
নির্বাচনের দিনক্ষণ, ইশরাক হোসেনের শপথের দাবিতে কর্মসূচি পালন, সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের বক্তব্যসহ কয়েকটি ইস্যুতে দেশের রাজনীতিতে দুই দিন ধরে গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কিন্তু যেসব ইস্যুতে এই পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে, শুক্রবার (২৩ মে) পর্যন্ত তা নিষ্পত্তির খবর পাওয়া যায়নি।
তবে ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা পালনকারী আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টি ও গণঅধিকার পরিষদের শীর্ষ পর্যায়ের দুই নেতা এ বিষয়ে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়েছেন। তারা সরকার এবং বিএনপির শীর্ষ পর্যায়ে যোগাযোগ করে সমঝোতার চেষ্টা চালাচ্ছেন বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। বিএনপির দিক থেকে দলটির স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী একজন সদস্য এই সমঝোতা উদ্যোগের সঙ্গে জড়িত।
এদিকে শুক্রবার গভীর রাতে জানা গেছে, আজ রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় বিএনপি ও রাত সাড়ে আটটায় জামায়াতে ইসলামীর বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে।
বিএনপি ড. ইউনূসকে অপমান বা অসম্মান করার পক্ষে নয়। শুধু নির্বাচনের একটি রোডম্যাপ পেলেই দলটি খুশি। এ ছাড়া দুজন উপদেষ্টার ব্যাপারে তারা ক্ষুব্ধ; যেটি সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলে তারা জানিয়েছে।
এদিকে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে গতকাল ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে ভূমিকা পালনকারী বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে দফায় দফায় বৈঠক হয়েছে। বিএনপি, জামায়াতে ইসলামী, হেফাজতে ইসলাম, ইসলামী আন্দোলন, জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, এবি পার্টি, ১২-দলীয় জোট, গণঅধিকার পরিষদসহ অন্যান্য দল পরস্পরের সঙ্গে দফায় দফায় বৈঠক করেছে।
সূত্রের দাবি, সমঝোতা উদ্যোগের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ওই তিনজন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর এবং লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। উদ্দেশ্য হলো, বিএনপির সঙ্গে সৃষ্ট দূরত্ব কমানোর পাশাপাশি ড. মোহাম্মদ ইউনূস যাতে পদত্যাগ না করেন এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করা। যদিও প্রধান উপদেষ্টা ‘ড. ইউনূস পদত্যাগ করছেন না’ এমন একটি পোস্ট ফেসবুকে দিয়ে পরে আবার প্রত্যাহার করে নিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টার আইসিটিবিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ। তিনি লিখেছিলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করবেন না। তার ক্ষমতার প্রয়োজন নেই। কিন্তু বাংলাদেশের জন্য ড. ইউনূসের প্রয়োজন আছে।’
সূত্রমতে, সমঝোতা উদ্যোগে সবারই ‘মুখ রক্ষা’ হয় নির্বাচনের জন্য এমন একটি রোডম্যাপ ঘোষণার বিষয়ে চেষ্টা চলছে। বিএনপি ও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলছেন। অন্যদিকে প্রধান উপদেষ্টাসহ সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন নির্বাচন হবে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে। ফলে এই দুইয়ের মাঝখানে ফেব্রুয়ারি-মার্চের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে দিনক্ষণ নিয়ে বিতর্কের নিষ্পত্তি হয় বলে অনেকে মনে করছেন।
এ ছাড়া কয়েকজন উপদেষ্টার ভূমিকা ও বক্তব্যের কারণে সরকার ও বিএনপির মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে বলে মনে করা হয়। এই উপদেষ্টাদের উপদেষ্টা পরিষদ থেকে সরিয়ে নতুন উপদেষ্টা নিয়োগ করার বিষয়টিও বর্তমানে আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে। এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে অন্তর্বর্তী সরকারের যেসব উপদেষ্টার কারণে জাতীয় অনৈক্য তৈরি হয়েছে, তাদের পদত্যাগ করার দাবি জানিয়েছেন।
তিনি বলেন, ‘যেসব উপদেষ্টার বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এসেছে, তাদের আরও আগে পদত্যাগ করা উচিত ছিল। আপনারা অনৈক্যের জন্য দায়ী, বিভেদের জন্য দায়ী, রাষ্ট্রকে একটি জায়গায় নিতে পারছেন না, প্লিজ আপনারা পদত্যাগ করুন। এর মাধ্যমে সেখানে যোগ্য লোকদের দায়িত্ব দেওয়ার পথ তৈরি করুন।’
গণঅধিকার পরিষদের সভাপতি নুরুল হক নুর গতকাল শুক্রবার খবরের কাগজকে বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের এখন আর কোনো বিষয় নেই। কারণ রাজনৈতিক দলগুলোর তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। ছোটখাটো যেসব সংকট তা নিরসনে আমরা রাজনৈতিক সংলাপের আহ্বান জানিয়েছি। তবে দুই ছাত্র উপদেষ্টার ভূমিকার ব্যাপারে আমরা আপত্তি করেছি।’
নুর আরও বলেন, ড. ইউনূস পদত্যাগ করলে দেশের জন্য সংকট আরও বাড়বে। বরং নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে সমঝোতায় পৌঁছানো গেলে সবার জন্য মঙ্গলজনক হবে।
তবে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেছেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা একটি সময় দিয়েছেন, ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যে নির্বাচন হবে। তার একদিনও এদিক-সেদিক হওয়ার কোনো সুযোগ নেই।’ তিনি এও বলেন, ‘শুধু নির্বাচন করার জন্যই আমরা দায়িত্ব নিইনি।’
নির্বাচনের দিনক্ষণ নিয়ে বিএনপি ও এনসিপি নেতাদের বাকযুদ্ধ কয়েক মাস ধরেই চলছিল। এরই মধ্যে সম্প্রতি বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র হিসেবে শপথ পড়ানো এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাম্য হত্যার বিচারের দাবিকে কেন্দ্র করে লাগাতার কর্মসূচি পালনে রাজধানীতে অচলাবস্থা তৈরি হয়। এই পরিস্থিতির মধ্যেই ‘ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হতে হবে’ সেনাপ্রধানের এমন বক্তব্য রাজনীতিতে নতুন এক পরিস্থিতি তৈরি করে। এনসিপির সভাপতি নাহিদ ইসলাম জানান, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগের কথা ভাবছেন। এতে দেশজুড়ে অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতির তৈরি হয়। নানা গুঞ্জনও ছড়িয়ে পড়ে।
কারণ ড. ইউনূস পদত্যাগ করলে দেশে আরেক ধরনের সাংবিধানিক শূন্যতা তৈরি হবে। সরকার বা প্রশাসন বলতে কিছুই থাকবে না। উপরন্তু অরাজক এক পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আলোচনা আছে, বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশি-বিদেশি নানা শক্তি সক্রিয় হয়ে উঠেছে। ফলে পরিস্থিতি কোন দিকে মোড় নেয়, তা নিয়ে গত দুই দিন দেশব্যাপী এক গুমোট পরিস্থিতি বিরাজ করে। সরকার, সেনাবাহিনী ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে পুরো দেশ গুঞ্জনে ছেয়ে যায়। ফেসবুকসহ বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়াতেও এই গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে। তবে জনগণকে গুজবে কান না দিতে এবং বিভ্রান্ত না হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী। এমন পরিস্থিতিতে নতুন দুটি দলের প্রধান এবং বিএনপির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা গতকাল সরকারের সঙ্গে এবং লন্ডনে দফায় দফায় কথা বলে পরিস্থিতি শান্ত করার চেষ্টা করেন।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ চাইনি। আমরা ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ চেয়েছি। উনি যদি রোডম্যাপ দিয়ে দেন, তাহলে অনেক সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।’ তিনি বলেন, ‘আমরা পদত্যাগ চেয়েছি নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের। উপদেষ্টা পরিষদে দুজন ছাত্র রয়েছে, আমরা তাদের পদত্যাগ চেয়েছি। কারণ যেহেতু সরকারের নিরপেক্ষতা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। এখন কেন তিনি দায়িত্ব পালন করতে চান না, সেটা ওনার নিজস্ব ব্যাপার।’
জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের গতকাল এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘বাংলাদেশ এক কঠিন পরিবর্তনের সন্ধিক্ষণে আছে। অন্তর্বর্তী সরকারকে টিকিয়ে রাখতে হবে। এখন সবকিছু ছেড়ে দিয়ে নির্বাচনকে প্রাধান্য দিতে হবে। মানুষের আস্থা অর্জন করতে হবে। সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই সংকটের সমাধান হতে পারে। সরকারের পক্ষ থেকে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচনের কথা বলা হয়েছিল। এই সময়ের মধ্যে রোডম্যাপ ঘোষণা করুন। তবে সুষ্ঠু নিবাচনের ব্যাপারে জামায়াত কোনো আপস করবে না।’
এর আগে গত বৃহস্পতিবার জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমান দেশের উদ্ভূত পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে একটি সর্বদলীয় বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছেন। এদিকে ড. ইউনূসকে নির্বাচন পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার আহ্বান জানিয়েছে হেফাজতে ইসলাম।
দলটির সিনিয়র নায়েবে আমির মাওলানা মহিউদ্দিন রাব্বানী খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার বিষয়টি গুরুতর হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুধু ছাত্রদের রক্ত নয়, সবার রক্তের বিনিময়ে এই সরকারকে বসানো হয়েছে। ফলে রাষ্ট্রের যেসব জায়গায় সংস্কার প্রয়োজন, তা শেষ করে সরকার যদি সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে ব্যর্থ হয় তাহলে এই ব্যর্থতা সব রাজনৈতিক দলের ওপর পড়বে। দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব হুমকির মুখে পড়লে তার দায়দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘একটি মহল সরকার ও সেনাবাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করানোর চেষ্টা করছে। সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে। সব রাজনৈতিক দলকে সংস্কারের ব্যাপারে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে, প্রয়োজনে আবারও বসে সমস্যা সমাধানে কর্মপরিকল্পনা ঠিক করতে হবে। তা না হলে হিতে বিপরীত হবে এবং তা জাতির জন্য কল্যাণ বয়ে আনবে না।’
ইসলামী আন্দোলনের সিনিয়র নায়েবে আমির মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ ফয়জুল করিম খবরের কাগজকে বলেন, ‘বর্তমান সরকারকে সরাতে চেষ্টা করছে ভারত ও তাদের গোয়েন্দা সংস্থা। তারা বাংলাদেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এ জন্যই ভারতে বসে স্বৈরাচার শেখ হাসিনা এখন নির্বাচনের কথা বলছে। এমন পরিস্থিতিতে ভারত ও পতিত আওয়ামী লীগের ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রাজনীতিবিদ ও দেশবাসীকে সতর্ক থাকতে হবে।’
এবি পার্টির চেয়ারম্যান মজিবুর রহমান মঞ্জু খবরের কাগজকে বলেন, ‘আমরা মনে করি দেশের একটি বিশেষ পরিস্থিতিতে সবার নানা ভুলভ্রান্তি ও অস্বস্তিকর আচরণ আজকের জটিল পরিস্থিতির জন্য দায়ী। প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়, বরং তা ভয়াবহ অনিশ্চয়তার জন্ম দেবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্রের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সংকট ও জটিল পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসের পদত্যাগ নয় বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব পক্ষকে সমঝোতামূলক সমাধানে পৌঁছাতে হবে। সরকারের উচিত সব পক্ষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একটা সমাধানের পথ বের করা।’