Image description

অন্তত: আড়াই শ’ কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছে প্লাস্টিক পণ্য উৎপাদনকারী ‘ম্যাটাডোর গ্রুপ’। ভুয়া কাগজপত্র সৃষ্টি করে পর্যায়ক্রমে আত্মসাৎ করা হয় এ সম্পত্তি। আর এ আত্মসাৎ প্রক্রিয়ায় সহযোগিতা করেন ভূমি মন্ত্রণালয়, লালবাগ জোনের এসি (ল্যান্ড) অফিসের দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

তবে সম্প্রতি স্থানীয় একজন নাগরিক ওই সম্পত্তি জনস্বার্থে ব্যবহারের জন্য বরাদ্দের আবেদন করলে ভূমি মন্ত্রণালয় সরকারি সম্পত্তির ওপর থেকে অবৈধ দখল উচ্ছেদের উদ্যোগ নিয়েছে বলে জানা গেছে।

দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) অনুসন্ধানাধীন নথি থেকে জানা যায়, রাজধানীর হাজারীবাগ থানাধীন কালুনগর মৌজার ১ দশমিক ৭৯ একর সরকারি সম্পত্তি (১ নং খতিয়ানভুক্ত) আত্মসাৎ করেছেন ম্যাটাডোর গ্রুপ। প্রতিষ্ঠানটির মালিক জনৈক শাহাআলম। স্থানীয়ভাবে তিনি ‘শাহালম উকিল’ নামে সমধিক পরিচিত। লালবাগ রাজস্ব সার্কেলের অন্তর্ভুক্ত হাজারীবাগে আরএস ২০২৬, সিটি-১২১৯ নং দাগের ১.৭৯ একর (১০৯ কাঠা) আয়তনের এই সম্পত্তিটি সরকারি খাস জমি। যেটির সরকার নির্ধারিত মৌজা ভ্যালুই রয়েছে ১৫০ কোটি টাকা। প্রকৃত মূল্য কয়েক শ’ কোটি টাকা। নথির তথ্য মতে, স্থানীয়ভাবে স্বঘোষিত ‘দানবীর’ এবং ‘শিল্পপতি’ হিসেবে পরিচিত শাহালম উকিল দীর্ঘদিন ধরে সরকারি সম্পত্তিটি পর্যায়ক্রমে আত্মসাৎ করেন। তার আত্মসাতের কৌশল অভিনব। আত্মসাৎকৃত সরকারি সম্পত্তিগুলোর অবস্থান অধিকাংশই তার নিজস্ব মালিকানাধীন সম্পত্তি-লাগোয়া। এ কারণে প্রথমেই তিনি দুই কাঠা-পাঁচ কাঠা করে কিছু ব্যক্তিমালিকানাধীন সম্পত্তি কেনেন। অতপর নিজ সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের নামে খাস সম্পত্তির খানিকটা একীভূত করে দেয়াল তুলে দেন। চারপাশের উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরাও করে ফেলেন পুরো সরকারি সম্পত্তি। এখানে তিনি ‘ম্যাটাডোর অ্যামিউজমেন্ট পার্ক’ স্থাপন করেন। এতে সরকারি সম্পত্তির ওপর পথচারী অবাধে হাঁটা-চলার অধিকার হারিয়ে ফেলেন। স্বীয় দখলদারিত্বের পরিধি বাড়াতে পার্শ্ববর্তী নিরীহ অনেক ব্যক্তির শেষ সম্বলও কেড়ে নেয় ম্যাটাডোর গ্রুপের চেয়ারম্যান।

এভাবে গত তিন দশকে তিনি গ্রাস করেন ১.৭৯ একর আয়তনের সরকারি সম্পত্তি। দখলের পর সৃজন করেন জাল কাগজপত্র। সেই কাগজপত্রের ভিত্তিতে এসি (ল্যান্ড) অফিসের কতিপয় দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মাধ্যমে নিজের নামে নামজারি করে নেয়। তবে নামজারি করলেও রেকর্ড পরিবর্তন করতে পারেন না। ফলে রেকর্ডে ওই সম্পত্তি খাস বা সরকারিই থেকে যায়।

শাহালম উকিলের দখলে থাকা সরকারি জমি উদ্ধারের কোনো উদ্যোগই ওই লালবাগ রাজস্ব সার্কেলের কোনো এসি (ল্যান্ড) নেননি। এক ধরনের ‘মধুর বোঝাপড়া’য় ম্যাটাডোর কোম্পানির সঙ্গে হাত মিলিয়ে একের পর এক এসি (ল্যান্ড) দায়িত্বকাল কাটিয়ে গেছেন। এ কারণে দীর্ঘ সরকারি সম্পত্তি নিজের বলে দাবি করে সেটি ভোগদখল করতে ম্যাটাডোর গ্রুপের খুব একটা বেগ পেতে হয়নি।

ভূমি মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে সরকারি সম্পত্তি দখলের একাধিক অভিযোগ সম্প্রতি মন্ত্রণালয়ে জমা পড়েছে। সেখানে রয়েছে ম্যাটাডোর গ্রুপের দখলে থাকা বহু সরকারি সম্পত্তির তথ্য। প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান শাহালম দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছেন ভুয়া কাগজপত্রে নামজারি ও খারিজ করার। কিন্তু এসি (ল্যান্ড) অফিসের কয়েকজন সৎ কর্মকর্তা-কর্মচারীর কারণে সেটি তিনি পারেননি। তারা ইতোপূর্বে বেশ কয়েকটি নামজারির আবেদন নাকচও করে দিয়েছেন। এ কারণে তাদের অন্যত্র বদলি এবং ফৌজদারি মামলায় ফাঁসিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে চলেছেন।

ভূমি মন্ত্রণালয়ে দাখিলকৃত একটি অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সরকারি সম্পত্তির পাশাপাশি তিনি ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তিও জালিয়াতির মাধ্যমে আত্মসাৎ করেন। ‘দত্ত বাবুর সম্পত্তি’ হিসেবে পরিচিত গোবর্ধন দত্তের সাড়ে সাত কাঠা সম্পত্তি স্ট্যাম্পে লিখে নেন। গোবর্ধনের পুত্র সন্তোষ, প্রাণতোষ এবং আশুতোষ দত্ত উত্তরাধিকার সূত্রে এ সম্পত্তির মালিক। নামমাত্র মূল্যে তিনি এ সম্পত্তি কব্জা করে নেন।

এদিকে গত ৫ আগস্ট রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর শাহালম উকিল এবং তার দুই সন্তান ভোলপাল্টে হঠাৎ ‘আওয়ামী বিরোধী’ বনে গেছেন বলে জানা যায়। ফলে জুলাই-আগস্ট অভ্যুত্থানের পরপর তিনি নতুন করে আবেদন করেন সরকারি সম্পত্তি নিজের নামে নামজারি ও খাজনা-খারিজের।

অভিযোগ রয়েছে, লালবাগ রাজস্ব সার্কেলের বর্তমান এসি (ল্যান্ড) মো. শরিফুল হক ম্যাটাডোর গ্রুপের পক্ষে কাজ করছেন। প্রায়ই তিনি ম্যাটাডোর গ্রুপের চেয়ারম্যান শাহালম উকিলের বাসায় ছুটে যান। বিশেষ বোঝাপড়ার ভিত্তিতে তিনি চেষ্টা চালাচ্ছেন আরো কিছু সরকারি সম্পত্তি ম্যাটাডোর গ্রুপের হাতে তুলে দেয়ার।

আত্মসাৎকৃত সরকারি সম্পত্তি পুনরুদ্ধারের কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে কিনাÑ জানতে চাওয়া হয় লালবাগ সার্কেলের এসি (ল্যান্ড) শফিকুল হকের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, নথিপত্র না দেখে আমি বিস্তারিত বলতে পারব না। আপনি একদিন আসেন!

গত ২৪ মে নথিপত্র দেখার জন্য একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয় শফিকুলের সঙ্গে। কিন্তু তিনি ফোন ধরেননি।
এদিকে রাজধানীর হাজারিবাগ এলাকা পরিদর্শনে জানা যায়, শাহালম উকিলের বিরুদ্ধে জমি-সংক্রান্ত বিষয়ে একাধিক দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলা রয়েছে। তার মালিকানাধীন ম্যাটাডোর কোম্পানির ফ্যাক্টরিসহ নির্মিত বিনোদনকেন্দ্র ও রিসোর্টের অভ্যন্তরে অন্তত: ১০০ কোটি টাকা মূল্যের সরকারি সম্পত্তি রয়েছে। এসব বিষয়ে স্থানীয় অনেকে অতীতে মুখ খোলায় তার রোষানলে পড়েছেন। হামলা-মামলার ভয়ে এখন তাই স্থানীয়রা টুঁ শব্দটিও করতে পারছেন না।

শাহালম উকিলের আত্মসাৎকৃত সরকারি সম্পত্তির পাশেই রয়েছে একটি সরকারি হাইস্কুল। রয়েছে একটি সরকারি কলেজও। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দুটিতে কোনো খেলার মাঠ নেই। প্রতিষ্ঠান দুটির সংলগ্ন শত শত কোটি টাকার সরকারি সম্পত্তি গ্রাস করেছেন ম্যাটাডোরের মালিক। সম্পত্তিগুলো দখলমুক্ত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মাঠ হিসেবে বরাদ্দ দিলে শিক্ষার্থীদের খেলাধুলা ও সংস্কৃতি চর্চার সুযোগ সৃষ্টি হতো বলে মনে করছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।

তথ্যানুসন্ধানে জানা যায়, আশির দশকে ‘ম্যাটাডোর বলপেন’ প্রস্তুতের মধ্য দিয়ে যাত্রা ম্যাটাডোর গ্রুপের। পরবর্তীতে স্টেশনারি, ব্যক্তিগত যতœপণ্য, খাদ্যপণ্য, নির্মাণ সামগ্রী, প্লাস্টিক পণ্য, বিনোদন ও বেসরকারি স্বাস্থ্য খাতে বাণিজ্যিক বিস্তার ঘটায় প্রতিষ্ঠানটি। হাজারিবাগ এলাকার অ্যাডভোকেট শাহ আলম ম্যাটাডোরের চেয়ারম্যান। ‘ম্যাটাডোর বলপেন ইন্ডাস্ট্রিজ লি:’ দেখাশোনা করছেন তার পুত্র প্রকৌশলী সাগিরুল আলম। ১০২ আজিমপুর রোডে রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিশাল (ম্যাটাডোর হার্বার) কর্পোরেট অফিস। সরকারি সম্পত্তি আত্মসাতের বিষয়ে কথা বলতে যোগাযোগের করা হয় প্রতিষ্ঠানটির ম্যানেজিং ডিরেক্টর সাগিরুল আলমের সঙ্গে। ওয়েবসাইটে উল্লিখিত ফোননম্বরে একাধিকবার কল করা হয় তাকে। কিন্তু অপর প্রান্ত থেকে ফোন রিসিভ হয়নি। পরে গত ২১ মে ই-মেইল করে বক্তব্য চাওয়া হয়। গতকাল রোববার পর্যন্ত কোনো প্রতিউত্তর মেলেনি।

এদিকে সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ অভিযোগ সম্পর্কে জানতে চাওয়া হয় দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) মহাপরিচালক মো. আক্তার হোসেনের কাছে। জবাবে তিনি বলেন, সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ দুদকের তফসিলভুক্ত অপরাধ। যে বা যারা সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ করবেন তাদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলে কমিশন সেটি অনুসন্ধান করে আইনি ব্যবস্থা নেবে। তিনি যত প্রভাবশালীই হোন না কেন।