
টিভি উপস্থাপক ও সাংবাদিক জিল্লুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশে আবারও ঘনীভূত হচ্ছে নির্বাচননির্ভর রাজনৈতিক বিতর্ক। যদিও অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ঈদুল আজহার প্রাক্কালে জাতির উদ্দেশে ভাষণে এপ্রিলে নির্বাচনের ইঙ্গিত দিয়েছিলেন। তারেক রহমানের সঙ্গে লন্ডনের বৈঠকের পর সেই সময়সীমা ফেব্রুয়ারিতে এগিয়ে আনার আভাস পাওয়া গেছে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, নির্বাচন আদৌ হবে কি? হলে সেটি কেমন হবে? তার গ্রহণযোগ্যতা কতটা থাকবে?
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত পরিস্থিতি যা, রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই।
জিল্লুর রহমান বলেন, বরাবর লক্ষ করেছি, বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি, এমনকি বিএনপির প্রধান নেতৃত্বের প্রতিও প্রফেসর ইউনূসের কোনো শ্রদ্ধাবোধ কখনোই ছিল না। খালেদা জিয়া এত দিন জেল খাটলেন, এত কষ্ট করলেন, প্রফেসর ইউনূসের জন্য তার সুদিনে-দুর্দিনে পাশে দাঁড়িয়ে কথা বলেছেন। বেগম জিয়াকে আমি শুনিনি প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস একটা ফোনও করেছেন। এই প্রশ্নগুলো সিলি মনে হতে পারে, কিন্তু আমার কাছে মনে হয় অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
তিনি আরো বলেন, নির্দিষ্ট কিছু ঘটনার পটভূমিতে ড. ইউনূস সরকারের নিরপেক্ষতা নিয়ে শুরু থেকেই সন্দেহ পোষণ করেছে বিএনপি। বিশেষ করে ইশরাক হোসেনের মেয়র হিসেবে শপথ না নেওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে। তারপর আবার ড. ইউনূসকে নিয়ে তারেক রহমানের যে সাম্প্রতিক মন্তব্য, যেখানে তিনি বলেছেন—ভবিষ্যতে বিএনপি সরকার গঠন করলে ড. ইউনূসকে কাজে লাগানো হবে। এই মন্তব্য কোথাও কোথাও আমি দেখেছি ছাপা হয়েছে। আমি জানি না আসলেই তিনি মন্তব্য করেছেন কি না। নতুন একটা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, যিনি ভবিষ্যতের অংশ হতে পারেন, তার অধীনে বর্তমান নির্বাচন কমিশন বা বর্তমান নির্বাচন কতটা নিরপেক্ষ হবে? আর ইতিমধ্যেই প্রফেসর ইউনূস ও তার সরকার এনসিপির প্রতি এবং কোনো কোনো ক্ষেত্রে জামায়াতের প্রতি যে ভালোবাসা প্রদর্শন করেছে, তাতে নিরপেক্ষতা সেখানেও কিন্তু প্রশ্নবিদ্ধ। যাইহোক, জাতীয় নাগরিক পার্টি এনসিপি এবং জামায়াতে ইসলামী প্রকাশ্যে বর্তমান নির্বাচন কমিশনের ওপর অনাস্থা জানিয়েছে।
তিনি বলেন, জামায়াত এক ধাপ এগিয়ে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে নির্বাচন আয়োজনের কথা বলছে। একই সময় সাবেক সিসি কে এম নুরুল হুদার ওপর মব সন্ত্রাসের ঘটনা আরো আশঙ্কা বাড়িয়েছে। প্রশ্ন উঠেছে, বর্তমান সিসি কি স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারছেন? না পারলে তার ভবিষ্যত কি হুদার মতোই হবে? এই আশঙ্কাগুলোকে ঘনীভূত করেছে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং সরকারের ভূমিকা। একের পর এক বিবৃতি দিয়ে সরকার যেন দায় সারছে। কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে না। বিশেষ করে হুদার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যখন সরকার বলল, আইন-শৃঙ্খলারা রক্ষাকারী বাহিনী যথাযথ কাজ করেছে কি না, তা তদন্ত করে দেখা হবে। তখন মানুষ কেবল হাসল না, হতাশাও প্রকাশ করল। কারণ গত ১০ মাসে একই ধরনের সহিংসতার পরে এমন ১৬টি বিবৃতি দিয়েছে সরকার। কোনোটি বাস্তব রূপ পায়নি। সরকার এখন যেন পরিণত হয়েছে বিবৃতি দানকারী সরকারে। যেখানেই সমস্যা সেখানেই একটা বিবৃতি। এনবিআরের কর্মবিরতি, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রদের হল আন্দোলন, সচিবালয়ের বিভিন্ন বিক্ষোভ—সব কিছুতেই সরকারের প্রতিক্রিয়া একই রকম একটা বিবৃতি। অথচ বাস্তবতা হলো— মব এখন রাষ্ট্রের চেয়ে শক্তিশালী। পুলিশকে আক্রমণ করা হচ্ছে। তাদের মনোবল ভেঙে পড়ছে এবং এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন আয়োজনের সক্ষমতা নিয়েও সন্দেহ তৈরি হচ্ছে। নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের কাজগুলো সময়সাপেক্ষ। সীমানা নির্ধারণ, ভোটার তালিকা হালনাগাদ, কেন্দ্র নির্ধারণ কর্মকর্তাদের বাছাই—সব মিলিয়ে সাত থেকে আট মাস পেয়েছেন অথচ এখন পর্যন্ত কোনো সুনির্দিষ্ট সময়সূচি নেই।
তিনি বলেন, জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক হচ্ছে নিয়মিত, কিন্তু সেখানে কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই। সরকার বলছে, জুলাই সনদ না পাওয়া পর্যন্ত কিচ্ছু বলা যাবে না; কিন্তু জনগণের প্রশ্ন জুলাই সনদের সঙ্গে নির্বাচনের তারিখের বিরোধ কোথায়? এই স্থবিরতা দেখে দেশের মানুষ আশাহত। সরকারের প্রায় সব সদস্যই বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার পটভূমি থেকে আসা। তারা কথা বলেন বেশি। কাজ করেন কম। সরকারও যেন এনজিও স্টাইলে চলছে। কখনো কখনো সেটাই মনে হয়। অথচ এই সরকার এসেছে জনগণের। অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে। জনগণ তাদের ওপর আস্থা রেখেছিল। কিন্তু এখন সেই আস্থা খুইয়ে যাচ্ছে। সরকারকে বুঝতে হবে, শুধু বিবৃতি দিয়ে রাজনীতি করা যায় না। একদিকে যেমন জাতীয় ঐকমত্যের আলোচনাকে গুরুত্ব দিতে হবে, অন্যদিকে একটি সুনির্দিষ্ট নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা জরুরি। এই মুহূর্তে জাতির প্রত্যাশা দুটো। একটা নির্দিষ্ট তারিখ এবং জনগণের দাবির বাস্তবভিত্তিক সমাধান। এই প্রেক্ষাপটে আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণ উপেক্ষণীয় নয়।
তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি মালয়েশিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী মাহাথির মোহাম্মদ বাংলাদেশের রাজনৈতিক অবস্থা নিয়ে কিছু প্রশ্ন করেছেন। ইউনূসকে তিনি প্রশংসা করলেও বাংলাদেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার আশাবাদ সীমিত। তিনি বলেন—শেখ হাসিনাকে হটাতে ঐক্য ছিল। কিন্তু এরপর কী ধরনের সরকার হবে, সে বিষয়ে কোনো ঐক্য নেই। এই অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বই বড় সংকটের উৎস। ইউনূসের আসিয়ান সদস্যপদ অর্জনের আকাঙ্ক্ষী মাহাথির সংশয় প্রকাশ করেছেন। তার মতে, ভৌগোলিক কারণে বাংলাদেশ আসিয়ানের মূল সদস্য হতে পারবে না। যদিও ডায়ালগ পার্টনার বা অবজার্ভার হিসেবে সুযোগ থাকতে পারে। এ ছাড়া রোহিঙ্গাসংকট নিয়ে মাহাথিরের মতামত জটিল বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে। তিনি বলেন—বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠতা ও ভৌগোলিক অবস্থান রোহিঙ্গা আশ্রয়ের প্রধান কারণ। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন এক ত্রিমাত্রিক সংকটে— ভবিষ্যৎ নির্বাচন, সুশাসনের অনুপস্থিতি এবং আন্তর্জাতিক আস্থার সংকট। এর সমাধান একমাত্র সম্ভব, জনগণকে আস্থায় এনে কার্যকর সিদ্ধান্ত ও বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্য দিয়ে। এখন আর সময় নেই বিবৃতির, এখন প্রয়োজন সিদ্ধান্তের। সিদ্ধান্তহীনতা শুধু সরকারের গ্রহণযোগ্যতা নয়, দেশের ভবিষ্যৎকেও সংকটে ফেলতে পারে।