Image description

অনিয়মের কবলে পড়েছে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক পর্যায়ের উপবৃত্তি। এই অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছে মোবাইল ফিন্যানশিয়াল সার্ভিস নগদসহ কিছু শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তা। এমনকি মানা হচ্ছে না উপবৃত্তি দেওয়ার শর্ত। ফলে উপবৃত্তির মাধ্যমে সরকারের যে লক্ষ্য অর্জন করার কথা, তা হচ্ছে না। অনেক সময় উপবৃত্তির সুফলভোগী শিক্ষার্থীদের তথ্য কাগজে-কলমে থাকলেও বাস্তব চিত্র ভিন্ন।

সূত্র জানায়, বিগত সরকারের প্রভাব খাটিয়ে ভাতা, প্রণোদনা, উপবৃত্তি বিতরণে একচ্ছত্র আধিপত্য পেয়েছিল নগদ। প্রাথমিক স্তরের এক কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থীর পাশাপাশি ষষ্ঠ থেকে স্নাতক শ্রেণির শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি বিতরণের দায়িত্ব এককভাবেই নগদকে দেয় বিগত সরকার। অনিয়ম, ব্যর্থতা আর জালিয়াতির অভিযোগ থাকার পর এ বছরও এককভাবে নগদের মাধ্যমে উপবৃত্তি বিতরণের নির্দেশনা দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্ট।আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত নগদের সঙ্গে সরকারের এই চুক্তি রয়েছে।

সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নগদ থেকে অনেক শিক্ষার্থীর মোবাইলে উপবৃত্তির টাকা পাঠানো হলেও মফস্বলে কারো কারো সিম বন্ধ থাকে। সেই সংখ্যা লাখ লাখ। কিন্তু এর মধ্যে কত শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির টাকা নগদ থেকে রিফান্ড করা হয়, তা নিয়ে বড় ধরনের সন্দেহ রয়েছে। যদি ১০ লাখ শিক্ষার্থীর সিম অকেজো থাকে আর নগদ থেকে যদি পাঁচ লাখ শিক্ষার্থীর টাকা রিফান্ড করা হয় তাহলে ধরার মতো কোনো অবস্থা থাকবে না। অন্যদিকে গ্রামে-গঞ্জে নগদের এজেন্ট পাওয়াই কষ্টকর। ফলে অভিভাবকদের গলদঘর্ম হতে হয়। এমনকি এজেন্ট না থাকায় এখনো কিছু অভিভাবক নগদ অপারেটর ব্যবহার শুরু করেননি।

গত ২ এপ্রিল প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেসসচিব মোহাম্মদ আবুল কালাম আজাদ মজুমদার তাঁর ফেসবুক পোস্টে লেখেন, সরকার স্কুলের ছাত্রীদের উপবৃত্তির টাকা দিচ্ছে অনেক বছর ধরেই। গ্রামের অনেক সহজ-সরল মানুষ বিষয়টা জানেই না। আর এর সুযোগ নিচ্ছেন কিছু দুর্নীতিবাজ শিক্ষক। ছাত্রীর অভিভাবকের বদলে তাঁরা নিজের মোবাইল ফোনে উপবৃত্তির টাকা নিচ্ছেন। তারপর অনায়াসে টাকাটা মেরে দিচ্ছেন।

উপ-প্রেসসচিব আরো লেখেন, আমার পাশের গ্রামে একটা বালিকা বিদ্যালয় আছে। এ ধরনের অপকর্ম ধরা পড়ার পর এক শিক্ষিকা দাবি করছেন, ছাত্রীরা স্বেচ্ছায় স্কুলের উন্নয়ন তহবিলে এ টাকা দান করেছে। উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তাকে তদন্ত করে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করে এসেছি।

প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচির স্কিম পরিচালক মোহাম্মদ আসাদুল হক কালের কণ্ঠকে বলেন, আমাদের কাজ ডিজিটালি টাকা ট্রান্সফার করা। আমরা কারো হাতে টাকা দিই না। এরপর যদি কোনো অনিয়ম হয় সেটা সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো দেখবে।

নগদের মাধ্যমে উপবৃত্তি বিতরণের ব্যাপারে তিনি বলেন, আসলে এটা সরকারের সিদ্ধান্ত। শিক্ষা মন্ত্রণালয়, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয় এবং নগদ লিমিটেডের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে। তবে এই চুক্তির মেয়াদ আগামী ৩০ জুন পর্যন্ত। এরপর এ ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেবে।    

যারা উপবৃত্তি বিতরণ করবেন, তাঁদের অবস্থা যখন এমন, তখন কিছু শিক্ষক ও শিক্ষা কর্মকর্তাও অনিয়মে জড়িয়ে পড়েছেন। নেত্রকোনার বারহাট্টা উপজেলার হরিয়াতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপবৃত্তিপ্রাপ্ত ৬৭ শিক্ষার্থীর মোবাইল অ্যাকাউন্ট নম্বর পরিবর্তনের ঘটনায় গত ২২ এপ্রিল উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সিরাজুল ইসলামকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার ২৭টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের উপবৃত্তিপ্রাপ্ত ৯৬৭ শিক্ষার্থীর মোবাইল অ্যাকাউন্ট নম্বর পরিবর্তনের ঘটনায় উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রফিকুল ইসলামকেও গত ২২ এপ্রিল সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।

প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু নূর মো. শামসুজ্জামান কালের কণ্ঠকে বলেন, উপবৃত্তিতে অনিয়মের ব্যাপারে আমরা জিরো টলারেন্সে আছি। যাঁদের ব্যাপারে অভিযোগ এসেছে, সেগুলো তদন্ত করা হয়েছে এবং কয়েকজন শিক্ষক ও কর্মকর্তাকে বরখাস্তও করা হয়েছে।

গত বছর সাতক্ষীরার তালা ফাজিল ডিগ্রি মাদরাসার অধ্যক্ষ আবুল ফজল মো. নুরুল্লাহর বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা আত্মসাৎসহ একাধিক অনিয়মের অভিযোগ ওঠে। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ, তারা উপবৃত্তির টাকা পাওয়ার কথা থাকলেও অধ্যক্ষ প্রতারণার মাধ্যমে তাদের উপবৃত্তির সিম নিজের কাছে রেখে টাকা আত্মসাৎ করেছেন। ঘটনার সত্যতা পেয়ে মাদরাসা পরিচালনা কমিটি অভিযুক্ত অধ্যক্ষকে সাময়িক বরখাস্ত করে।

সূত্র জানায়, নগদ ফিন্যানশিয়াল এজেন্ট হলেও তাদের মূল কাজ হলো উপবৃত্তি বিতরণ। এরই মধ্যে তাদের প্রায় দুই হাজার ৩৫৬ কোটি টাকার দুর্নীতি ও পাচারের প্রাথমিক সত্যতা পেয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। গত ১২ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনানীতে নগদের কার্যালয়ে অভিযান পরিচালনা করে দুদক। অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা জানান, নগদের বিরুদ্ধে ৬৪৫ কোটি টাকার অতিরিক্ত ই-মানি তৈরি এবং এক হাজার ৭১১ কোটি টাকার তহবিল সরিয়ে নেওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে এ অভিযান চালায় দুদক। সেই অভিযানের টিম লিডার মো. রুহুল হক জানিয়েছিলেন, নগদের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ রয়েছে, তার প্রাথমিক সত্যতা আমরা পেয়েছি।

জানা যায়, নগদের সিকিউরিটি দুর্বলতা, কম্পানির এজেন্টদের সংশ্লিষ্টতার কারণে উপবৃত্তির টাকা শিক্ষার্থীদের অ্যাকাউন্টে পৌঁছানোর আগেই হাওয়া হয়ে যায়। যশোরের শার্শায় বেশ কিছু সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তির টাকা তাদের হাতে আসার আগেই তা হাতিয়ে নিয়েছে প্রতারকচক্র। রাজশাহীর পবা উপজেলার বেড়পাড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, দামকুড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, মুরারীপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, চর নবীনগর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা প্রতারণার শিকার হয়েছেন। এসব স্কুলের ৩৫ থেকে ৪০ জনের বেশি শিক্ষার্থীর মা-বাবার অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে নিয়েছে প্রতারকচক্র। শুধু যশোর বা রাজশাহী নয়, সারা দেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়গুলোর উপবৃত্তির টাকার অবস্থা প্রায় একই।

বিধি অনুযায়ী প্রতি মাসে ৮৫ শতাংশ উপস্থিতি ছাড়া প্রাথমিকের কোনো শিক্ষার্থী উপবৃত্তি পাবে না। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পিটিআই-সংলগ্ন পরীক্ষণ বিদ্যালয় এবং শিশু কল্যাণ ট্রাস্ট পরিচালিত প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ থেকে অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের বার্ষিক পরীক্ষায় পেতে হবে ৪০ শতাংশ নম্বর। এ ক্ষেত্রে বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিক্ষার্থীর জন্য ন্যূনতম ৩৩ শতাংশ নম্বর পাওয়ার বাধ্যবাকতা রয়েছে।

প্রাথমিক শিক্ষা উপবৃত্তি কার্যক্রম বাস্তবায়ন নির্দেশিকায় এসব বিধান থাকলেও এত দিন মানা হয়নি। ফলে কিন্ডারগার্টেন ও মাদরাসা শিক্ষার্থীরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে নাম লিখিয়ে ক্লাস না করেও উপবৃত্তি পাওয়ার ঘটনা ঘটছে। আবার অনেক শিক্ষক তাঁদের ইচ্ছামতো নাম দিয়ে নিজেরাই উপবৃত্তির টাকা তুলে নিচ্ছেন।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ডা. বিধান রঞ্জন রায় পোদ্দার বলেন, শিক্ষার্থীরা যত টাকাই পাক, ব্যয়টা কিন্তু কম না। কিন্তু এটি যে উদ্দেশে করা হয়েছে, সেখানে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জিত হচ্ছে না। উপবৃত্তির জন্য প্রাথমিক স্কুলে শিক্ষার্থীদের নাম থাকে; কিন্তু তারা অন্য স্কুলে অধ্যয়ন করছে।

জানা যায়, বর্তমানে প্রাথমিকে উপবৃত্তি পাচ্ছেন প্রায় এক কোটি ৪০ লাখ শিক্ষার্থী। সিটি করপোরেশন ও পৌর এলাকার স্কুল ছাড়া সব সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিশুদেরই উপবৃত্তি দেওয়া হয়। প্রাক-প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা মাসে ৭৫ টাকা, প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা মাসে ১৫০ টাকা করে উপবৃত্তি পায়।

অন্যদিকে ষষ্ঠ থেকে স্নাতক পর্যায়ে উপবৃত্তি আগে মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের একটি প্রকল্প থেকে দেওয়া হতো। তবে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সব উপবৃত্তি প্রধানমন্ত্রীর শিক্ষা সহায়তা ট্রাস্টের মাধ্যমে সমন্বিত উপবৃত্তি কর্মসূচির আওতায় নিয়ে আসা হয়। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ষষ্ঠ থেকে স্নাতক পর্যায়ে ৬০ লাখ ৭১ হাজার শিক্ষার্থীর উপবৃত্তির অর্থ ছাড় হয়েছে। মাধ্যমিক পর্যায়ের শিক্ষার্থীরা মাসে ২০০ টাকা হারে উপবৃত্তি পায়। এর সঙ্গে বছরের শুরুতে কিছু শিক্ষাসামগ্রী কেনার জন্য আরো কিছু অর্থ পায়। এক পরিবারের সর্বোচ্চ দুজন উপবৃত্তি পেয়ে থাকে।