Image description

১০ মাস পার করার আগেই মারাত্মক সংকটের মধ্যে পড়েছে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার। সংকটটা এমন পর্যায়ে গেছে যে, প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের ভাবনার কথাও প্রকাশ পেয়েছে। আর ড. ইউনূসের পদত্যাগের ভাবনায় সরকারও নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।

এদিকে ১০ মাস না যেতেই অন্তর্বর্তী সরকার কেন এই সংকটে পড়লো তা নিয়েও জনমনে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তবে এই সংকটের জন্য রাজনৈতিক চাপকেই প্রধান কারণ হিসেবে মনে করা হচ্ছে। এই রাজনৈতিক চাপ তৈরির জন্য অন্তর্বর্তী সরকার নিজেই দায়ী। আর সেটি হলো নির্বাচন প্রশ্নে সরকারের দৃশ্যমান পদক্ষেপ না থাকা বলে অনেকে মনে করেন।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটে। এরপর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়। এই অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান দায়িত্ব একটি সুষ্ঠু নির্বাচন ব্যবস্থা করা। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের অভিযোগ, সরকার সেদিকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে নজর দিচ্ছে না। যদিও প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর অথবা আগামী বছরের জুনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু সরকারের এই বক্তব্যে রাজনৈতিক দলগুলো আশ্বস্ত হতে পারছে না। কারণ এখন পর্যন্ত সরকার নির্বাচনের রোডম্যাপ ও সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করেনি। সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রধান এবং সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি দীর্ঘদিন ধরেই নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ও রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি করে আসছে। কিন্তু সরকারের দিক থেকে এ ব্যাপারে কোনো পদক্ষেপ এখনো দৃশ্যমান নয়। এর মধ্যেই সংকটে পড়লো অন্তর্বর্তী সরকার। আর অন্তর্বর্তী সরকারের এই সংকট তখনই তৈরি হলো যখন রাজপথের কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলনে নামে বিএনপি।

বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) মেয়র পদে শপথ পড়ানোর দাবিতে টানা আটদিন ধরে আন্দোলন চলে। বৃহস্পতিবার (২২ মে) অন্তর্বর্তী সরকারকে ৪৮ ঘণ্টা আল্টিমেটাম দিয়ে এই আন্দোলন আপাতত স্থগিত করা হয়েছে। এদিন ইশরাককে মেয়র ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশনের দেওয়া গেজেটের বৈধতা নিয়ে এবং তাকে শপথ পড়ানো থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা চেয়ে করা রিট খারিজ করে দেন হাইকোর্ট।

এদিকে গত কয়েকদিন ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী এবং ছাত্রদল নেতা শাহরিয়ার আলম সাম্য হত্যার বিচার ও হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের গ্রেপ্তার করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবিতে গত কয়েকদিন ধরে শাহবাগে অবস্থান কর্মসূচি দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে আসছে ছাত্রদল। বৃহস্পতিবার অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করা হলেও দ্রুত দাবি আদায় না হলে আগামীতে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণার হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।

এর আগের দিন বুধবার সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বাহিনীর কর্মকর্তাদের নিয়ে এক বৈঠকে নির্বাচন, রাখাইনের জন্য মানবিক করিডোর প্রসঙ্গ এবং মব সৃষ্টিসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন। বৈঠকে সেনাবাহিনী প্রধান চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন। রাখাইনের মানবিক করিডোরবিষয়ক সিদ্ধান্ত একটি নির্বাচিত সরকারের থেকে আসতে হবে এবং তা বৈধ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে হতে হবে বলে তিনি জানিয়েছেন।

বিভিন্ন সূত্র থেকে গণমাধ্যমে এ বিষয়গুলো এসেছে।

এই প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার রাতে শোনা যায়, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করার কথা ভাবছেন। এদিন সকালে উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তিনি তার এই ভাবনার কথা জানান। পরে রাতে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামও তার সঙ্গে সাক্ষাতের পর গণমাধ্যমকে ড. ইউনূসের পদত্যাগের ভাবনার কথা জানান।

সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, পদত্যাগের কারণ হিসেবে ড. ইউনূস বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী চাপ, অনৈক্য, নানা ইস্যুতে তার বাসভবন ঘিরে আন্দোলন, তার বিরুদ্ধে দেশ বিক্রির অভিযোগ, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য বিএনপির অব্যাহত চাপ, বিভিন্ন দাবিতে একের পর এক আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে জিম্মি করার চেষ্টা ইত্যাদি কারণে তিনি আর দায়িত্ব পালন করতে চান না। উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে তিনি এ বিষয়গুলো তুলে ধরেছেন।

যদিও শুক্রবার (২৩ মে) প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক মন্ত্রণালয়) ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানিয়েছেন, প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করবেন না।  

তিনি বলেন, অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ক্ষমতা প্রয়োজন নেই, কিন্তু বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ ডেমোক্রেটিক ট্রানজিশনের (গণতান্ত্রিক রূপান্তর) জন্য ড. ইউনূস স্যারের দরকার আছে।

অন্তর্বর্তী সরকারকে এই ধরনের সংকটে পড়ার প্রধান কারণ দ্রুত নির্বাচনকে অগ্রাধিকার না দিয়ে অন্য বিভিন্ন কাজে জড়িয়ে পড়া, যা এই সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না বলে রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা মনে করছেন।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাসদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হক প্রধান বাংলানিউজকে বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার অনেক লোড কাঁধে নিচ্ছে, যা তাদের নেওয়ার কথা ছিল না। হত্যাকাণ্ডের বিচার হোক এটা মানুষ চায়। কিন্তু সব ধরনের কাজ হাতে নিয়েছে। সংস্কার, বন্দর ব্যবস্থাপনা বিদেশিদের হাতে দেওয়া, রাখাইনের করিডোর দেওয়াসহ বিভিন্ন কাজে হাত দিয়েছে। ক্ষমতায় পাঁচ বছর থাকতে চায় এ রকম কথাও শোনা যাচ্ছে। অথচ এত লোড নেওয়ার কথা ছিল না। এ কারণে সংকটগুলো তৈরি হচ্ছে।

এদিকে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ বিএনপির কোনো দাবি নয় বলে জানিয়েছেন দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ। তিনি বলেছেন, এটি সম্পূর্ণ ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত বিষয়। আমরা (বিএনপি) কখনও তার পদত্যাগ দাবি করিনি। নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা না করে যদি তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দিতে চান, সেটিও তার ব্যক্তিগত ব্যাপার।

বিএনপির এই গুরুত্বপূর্ণ নেতার বক্তব্য থেকে এটাই স্পষ্ট হয় যে, বিএনপির প্রধান দাবি নির্বাচনের রোডম্যাপ। দলটি প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ না চাইলেও এই বছরের মধ্যে নির্বাচনের জন্য রোডম্যাপ ঘোষণা না করলে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি তাদের অব্যাহত সমর্থন আর না থাকার সম্ভাবনাই বেশি।

এদিকে অন্তর্বর্তী সরকারের যে উপদেষ্টারা একটি নতুন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত তাদের অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে বিএনপি। একইসঙ্গে সরকারের ভাবমূর্তি রক্ষার্থে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানকেও অব্যাহতি দেওয়ার দাবি জানিয়েছে দলটি ৷ বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলন করে দলটির পক্ষ থেকে এ দাবি জানানো হয়। সবমিলিয়ে অন্তর্ভুক্তি সরকারের ওপর থেকে বিএনপির সমর্থন উঠে যাওয়ার আশঙ্কাই জোরালো হচ্ছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টাদের মধ্যেও এ ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে বলে গুঞ্জন রয়েছে। বিএনপির সমর্থন না থাকলে এই সরকারকে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন বলেই তারা মনে করছেন। আর বিএনপি শুধু একা নয়, এই দলটির সঙ্গে ডান বাম অনেক রাজনৈতিক দলও রয়েছে। সরকার সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। এই পরিস্থিতিতে ড. ইউনুসের পদত্যাগের ভাবনায় সরকার নড়বড়ে হয়ে পড়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের পানিসম্পদ এবং পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের বক্তব্যের মধ্য দিয়েও সরকারের চিন্তিত হওয়ার একটি ইঙ্গিত উঠে এসেছে। তিনি বলেছেন, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন, এর বাইরে একদিনও এদিক-সেদিক যাওয়ার সুযোগ নেই।

শুক্রবার (২৩ মে) দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নবাব নওয়াব আলী চৌধুরী সিনেট ভবনে এক অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ কথা বলেন।

রিজওয়ানা হাসান বলেন, বৃহস্পতিবার উপদেষ্টা পরিষদের সভার পর অনেক সময় আমরা আলোচনা করেছি। আমাদের তিনটি কঠিন দায়িত্ব- একটি সংস্কার, অন্যটি বিচার, আরেকটি নির্বাচন। শুধু নির্বাচন করার জন্য আমরা দায়িত্বটা নেইনি। আমাদের আরও দুটি দায়িত্ব রয়েছে। কিন্তু আমরা সেগুলো পালন করতে পারছি না।