
দেশে সামগ্রিক দারিদ্র্য বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি সত্ত্বেও অজ্ঞাত কারণে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় খাদ্য বিতরণ এবং ভর্তুকিমূল্যে খাদ্যপণ্য বিক্রি কমেছে। এতে নিম্নআয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি বেড়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকারের উচিত নিম্নআয়ের মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি বাড়ানো।
টিসিবি সূত্রে জানা যায়, এক কোটি ফ্যামিলি কার্ডধারী নিম্নআয়ের পরিবারের মধ্যে বর্তমানে ৪৯ লাখের কিছু বেশি কার্ড সচল আছে। বাকি ৫১ লাখ কার্ড বিভিন্ন অনিয়মের কারণে স্থগিত রয়েছে। জেলা প্রশাসকরা তথ্য হালনাগাদ করলে সেগুলো সক্রিয় হবে। তবে কবে তথ্য হালনাগাদ হবে তা অনেকটাই অনিশ্চিত। এছাড়া চলতি বছরের ২৮ মার্চের আগে টিসিবি সপ্তাহে ছয়দিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ৫০, চট্টগ্রামে ২০, অন্যান্য বিভাগীয় শহরগুলোতে ১০ এবং ৫৬ জেলা শহরে ৫টি করে ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে বিক্রি করত। প্রতিটি ট্রাকে ৪০০ জনের পণ্য হিসাব করে প্রতিদিন ৪১০টি ভ্রাম্যমাণ ট্রাকে করে এক লাখ ৬৪ হাজার মানুষের কাছে ভর্তুকি মূল্যে পণ্য বিক্রি করত ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। চলতি বছরের ২৮ মার্চ থেকে সেই কর্মসূচিও বন্ধ রয়েছে।
চলতি অর্থবছরের মে পর্যন্ত খাদ্য ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়সহ সরকারি সংস্থাগুলো প্রায় ২৬ লাখ ৩২ হাজার টন খাদ্যশস্য বিতরণ করেছে। এটি আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ কম।
খাদ্য মন্ত্রণালয়ের সূত্র বলছে, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের দুস্থদের খাদ্য সহায়তা (ভিজিএফ) ও দুস্থ মহিলা উন্নয়ন (ভিজিডি) কর্মসূচির আওতায় স্বল্প আয়ের মানুষের মধ্যে খাদ্য বিতরণও কমেছে। চলতি অর্থবছরের মে নাগাদ এফডব্লিউপি কর্মসূচির আওতায় খাদ্য বিতরণ আগের অর্থবছরের তুলনায় ৬৩ দশমিক ২০ শতাংশ কমে ৫৯ হাজার ৭৩৬ টনে নেমেছে। আর ভিজিএফ কর্মসূচির আওতায় বিতরণ ১১ দশমিক ৫৬ শতাংশ কমে এক লাখ ৫৩ হাজার টন হয়েছে। ভিজিডি কর্মসূচির ক্ষেত্রে খাদ্য বিতরণ আগের বছরের তুলনায় ৪০ দশমিক ২৬ শতাংশ কমে এক লাখ ৮৭ হাজার টনে দাঁড়িয়েছে।
পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরকারি সংস্থাগুলোর ভর্তুকিমূল্যে নিত্যপণ্য বিক্রি ও বিতরণ চলতি অর্থবছরের জুলাই-মে সময়ে গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে কমেছে। এটি দেশের অনেক স্বল্প আয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা বাড়িয়ে দিতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। কেননা, দেশে টানা ২৬ মাস ধরে সামগ্রিক মূল্যস্ফীতি নয় শতাংশের ওপরে রয়েছে। এরপরও চাকরি হারানো ও ধীর অর্থনীতির কারণে বিশ্বব্যাংকে এপ্রিল মাসেই পূর্বাভাস দিয়েছিল যে, ২০২৫ সালে বাংলাদেশের সামগ্রিক দারিদ্র্য বেড়ে ২২ দশমিক নয় শতাংশ হতে পারে, যা ২০২২ সালে ছিল ১৮ দশমিক ৭ শতাংশ।
প্রতিবেদনে বিশ্বব্যাংক বলেছে, চরম দারিদ্র্যসীমার নিচে থাকা মানুষের সংখ্যা (দৈনিক সোয়া দুই ডলারের নিচে আয়) প্রায় দ্বিগুণ হয়ে নয় দশমিক তিন শতাংশ হতে পারে। এ ছাড়া বাংলাদেশে এ বছর আরো ৩০ লাখ মানুষ ‘অতিদরিদ্র’ হবে বলে আশঙ্কা বিশ্বব্যাংকের।
এ বিষয়ে সিসিডি বাংলাদেশের পরিচালক (অবৈতনিক) গোলাম মর্তুজা বলেন, মূল্যস্ফীতি, ধীর অর্থনীতির কারণে এমনিতেই কম আয়ের মানুষেরা চাপের মুখে রয়েছে। এরপর আবার সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার খাদ্য সহায়তার কর্মসূচি সংকুচিত হওয়ায় নিম্নআয়ের মানুষের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার ঝুঁকি আরো বেশি বেড়ে যেতে পারে। তিনি আরো বলেন, সার্বিক দিক বিবেচনায় নিয়ে সরকারের উচিত নিম্নআয়ের মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা কর্মসূচি বাড়ানো। আর সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির আওতায় খাদ্য বিতরণে যেসব কর্মসূচি আগে থেকে চালু রয়েছে সেগুলোকে আরো বেশি সক্রিয় করা।
গোলাম মর্তুজার মতে, সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকারের উচিত খাদ্য বিতরণ বাড়ানো ও টিসিবির ট্রাকের মাধ্যমে ভর্তুকি বিক্রি চলমান রাখা। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে দারিদ্র্যসীমার কাছে থাকা মানুষ এখন দারিদ্র্যসীমার নিচে নেমে যাওয়ার ঝুঁকিতে আছে। অন্যদিকে যারা ইতোমধ্যে দরিদ্র তারা আরো দরিদ্র হয়ে পড়েছেন। এ কারণে ভর্তুকি দামে খাদ্যপণ্য বিতরণ ও বিক্রি দুটোই বাড়ানো উচিত বলেও মনে করেন তিনি।