Image description

Maskwaith Ahsan( মাস্কওয়াইথ আহসান)

 
আওয়ামী লীগ এর পতনের পরপরই এক পাল ইউটিউবার ও টকশো টকারকে নিয়োগ করে ড ইউনুসের ছিদ্রান্বেষণ করার জন্য। তারা ভারতের আজতক টিভি ও রিপাবলিক টিভির এক্সটেনশান হিসেবে কাজ করতে থাকে। তাদের মিথ্যা প্রচারণা ও উস্কানির বিরুদ্ধে কখনো নাগরিক সমাজের কোন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে কথা বলতে দেখিনি। হয়তো সাংস্কৃতিক হতে গেলে ভারতিক হতে হয়; এই দৃঢ় বিশ্বাস গেথে দেয়া হয়েছিলো বংকিমচন্দ্রের ভাষায় "পূর্ববঙ্গের নিম্নবর্গের মানুষে"-র মনে। ফলে পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে নক্সী পাঞ্জাবি পরতে শিখলেই বৃটিশ কোলাবরেটর জমিদারের ঢঙ্গে বাকি মানুষদের বাঙ্গু বা বাঙ্গি বলে ডেকে একটি কাল্পনিক আভিজাত্য মহল গড়তে হয়। তাইতো আজতক, রিপাবলিক, আওয়ামী ইউটিউবারদের অকথ্য প্রচারণা কাল্পনিক অভিজাত মনে কোন রেখাপাত করে না।
 
অথচ হাতে গোণা যে দু'চারজন ইউটিউবার ড ইউনুসকে সমর্থন করে কথাবার্তা বলে; যে কোন সুযোগে তাদেরকে যে কোন বিপত্তির জন্য দায়ী করা কাল্পনিক প্রগতিশীলতা ও মনগড়া আভিজাত্যের প্রতীক যেন। কেউ কেউ মুখ ফুটে বলতে পারে না, যেহেতু এই ইউটিউবাররা শেখ হাসিনার ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে একটি দশক কথা বলে জনমত সংগঠিত করেছে; তাই মনের খুব গোপনে তাদের প্রতি ক্রোধ রয়ে গেছে।
 
নব্য সুশীলদের একই রকম ক্রোধ প্রকাশ হয়ে পড়ে জুলাই বিপ্লবের তরুণদের প্রতি। কেন দুধভাতে উতপাত করলো ওরা। দেশটা লুন্ঠন করে ভারতে পালিয়ে গেলো আওয়ামী লীগ, তাদেরকে চেটে একসারা করেছে দেড় দশক; অথচ জুলাই বিপ্লবীরা অভিজাত হোটেলে একটি ইফতার আয়োজন করলে; পারলে তাদের ছিঁড়ে খেয়ে ফেলে এই অচলায়তনের কাল্পনিক অভিজাতেরা। ২০০৯ সালে যাদের ক্ষুধার গন্ধে তাদের সঙ্গে মুখোমুখি বসে কথা বলা যেতো না; তারা হাসিনার পনেরো বছরে বালবদর হয়ে এতোই সম্ভ্রান্ত হয়েছে যে, জুলাই বিপ্লবীদের তারা লালবদর বলে তকমা দেয়। ২০০৯ সালে যার শার্টের কলারে দারিদ্র্যের চিতে পড়ে থাকতো; মাত্র পনেরো বছরে সে এতোই জমিদার হয়েছে যে, সন্তানসম ছেলেরা যারা রক্ত ও ত্যাগে দেশকে ফ্যাসিস্ট রাক্ষস মুক্ত করেছে, তাদের টোকাই বলে ডাকে তারা। ক্রোধের এই মাত্রা দেখে বোঝা যায়, ইঁদুর থেকে তেলাঞ্জলি দিয়ে পাহাড় হয়ে আবার ইঁদুরে রুপান্তরের মুখে পড়েছে ঐ লোকগুলো।
 
এই নতুন কাল্পনিক সম্ভ্রান্ত শ্রেণী নিজের ছেলে-মেয়েকে ইংলিশ মিডিয়ামে পড়িয়ে পশ্চিমে পাঠিয়ে দেয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে গোরাদের ক্লার্ক হয়ে ফেসবুকে সাফল্যের গল্প চাঁড়তে। আর বাংলাদেশের যে তরুণেরা জুলাই মাসে বুকের রক্ত দিয়ে যাত্রাবাড়িকে লেনিনগ্রাদ করে তুলেছিলো, তাদের ইতর ইসলামিস্ট বলে গালি দেয়। এই "ইতর" শব্দটি বৃটিশ কোলাবরেটর জমিদারেরা পূর্ব বঙ্গের কথিত নিম্নবর্গের মানুষের ক্ষেত্রে ব্যবহার করতো। দাড়ি টুপি থাকলেই সে ইসলামিস্ট; অথচ জোড়াসাঁকোর কস্টিউম পরে ঘুরতে দেখলে তাকে ভারতিক বললেই তখন গোস্বা হয়ে যায়।
 
৫ অগাস্টের পর দাড়ি টুপিওয়ালা মানুষের একটি অংশ মাজার ভেঙ্গেছে, আরেকটি অংশ মন্দির পাহারা দিয়েছে; দুর্গা পূজা সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠিত হতে সাহায্য করেছে। অথচ ইসলামিস্ট দেশটাকে শেষ করে দিলো এই ভারতীয় মিডিয়ার বয়ান বহন করছে আমাদের নতুন বাবু কালচারের লোকগুলো।
আওয়ামী লীগের পনেরো বছরে সিপি গ্যাং নারী সমাজকে অশ্লীলতম গালাগাল করেছে। তখন স্পিকটি নট ছিলো নতুন বাবুরা। আর দাড়ি টুপিওয়ালা কিছু লোক নারীকে অশ্লীল গালি দিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করলেও বাবুদের বয়ানে কেষ্টা ব্যাটাই চোর হয়ে রয়ে যায়।
 
বাংলাদেশের সবচেয়ে অধিকার বঞ্চিত এই দাড়ি টুপিওয়ালা মানুষেরা। বাংলাদেশ ছাড়া তাদের আর কোন ঠিকানা নেই। অথচ পনেরো বছর ধরে আওয়ামী লীগ তাদের পাখির মতো হত্যা করেছে। দাড়ি টুপিওয়ালা মানুষের ডিহিউম্যানাইজেশন প্রক্রিয়ায় নতুন বাবুদের বয়ান সতত ক্রিয়াশীল। অথচ বাবুদের সন্তানেরা পশ্চিমে ক্লার্ক হওয়ার পিলগ্রিমস প্রোগ্রেসে। আর এই দাড়ি টুপিওয়ালা মাটির ময়নারা এ মাটির সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছে।
 
আওয়ামী লীগের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের চুইংগাম চেবানোর ক্ষেত্রে দাড়ি টুপি মানেই জামায়াত; ইসলামিস্ট মানেই একাত্তরের রাজাকার এই ভারতীয় সত্যটি প্রতিষ্ঠায় মোদি প্রগতিশীল বলয়টি সদা সক্রিয়।
ঢাকার নতুন বাবু কালচারটি নিজেই কখনো ইনক্লুসিভিটিকে বিবেচনা করেনি; আমরা বনাম ওরা না করলে; ও যে একটু ভদ্দরনোক হয়েছে সেই আত্মপ্রশস্তি আসবে কোথা থেকে।
 
এই কালো ফ্রেমের চশমা ও নক্সী পাঞ্জাবি পরা বাবুগুলো তাদের চুইংগাম চেবানোর দক্ষতায়; ভারতিক ব্যাপ্টিজমের মাধ্যমে "আমাদের লোক" বানানোর কারখানা খুলে রাখে। আমাদের লোক হলে তুমি অভিজাত হয়ে গেলে; তখন পারমিতা কুলসুমের বাসায় আট রকমের ভর্তার দাওয়াত, এক বোতল খুশিজল ষোলজন ভাগ করে পানের এসথেটিকস দুপুরে নেমন্তন্ন পাবে। সেইখানে চোখ বুঁজে গালে সুপোরি পুরে ঘষাকাঁচের চশমা পরা পক্ককেশ বলেন, রোবনাথ ইজ আর কমপ্লিট কোড অফ লাইফ। অমনি উপস্থিত সবাই আহা উহু করে আকলিমা নদীকে একখানি রবীন্দ্র সংগীত শোনাতে বলে; আমাদের তো সুচিত্রা মিত্র নেই; তাই আকলিমা নদীর হামদ নাত স্টাইলে গাওয়া রবীন্দ্র সংগীত শুনে কালচারাল লোক হতে হয়।
 
গত পনেরো বছর এই কালচারাল গৃহটি দেখে বিএনপিরও শখ হয়েছে অমনিতরো সাংস্কৃতিক হবার। সাংস্কৃতিক হতে গেলে দাড়ি টুপিকে ছোট করলে না বড় হওয়া যায়। ফলে বিএনপি আওয়ামী লীগের প্লে বুক থেকে শব্দ নিয়ে দাড়ি টুপিদের গালাগাল করে। ভারতিক স্বরলিপিতে গান গায়।
এনসিপির নতুন ছেলেদের জুলাই মাসেই বীণা সিক্রি মৌলবাদি তকমা দিয়েছেন, তসলিমা নাসরিন হিজবুত তাহরির বলে গোবর ছুঁড়েছেন। কালচারাল উইং সেই বয়ানের ময়লা বস্ত্রখণ্ড নিয়ে দৌড়েছে। এনসিপি এই ইসলামি গাড্ডায় পড়ে যাবার ভয়ে হঠাত আওয়ামী লীগের প্লে বুক এনে দাড়ি টুপিওয়ালাদের রাজাকার বলে গালি দেয়।
 
জুলাই বিপ্লবীদের মাঝে বিভাজন সম্পন্ন হতে দেখে ৫ অগাস্ট অগত্যা যারা হাসিনাকে অজিত দোভালের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছিলো; তারা দশ মাসে শক্তি সঞ্চয় করে কেশর ফুলাতে থাকে। হাসিনা ছিলো প্ল্যান এ, আর প্ল্যান বি ছিলো এটাই। সবাইকে কালচারাল ওয়ারে ব্যস্ত রেখে প্রণব মুখার্জির উপহার দেয়া মঈনের ঘোড়াগুলি প্রস্তুতি নিয়েছে দাবার বোর্ডে ড ইউনুসকে চেক মেট করতে। এই ইউনুসের আন্তর্জাতিক পরিসরে লিবেরেল হিসেবে গ্রহণযোগ্যতা থাকায়; প্রায় অপরিচিত হিন্দুত্ববাদী বীণা সিক্রিদের পক্ষে "বাংলাদেশকে জঙ্গীদের খপ্পরে" প্রমাণ করা প্রায় অসম্ভব হয়েছে। শুধু ইউনুস না থাকলে বাংলাদেশকে ইরান, আফঘানিস্তান প্রমাণ ওয়ান টু'র ব্যাপার। তখন ওয়াশিংটনও আবার বাংলাদেশ চ্যাপ্টার দিল্লির দরবারে সমর্পণ করে বলতে পারে, যাও এবার গাজা গাজা খেলো।