
দেশের অর্থনৈতিক কাঠামোয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) অত্যন্ত শক্তিশালী স্তম্ভ। কর্মসংস্থান সৃষ্টি, আয়বৃদ্ধি, দারিদ্র্য হ্রাস এবং অর্থনৈতিক বিকাশে এর বড় ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু ব্যাপক সম্ভাবনাময় এ খাত প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে পিছিয়ে পড়ছে। বর্তমানে দেশে এসএমই কোম্পানির সংখ্যা ১ কোটি ১৮ লাখ। এ খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষের। অর্থাৎ শিল্প খাতে কর্মসংস্থানের ৮৭ শতাংশই এ খাতে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, দেশে প্রতিনিয়ত বেকারের সংখ্যা অস্বাভাবিকভাবে বাড়ছে। এর বড়ই অংশই শিক্ষিত বেকার। শিক্ষাজীবন শেষ করে শ্রমবাজারে আসার পর তাদের কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান মিলছে না। বর্তমানে দেশে স্নাতক ডিগ্রিধারী ১০০ জনের মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। ফলে বেকারত্ব নিরসনে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় এ খাতকে ঘিরে সরকারের উদ্যোগ কম। বক্তৃতা-বিবৃতিতে এ খাত নিয়ে অনেক কথা বলা হলেও কার্যকর উদ্যোগ একেবারেই সীমিত।
শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান মনে করেন, এসএমই খাত শুধু ব্যবসা নয়, দেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড। দেশে সত্যিকার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করতে এ খাতের উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। তিনি বলেন, এসএমই উদ্যোক্তারা তাদের লাভের ৩০ শতাংশই পুনরায় বিনিয়োগ করেন, যা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে।
এসএমই হচ্ছে ক্ষুদ্র ও মাঝারি আকারের উদ্যোগ বা ব্যবসা। এই উদ্যোগে কর্মী এবং রাজস্বের পরিমাণ নির্দিষ্ট সীমার নিচে। বিশ্বের কোম্পানিগুলোর ৯০ শতাংশ এবং মোট কর্মসংস্থানে ৫০ শতাংশের বেশি এসএমই খাতে। এ কারণে বিশ্বব্যাংক, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এসএমইকে ব্যাপক গুরুত্ব দিচ্ছে। এসএমই নিয়ে তাদের আলাদা নীতিমালা রয়েছে। বর্তমানে ইউরোপীয় ইউনিয়নে ব্যবসার ৯৯ শতাংশ এবং অস্ট্রেলিয়ার ৯৮ শতাংশ এসএমই। তবে এ খাতে রয়েছে তহবিল সংকট। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ২০২১ সালের গ্লোবাল ফিনডেক্স ডাটাবেজ অনুসারে, আনুষ্ঠানিক, নারী-মালিকানাধীন এসএমইর জন্য ১ দশমিক ৭ ট্রিলিয়ন ডলারের তহবিল ঘাটতি রয়েছে। এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুসারে বর্তমানে দেশে এ শিল্পের সংখ্যা ১ কোটি ১৮ লাখ। আর এ খাতে কর্মসংস্থান হয়েছে ৩ কোটি ৬০ লাখ মানুষের। অর্থাৎ শিল্প খাতে দেশে কর্মসংস্থানের ৮৭ শতাংশই এ খাতের। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুসারে ২০২৪ সালের প্রথম প্রান্তিকে দেশে বেকারের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২৫ লাখ ৯০ হাজার। আগের বছর অর্থাৎ ২০২৩ সালের শেষ প্রান্তিকে এ সংখ্যা ছিল ২৩ লাখ ৫০ হাজার। অর্থাৎ ৩ মাসের ব্যবধানে দেশে বেকার বেড়েছে ২ লাখ ৪০ হাজার জন। এছাড়াও বর্তমানে দেশে ১০ জন স্নাতক ডিগ্রিধারীর মধ্যে ৪৭ জনই বেকার। প্রতিবছর ২২ লাখ কর্মক্ষম ব্যক্তি শ্রমবাজারে আসে। এর মধ্যে ১৩-১৪ লাখ দেশের বিভিন্ন খাতে যুক্ত হয়। অল্প কিছু বিদেশেও যায়। এরপরও প্রায় ১০ লাখ লোক নিজেদের জন্য শোভন কাজের ব্যবস্থা করতে পারে না। বিবিএস বলছে, এই ২২ লাখ লোকের মধ্যে ১০ শতাংশ অর্থাৎ ২ লাখ ২০ হাজার লোক উদ্যোক্তা হিসাবে তৈরি হলে দেশে অর্থনৈতিক সমস্যার সমাধান হতো। অন্যদিকে দেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কাঙ্ক্ষিত অবদান রাখতে পারছে না এসএমই। ২০২১-২২ অর্থবছরে জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ছিল ৭ দশমিক ৩৫ শতাংশ। অন্যদিকে পাকিস্তানে এই হার ৪০ শতাংশ, শ্রীলংকায় ৫২, চীনে ৬০ আর ভারতে ৩৭। অর্থাৎ বাংলাদেশে এই হার দেশের প্রত্যাশার তুলনায় খুবই কম। এ খাতে সম্ভাবনাময় পণ্যের মধ্যে রয়েছে-হস্তশিল্প, চামড়া, কৃষিভিত্তিক পণ্য এবং হালকা প্রকৌশলপণ্য। এসব পণ্য ইতোমধ্যে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। যা দেশের রপ্তানিতে বৈচিত্র্য আনছে। এছাড়াও ই-কমার্স ও ডিজিটাল পেমেন্ট ব্যবস্থার প্রসারে এসএমই খাতে প্রযুক্তির ব্যবহার কিছুটা বাড়ছে।
বাংলাদেশি উদ্যোক্তাদের মতে, এসএমই খাতের বিকাশে পাঁচ ধরনের সমস্যা রয়েছে। এগুলো হলো-অর্থায়নের অভাব, আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার সীমিত, অবকাঠামো সমস্যা, বাজারে প্রতিযোগিতা বেশি এবং ব্যবস্থাপনা দক্ষতার ঘাটতি। এছাড়াও স্থান এবং কালভেদে নিরাপত্তা ও চাঁদাবাজির মতো সমস্যাও রয়েছে।
ঢাকায় আরকে ফ্যাশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক কবির উদ্দিন আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, পাঁচ বছর হলো সীমিত পরিসরে ব্যবসা শুরু করেছি। শুরুতেই নানা চ্যালেঞ্জ ছিল। এখন কিছুটা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হয়েছে। বিশেষ করে অর্থায়ন বড় সমস্যা। ব্যাংকগুলো নতুন উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে চায় না। এছাড়াও উৎপাদিত পণ্য বাজারজাতকরণে সমস্যা আছে। কর, লাইসেন্সিং, নিবন্ধন প্রক্রিয়া অনেক জটিল ও সময়সাপেক্ষ। এর ফলে উদ্যোক্তারা নিরুৎসাহিত হয়। বিদ্যুৎ, সড়ক, লজিস্টিক সাপোর্ট ইত্যাদির সীমাবদ্ধতা অনেক সময় উৎপাদন ব্যাহত করে। তিনি বলেন, সরকার সহায়তা দিলে এ খাত এগিয়ে যাবে।
সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, এসএমই খাত শ্রমঘন শিল্প। এটি দেশের জন্য সম্ভাবনায়। এতে কর্মসংস্থান বাড়ে। তবে এ খাতে বৈচিত্র্য আনতে উদ্ভাবন জরুরি। এক্ষেত্রে সরকারকে প্রয়োজনীয় পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। ঋণ সহায়তা এবং পণ্য বাজারজাতকরণে সহায়তা দিতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ ২০২৪ সালের শেষ প্রান্তিক (অক্টোবর-ডিসেম্বর) পর্যন্ত ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো মোট ২ লাখ ৮২ হাজার ৮৯৬ কোটি টাকা সিএসএমই ঋণ বিতরণ করেছে। যা মোট ঋণের ১৯ দশমিক ১৪ শতাংশ। গ্রাহক প্রতি এসএমই ঋণের পরিমাণ ১ লাখ টাকা থেকে সর্বোচ্চ ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত। চলতি বছরের মার্চে একটি নতুন মাস্টার সার্কুলার জারি করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। সেখানে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে ২০২৯ সালের মধ্যে তাদের মোট ঋণের কমপক্ষে ২৭ শতাংশ সিএমএসএমই খাতে বরাদ্দ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়েছে। এক্ষেত্রে উদ্যোগের কথা বলা হলেও বাস্তবায়ন কম। ফলে সম্ভাবনার বিপরীতে এ খাত পিছিয়ে পড়ছে।
এসএমই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপারসন মো. মুসফিকুর রহমান যুগান্তরকে বলেন, অত্যন্ত সম্ভাবনাময় এ খাতের উন্নয়নে নীতি সহায়তা এবং বাজেটে বিশেষ বরাদ্দ প্রয়োজন। তিনি বলেন, এ খাতের উন্নয়নে আমরা কাজ করছি। আগামী অর্থবছরের বাজেটকে সামনে রেখে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে ইতিমধ্যে ১৪০টি প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এছাড়া এসএমইবান্ধব ব্যবসার পরিবেশ সৃষ্টি ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন, গবেষণা ও পলিসি অ্যাডভোকেসি, ক্লাস্টার উন্নয়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, আইসিটি সহায়তা, দক্ষতা উন্নয়ন, নারী-উদ্যোক্তা উন্নয়ন, সহজ শর্তে অর্থায়নসহ বিভিন্ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে ফাউন্ডেশন। এসব কার্যক্রমের সরাসরি সুবিধাভোগী প্রায় ২ লাখ এবং পরোক্ষ সুবিধাভোগী প্রায় ২০ লাখ উদ্যোক্তা। তবে তিনি স্বীকার করেন ২০২৪ সালের অর্থনৈতিক জরিপ-অনুসারে দেশের ১ কোটি ১৮ লাখ উদ্যোক্তার তুলনায় এই হার খুবই কম।
এসএমই ফাউন্ডেশনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আনোয়ার হোসেন চৌধুরী বলেন, বিশ্বের অন্যান্য দেশের বাংলাদেশে জিডিপিতে এখাতের অবদান অনেক কম। এমনকি প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায়ও পিছিয়ে বাংলাদেশ। তবে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই অবদান বাড়ানো জরুরি। তিনি বলেন, এসএমই খাত শ্রমঘন শিল্প। এ খাত বিকাশে কর্মসংস্থান বাড়ে। একই সঙ্গে দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধি পায়।
অর্থনীতিবিদ ও সংশ্লিষ্টরা এ খাতের উন্নয়নে বেশ কিছু সুপারিশ করেছেন। এর মধ্যে রয়েছে-সহজ শর্তে জামানতবিহীন ঋণ প্রদান ও সরকারের ভর্তুকি বাড়ানো। দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণ ও প্রযুক্তি সহায়তা, ই-কমার্স ও ডিজিটাল মার্কেটপ্লেসে এসএমইকে সংযুক্ত করা, কর কাঠামো ও লাইসেন্সিং প্রক্রিয়া সহজ করা এবং স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশে সহায়তায় প্রদর্শনীর আয়োজন করা।