুলি করে তার কাছে থাকা ২২ লাখ টাকা ছিনিয়ে নিয়ে যায়। আহত ওই ব্যবসায়ী শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছেন। দিবালোকে ব্যস্ত সড়কে অনেক মানুষের সামনে থেকে টাকা নিয়ে তারা পালিয়ে যায়। এ ঘটনায় এখনো পুলিশ কাউকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে কাজ করছেন পুলিশ ও গোয়েন্দারা। এর দু’দিন আগে রোববার মধ্য বাড্ডার গুদারাঘাট এলাকায় সন্ত্রাসীদের প্রকাশ্য এলোপাতাড়ি গুলিতে নিহত হন গুলশান থানা বিএনপি’র যুগ্ম সম্পাদক কামরুল আহসান সাধন। ওইদিন রাতে সাধন গুদারাঘাট ৪নং রোডের সাবেক কমিশনার কাইয়ুমের কার্যালয়ের বিপরীতে চায়ের দোকানে বসে চা খাচ্ছিলেন। সেখানে বিএনপি নেতা কাইয়ুমের ভাগিনা কামরুল ও আরও কয়েকজনও ছিলেন। এর মাঝে হঠাৎ দু’জন এসে এলোপাতাড়ি শুট করে। দু’জনই মাস্ক পরা ছিলেন। গুলিতে সাধন ঘটনাস্থলেই পড়ে যান। এরপর ফাঁকা গুলি করতে করতে পালিয়ে যান সন্ত্রাসীরা। 

শুধু মিরপুরে প্রকাশ্য গুলি করে টাকা ছিনতাই আর বাড্ডায় প্রকাশ্য গুলি করে বিএনপি নেতাকে হত্যা নয়। বেশ কিছুদিন ধরে ঢাকার অপরাধ প্রবণতা যেন আচমকাই বেড়ে গেছে। ঢাকার রাজপথ থেকে শুরু করে অলিগলি, আর মহাসড়ক থেকে শুরু করে পুরো দেশেই যেন লাগামছাড়া অপরাধীরা। ঘণ্টায় মিনিটে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড ঘটার খবর আসছে। বিশেষকরে প্রকাশ্য কোপানোর ভিডিও গেল কিছুদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাসছে। এসব ভিডিও দেখে অনেকেই নিতান্ত প্রয়োজন ছাড়া যেমন বাইরে বের হচ্ছেন না ঠিক তেমনি এসব ভিডিওতে চাপাতি দিয়ে আক্রমণের চিত্র দেখে অনেকে আতঙ্ক বোধ করছেন। 

অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধীরা লাগামছাড়া। অপরাধ ও অপরাধীরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। 
১৮ই মে রাজধানীর মগবাজারে প্রকাশ্য দিবালোকে এক ব্যক্তিকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে আঘাত করে ব্যাগ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে। ছিনতাই ও হামলার এই ভিডিও সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। মোটরসাইকেলে আসা তিন ছিনতাইকারী মগবাজারের গ্রিনওয়ে লেনে আবদুল্লাহ নামের এক যুবককে অস্ত্র ঠেকিয়ে তার মূল্যবান জিনিসপত্র ছিনিয়ে নেয়। ঘটনাটি প্রায় এক সপ্তাহ আগে ঘটলেও ভুক্তভোগী প্রথমে পুলিশকে অবহিত করেননি। তবে, ভিডিওটি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে পুলিশ উদ্যোগী হয়ে ভিকটিমের সঙ্গে যোগাযোগ করে এবং তাকে আইনি ব্যবস্থা নিতে বলে। ভুক্তভোগী আবদুল্লাহ মতিঝিলের একটি রেস্তোরাঁর কর্মী। ঘটনার দিন কুমিল্লায় তার গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। ছিনতাইকারীরা তার ১০ হাজার টাকা দামের মোবাইল ফোন, নগদ ১৪ হাজার টাকা এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র নিয়ে গেছে। সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, আবদুল্লাহ কাঁধে একটি ব্যাগ নিয়ে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন। কাছাকাছি একটি মোটরসাইকেলে ছিনতাইকারীরা অপেক্ষা করছিল। আবদুল্লাহ তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময়, চাপাতি হাতে থাকা মোটরসাইকেলের দু’জন আরোহী হঠাৎ তার পথ আটকায়। তাদের একজনের মাথায় হেলমেট এবং অন্যজন কালো মাস্ক পরা ছিলেন। কোনো কথাবার্তা ছাড়াই তারা আবদুল্লাহকে চাপাতি দিয়ে আঘাত করে ব্যাগ ছিনিয়ে নেয়।

মহাসড়কে আতঙ্ক: দেশের মহাসড়কগুলো অনিরাপদ হয়ে গেছে। একের পর এক অপ্রীতিকর দুর্ঘটনা  ছড়িয়ে পড়ায় আতঙ্ক বিরাজ করছে। গত সপ্তাহের মঙ্গলবার ঢাকা-টাঙ্গাইল-যমুনা সেতু মহাসড়কে ‘আল ইমরান’ পরিবহনের একটি চলন্ত বাসে যাত্রীদের হাত-পা ও চোখ বেঁধে ডাকাতি হয়েছে। এ সময় নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনাও ঘটে। ওইদিন রাত সাড়ে ১১টা থেকে বুধবার ভোর ৫টা পর্যন্ত ওই বাসের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ডাকাতদল যাত্রীদের সবকিছু লুটে নেয়। রাতভর যাত্রীদের নিয়ে চার-পাঁচবার টাঙ্গাইল ও চন্দ্রা-আশুলিয়া যাওয়া-আসা করে ডাকাতরা। বাসে প্রায় ১০ নারীসহ ৪৫ যাত্রী ছিলেন। পথে ওঠা বেশ কয়েকজন ডাকাত যাত্রীর ছদ্মবেশে উঠে ডাকাতি করে। লুটে নিয়ে যায় যাত্রীদের সঙ্গে থাকা টাকা, মোবাইল, স্বর্ণালংকারসহ মূল্যবান সবকিছু। এর আগে ১৭ই ফেব্রুয়ারি একই মহাসড়কে ইউনিক রয়েলসের একটি বাসে ডাকাতি ও নারী যাত্রীদের শ্লীলতাহানির ঘটনা ঘটে। যাত্রীবাহী আসে ডাকাতির পাশাপাশি মালবাহী গাড়িতেও ডাকাতির ঘটনা ঘটছে। সামনে কোরবানি ঈদ।  এ সময় ঢাকা থেকে নাড়ির টানে যেমন বাড়ি ফিরবে ঠিক তেমনি গ্রামাঞ্চল থেকে পশুবাহীগাড়ি ঢাকায় ঢুকবে। হাইওয়ে পুলিশ জানিয়েছে, মহাসড়ক নিরাপদ রাখতে পুলিশ ইতিমধ্যে জেলা পুলিশের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ শুরু করেছে। টহল বৃদ্ধিসহ, সিসিক্যামেরা স্থাপন, বাস মালিক ও চালকদের সঙ্গে সমন্বয়, পশুর খামারিদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়েছে। এ ছাড়া জামিনে মুক্তি পাওয়া ডাকাতদের তালিকা ধরে ধরে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অপরাধ বিজ্ঞানী ড. তৌহিদুল হক মানবজমিনকে বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী যতক্ষণ না পর্যন্ত শক্ত হাতে আইন প্রয়োগ ও সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণ করতে না পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত পরিস্থিতি ঘটতেই থাকবে। আর এটা করতে যত সময় নিবে অপরাধীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আরও বাড়তেই থাকবে। এখন কেউ অপরাধ করলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী গ্রেপ্তার করতে পারে, ব্যবস্থা নিতেও পারে নাও নিতে পারে এরকম একটা শঙ্কা থাকে। মামলা হলেও নানা ধরনের প্রশ্ন থাকে। পুলিশ নানাভাবে প্ররোচিত হয়ে মামলা নিয়েছে। ভুয়া মামলা করে বাণিজ্যের বিষয় আছে। পুলিশ বর্তমান সময়ে আইন প্রয়োগ করতে গিয়ে নানা সংকটে পড়ছে। অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক আ ন ম মুনীরুজ্জামান মানবজমিনকে বলেন, ব্যর্থতা হচ্ছে ১০ মাস সময়ের মধ্যে আমরা পুলিশ বাহিনীর কার্যক্রম বৃদ্ধি করতে পারিনি এবং তাদের যে সক্ষমতা থাকা দরকার আমরা তাদের সেই লেভেলে নিয়ে আসতে পারিনি। যারা তাদের পরিচালনা করেন এটি সম্পূর্ণভাবে তাদের ব্যর্থতা। এ ব্যাপারে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বড় ধরনের ব্যর্থতা আছে বলে আমি মনে করি। আর এটা যতক্ষণ পর্যন্ত সমাধান না করা যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত নাগরিকের জীবনের জানমালের নিরাপত্তার জন্য সরকার যেভাবে দায়বদ্ধ সেভাবে তারা নিরাপত্তা দিতে পারবে না।