Image description

রাজধানীসহ সারা দেশে পারিবারিক সহিংসতা বেড়েছে। তা থেকে আপনজনের হাতে পরিবারের সদস্য খুন হওয়ার ঘটনাও  বেড়েছে।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) তথ্য বলছে, রাজধানীতে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত চার মাসে ১৩৬টি হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ৭৯টি ঘটেছে পারিবারিক কলহ, ব্যক্তিগত বিরোধ, অর্থনৈতিক লেনদেনসহ তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করে।

পারিবারিক সহিংসতার ঘটনার বিষয়ে সুনির্দিষ্ট জরিপের তথ্য বা পরিসংখ্যান পাওয়া না গেলেও পুলিশ সূত্র ও গণমাধ্যমে আসা খবরে গত সাড়ে চার মাসে পারিবারিক কলহের কারণে অন্তত ৩০টি হত্যার ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, জমি বা সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্কের জের, মাদকাসক্তি, যৌতুক, পরিবারে সদস্যদের মধ্যে আয়ের বৈষম্য ও পরিবারের সদস্যদের মধ্যে স্বার্থের দ্বন্দ্ব থেকে এসব ঘটনা ঘটছে। পুলিশ বেশির ভাগ আসামিকে গ্রেপ্তার করলেও অনেকে ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। 

ডিএমপি সূত্র বলছে, রাজধানীতে মোট হত্যাকাণ্ডের ৪০ শতাংশের বেশি ঘটনা ঘটেছে পারিবারিক কলহের কারণে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম চার মাসে সারা দেশে ১১৩ জন নারী পরিবারের সদস্যদের হাতে খুন হয়েছেন। এর মধ্যে স্বামীর হাতে ৭৩ জন নারী খুন হয়েছেন। ২২ জন খুন হয়েছেন স্বামীর পরিবারের সদস্যদের হাতে। বাকি ১৮ জন নিজ পরিবারের সদস্যদের হাতে খুন হন।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশন (এমএসএফ) বলছে, চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে ১৯৭ জন নারী ও শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। গত বছর হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ৮৫১ জন নারী ও শিশু, যাদের বেশির ভাগই পারিবারিক দ্বন্দ্বের বলি।

অপরাধ ও সমাজ বিশ্লেষকরা বলছেন, পারিবারিক সহিংসতার মূলে রয়েছে পারিবারিক বন্ধন দিনের পর দিন নড়বড়ে হয়ে পড়া, তথ্য-প্রযুক্তির নানা অপব্যবহার এবং আরো কিছু নেতিবাচক কারণ।

টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি অ্যান্ড পুলিশ সায়েন্স বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ উমর ফারুক কালের কণ্ঠকে  বলেন, যত দিন যাচ্ছে, পারিবারিক সম্পর্কের জায়গাটা ততই দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। এর বেশ কিছূ কারণ আছে। যেমনপারিবারিক সুস্থ বিনোদনের অভাব, তথ্য-প্রযুক্তির অপব্যবহার, অর্থনৈতিক সংকট, মনস্তাত্ত্বিক জায়গা থেকে পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কের জায়গায় ঘাটতি হচ্ছে।

অপরাধ ও সমাজবিশ্লেষক অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর মতে, মানুষের মধ্যে লোভ-লালসা বেড়ে গেছে। তাই ব্যক্তি নিজের প্রত্যাশা অনুসারে চাহিদা পূরণ করতে না পারলে কিংবা এতে কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলে রাগে-ক্ষোভে কিছু মানুষ সহিংস হয়ে ওঠে। তাই এসব অপরাধ রোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার পাশাপাশি পারিবারিক ও সামাজিকভাবে সবাইকে যার যার অবস্থান থেকে সতর্ক হয়ে ঐক্যবদ্ধভাবে  কাজ করতে হবে।

তিনি বলেন, পরিবার ও সমাজে মতের অমিল ও বিভেদ চিরদিনই থাকবে। এটা স্বাভাবিক। তবে এটাকে সহিংসতায় রূপ না দিয়ে যৌক্তিক সমাধান খুঁজতে হবে। 

পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) ইনামুল হক সাগর বলেন, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী পারিবারিকসহ যেকোনো অপরাধের ঘটনা অতি গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত করে থাকে। তবে পারিবারিক সহিংসতার ঘটনা যখন হত্যাকাণ্ডের পর্যায়ে চলে যায়, তখনই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর নজরে আসে। এ জন্য সহিংসতার প্রাথমিক পর্যায়ে দরকার সামাজিক আন্দোলন ও মানসিক কাউন্সেলিং।

স্বজনদের হাতে খুনের কয়েকটি ঘটনা : গত ১৬ মে মুন্সীগঞ্জের আধারা ইউনিয়নের দেওয়ানকান্দি এলাকায় পারিবারিক কলহের জেরে স্ত্রীকে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন স্বামী। এ ঘটনায় স্বামী সুজন মোল্লাকে রাতেই গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

গত ৯ মে ঢাকার সাভার পৌর এলাকার মজিদপুর কাঁঠালবাগান মহল্লায় আবদুস সাত্তার (৫৬) নামের এক ব্যক্তিকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে অচেতন করে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করেন তাঁর মেয়ে জান্নাত জাহান শিফা (২৩)। ঘটনার ছুরিকাঘাতের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকেও পোস্ট করেন শিফা। একই দিন তিন হাজার টাকা দিয়ে একটি পুরনো বাইসাইকেল কেনার জন্য খালার টাকা চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে। পরে দুই খালা মরিয়ম বেগম (৬০) ও সুফিয়া বেগমকে (৫২) হত্যা করে তাঁদের আপন বোনের ছেলে।

গত ৫ এপ্রিল সাতক্ষীরার কলারোয়ায় মাছ ধরাকে কেন্দ্র করে সংঘাতে আপন ছোট ভাইয়ের হাতে বড় ভাই  মোশারফ হোসেন (৬০) খুন হন। গত ২২ মার্চ পাবনার সাঁথিয়ায় পারিবারিক কলহ চলাকালে ঘুম থেকে তোলার জন্য ছেলে মানিক হোসেনের (২৮) হাতে বাবা আব্দুল মালেক (৬০) খুন হয়েছেন।

৭ মে রাতে রাজধানীর তুরাগে পারিবারিক কলহের জেরে স্বামীর দেওয়া আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যান রিজিয়া বেগম (৪২) নামের এক গৃহবধূ।