
ফরিদপুরের সংরক্ষিত আসনের সাবেক সংসদ সদস্য ও নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের জেলা কমিটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক ঝর্না হাসানের বিরুদ্ধে সরকারী সম্পত্তি দখল ও প্রতিবাদকারী মামলার বাদীকে প্রাণনাশের হুমকি দেওয়া অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে দেশের একাধিক গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ ও মামলা হলেও অদৃশ্য কারণে তাকে আইনের আওতায় আনতে পারেনি প্রশাসন।
ঝর্না হাসানের বিরুদ্ধে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে ছাত্রলীগের মাধ্যমে বহু ছাত্র-ছাত্রীকে নির্যাতনের অভিযোগ রয়েছে। এছাড়া জমি ও বাড়ি দখলের জন্য ভারতীয় এক নাগরিককে বাংলাদেশের নাগরিক সাজিয়ে জেলা প্রশাসনকে কাজে লাগিয়ে অর্পিত সম্পত্তিকে ব্যক্তি মালিকানার সম্পত্তিতে রূপান্তর ও তা দখলের চেষ্টা করেন এই আওয়ামী লীগ নেত্রী।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দক্ষিণ আলীপুরের ২২ শতাংশ জমি অর্পিত সম্পত্তি হলেও সেটিকে ব্যক্তি মালিকানাধীন সম্পত্তি করতে দীর্ঘদিন ধরে চেষ্টা চালাচ্ছেন প্রভাবশালী একটি চক্র। ২০০০ সালে ফরিদপুর পৌরসভার চেয়ারম্যান থাকার সময় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা হাসিবুল হাসান লাভলু ওই জমি ও বাড়ি দখলের চেষ্টা করেন।
ফরিদপুরের সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়েছে, ফরিদপুরের কোতোয়ালী থানাধীন আলীপুর মৌজার আরএস ৫৬৯ নম্বর খতিয়ানভুক্ত আরএস ৩১২৭ নম্বর দাগের ২২ শতাংশ জমির মালিক ছিলেন দীনেশ চন্দ্র সমাদ্দার। তিনি স্বাধীনতার আগে সম্পত্তি রেখে ভারতে চলে যান। ভারতের নাগরিকত্ব গ্রহণ করে স্থায়ীভাবে বসবাস করায় এবং আর কখনো এ দেশে ফিরে না আসার সুযোগে দীনেশ চন্দ্র সমাদ্দারের বাড়ির গৃহকর্মী ননীবালা দেবী এসএ রেকর্ডে তার নামে করে নেন জমিটি। পরবর্তী সময়ে ফরিদপুরের ডেপুটি কমিশনার ননীবালা দেবীকে নালিশী সম্পত্তি কীভাবে নিজ নামে এসএ রেকর্ড করালেন সে জন্য কারণ দর্শানোসহ দলিল দস্তাবেজসহ তার কার্যালয়ে হাজির হতে নোটিশ দেন। ননীবালা ডেপুটি কমিশনের আদালতে হাজির হলেও এসএ রেকর্ড ননীবালার নামে করানোর পক্ষে কোন কাগজপত্র বা উপযুক্ত দলিল দস্তাবেজ হাজির করতে না পারায় ডেপুটি কমিশনার নালিশি সম্পত্তির বাবদে ননীবালা দেবীর নামিয় এসএ ৫৩২ নম্বর খতিয়ান কর্তন করে নালিশি জমিকে অর্পিত অনাগরিক সম্পত্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করেন।
পরবর্তী সময়ে দেশ স্বাধীন হলে সরকার অর্পিত অনাগরিক সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করে অচিন্ত কুমার চক্রবর্তীর নামে ৫.২৫ শতাংশ এবং অন্যান্য বাদী ও তাদের আত্মীয়ের নামে বাকি সম্পত্তি সরকার লীজ প্রদান করে। এরপর থেকে তারা খাজনা দিয়ে আসছেন। তারা ওই জমিতে বাড়িঘর তৈরি এবং বৃক্ষ রোপণ করেন। পরবর্তী সময়ে ননী বালা ওই সম্পত্তিকে অর্পিত সম্পত্তি নয় ও নিজের সম্পত্তি দাবি করে ফরিদপুরের প্রথম সাব জজ আদালতে দেঃ ৮৯/১৯৭৯ নং মোকদ্দমা দায়ের করেন। দুপক্ষের শুনানি শেষে আদালত মামলাটি ডিসমিস করে দেয়। পরে ননী বালা দেবী এ রায়ের বিরুদ্ধে ফরিদপুরের জেলা জজ আদালতে আপীল মোকদ্দমা করলেও তিনি পরাজিত হন। পরবর্তী সময়ে ফরিদপুরের পৌরসভার চেয়ারম্যান হাসিবুল হাসান লাভলুর যোগসাজশে জরিপ কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের দিয়ে ভারতের নাগরিক বীরেশ চন্দ্র চক্রবর্তীর নামে এদেশের ভুয়া জাতীয় পরিচয় পত্র বানিয়ে ননী বালা দেবীর মিথ্যা ওয়ারিশ সাজিয়ে ফরিদপুরে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনালে মামলা করে। সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ভুল বুঝিয়ে এসএ রেকর্ডীয় মালিকের ভুয়া ওয়ারিশ দেখিয়ে ল্যান্ড সার্ভে ট্রাইব্যুনাল আদালত থেকে ডিক্রি লাভ করেন। ডিক্রি পেয়ে এ সম্পত্তি বিক্রি করে বীরেশ চন্দ্র চক্রবর্তী যাতে ভারতে পালিয়ে যেতে না পারে সে কারণে গত ২০ মার্চ সহকারী কমিশনার ভূমিকে এই সম্পত্তি বীরেশের নামে নামপত্তন না করতে নিষেধমূলক নিষেধাজ্ঞা প্রদান ও তদন্ত করে কার্যক্রম গ্রহণের জন্য বাদীরা প্রস্তাব করেন। কিন্তু সহকারী কমিশনার কোন পদক্ষেপ গ্রহণ না করায় বাদীরা আদালতে মামলা করতে বাধ্য হন।
বাদীদের একজন কালের কণ্ঠকে জানান, ওই জমির মালিক ছিলেন দিনেস চন্দ্র সমাদ্দার নামের একজন। তিনি স্বাধীনতার আগে ভারতে চলে যান। পরে তার সম্পত্তি দেখাশোনা করেন তার কাজের মহিলা ননী বালা। জমি রেকর্ড করার সময় ননী বালা তার নামে এসএ রেকর্ড করে ফেলেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৭৮ সালে এ জমিটি সরকার অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে ঘোষণা করে। এবং বাদীদের কাছে লীজ দেয়।
তিনি বলেন, সরকারের জমি অন্য কেউ দখল করে নেবে সেটা মানবো না। আমরা ৫৪ বছর ধরে সরকারি সম্পত্তি পাহারা দিচ্ছি। এই জমির বিষয়টি নিয়ে ২০১৫ সালে দুর্নীতি দমন কমিশনও তদন্ত করে। কমিশনের রিপোর্টে বলা হয়, বর্ণিত জমিতে হাসিবুল হাসান লাভলু (বর্তমানে মৃত) সাবেক চেয়ারম্যান ফরিদপুর পৌরসভা, ননীবালা দেবী কর্তৃক আম মোক্তার নিযুক্ত হন ও উক্ত জমি দীর্ঘদিন তাঁর ভোগদখলে ছিল এবং বর্তমানে তাঁর ওয়ারিশদের ভোগদখলে রয়েছে। ভিপি/হাল জরিপে বর্ণিত জমি হাসিবুল হাসান লাভলুর নামে রেকর্ড করা হয়। বর্ণিত জমি বিজ্ঞ আদালতের রায়ে ‘ভেস্টেট প্রপার্টি’ মর্মে উল্লেখ করা হলেও উক্ত জমি কখনোই ভিপি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত ছিল না এবং অর্পিত সম্পত্তি প্রত্যর্পণ (সংশোধন) আইন-২০১১ মোতাবেক প্রকাশিত বাংলাদেশ গেজেটের ‘ক’ ও ‘খ’ তফশিলভুক্ত সম্পত্তি হিসেবে প্রকাশিত হয়নি। উল্লিখিত জমির মূল মালিক ১৯৬৫ সালে দেশ ত্যাগ করার কারণে তা ‘ভেস্টেট প্রপার্টি’ বা ‘নন রেসিডেন্ট প্রপার্টি’ বলে গণ্য হবে। উল্লিখিত জমি হাসিবুল হাসান লাভলু (বর্তমানে মৃত) এর পক্ষে বর্তমানে তাঁর ওয়ারিশগণের নামে যেভাবে জরিপে রেকর্ড হয়েছে তা অবৈধ মর্মে প্রতীয়মান হয়।
এক বাদীর অভিযোগ এসিল্যন্ড শফিকুল ইসলামের সঙ্গে ঝর্ণা হাসানের যোগ সাজসে ভারতীয় নাগরিক বীরেশ চন্দ্রের নামে জমিটি নামজারির ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। তার ধারনা মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে এ ঘটনা ঘটানো হয়েছে। এসি ল্যান্ড আবার এর সাথে স্থানীয় প্রেসক্লাবের সভাপতি কবির আহমেদের সংশ্লিষ্টতার কিছু তথ্য দিয়েছেন।