Image description

রাজনীতির আকাশে জমে ওঠা কালো মেঘ কেটে গেছে। ঝড়, সাইক্লোন বা টর্নেডোর মতো মহা-বিপদের আশঙ্কা আপাতত আর নেই। এখন সোনালি রোদমাখা এক ঝলমলে ভোরের প্রত্যাশা সবার। গত সপ্তাহজুড়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে যে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির তৈরি হয়েছিল তা দূরীভূত হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ রাষ্ট্রের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ অংশীজন বা প্রতিষ্ঠানের সাথে আলোচনার মাধ্যমে উদ্ভূত পরিস্থিতির অবসান হয়েছে বলে বিভিন্ন বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগ নিয়ে যে গুঞ্জন ও গুজব ছড়ানো হচ্ছিল তার স্পষ্ট জবাব ইতোমধ্যে দিয়েছেন তার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়ব। গতকাল তার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে দেয়া এক স্ট্যাটাসে তিনি বলেন, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার পদ থেকে ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করবেন না। ড. ইউনূসের ‘ক্ষমতা প্রয়োজন নেই’ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘কিন্তু বাংলাদেশের জন্য, বাংলাদেশের শান্তিপূর্ণ ডেমোক্রেটিক ট্রাঞ্জিশনের জন্য ড. ইউনূস স্যারের দরকার আছে।’

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারীর এই স্ট্যাটাসে শান্তিপূর্ণভাবে গণতন্ত্রের পথে উত্তরণের স্পষ্ট ইঙ্গিত রয়েছে। আর সেটি হচ্ছে দ্রুত জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করা। অন্তর্বর্তী সরকার তথা প্রধান উপদেষ্টা সে পথেই অগ্রসর হচ্ছেন। সূত্র মতে জানা যায়, গত ২১ মে অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান ওয়াকার-উজ-জামান যে বক্তব্য দিয়েছেন সেটি আমলে নিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। সেনাপ্রধান সেখানে বলেছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হওয়া উচিত। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, তার ওই বক্তব্য জন-আকাক্সক্ষার প্রতিফলন। অন্যদিকে দেশের প্রধান ও বৃহৎ রাজনৈতিক দল বিএনপি ও তার সমমনা দলগুলোর একমাত্র দাবি আগামী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন। এ ছাড়া বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কটও চরম আকার ধারণ করছে। অর্থ উপদেষ্টা নিজেই এ বিষয়টি স্বীকার করে বলেছেন, অর্থনীতি নিয়ে আমরা নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে আছি। রাজনৈতিক এই টানাপড়েনে ব্যবসায়ীরা খুবই ক্ষতিগ্রস্ত ও উদ্বিগ্ন। তারা দ্রুত এর সমাধান চান। ব্যবসায়ীরা মনে করেন, দেশের চলমান অর্থনৈতিক দুরবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটি নির্বাচিত সরকার জরুরি। এসব কিছু বিবেচনা করে প্রধান উপদেষ্টা শিগগিরই সুনির্দিষ্ট তারিখসহ নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করবেন। তার আগে তিনি সব রাজনৈতিক দলের সাথে বৈঠক করবেন। এ ছাড়া আসছে ঈদে শুভেচ্ছা বিনিময়ের জন্য প্রধান উপদেষ্টা বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার বাসায়ও যেতে পারেন। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, লন্ডনে চিকিৎসা নিয়ে দেশে ফিরে আসা বেগম খালেদা জিয়াকে তার বাসায় দেখতে যাওয়াটা যেমন রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বহিঃপ্রকাশ ঘটবে, তেমনি তার সাথে একান্তে আলোচনার মাধ্যমে চলমান সঙ্কট উত্তরণের একটি উত্তম দিকনির্দেশনাও পাওয়া যাবে।

 

সরকারের পক্ষ থেকে আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে যে নির্বাচনের কথা বলা হচ্ছে, তাতে আশ্বস্ত হতে পারছে না বিএনপিসহ তার মিত্র দলগুলো। তার চায় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখসহ একটি রোডম্যাপ। বিএনপিসহ অন্য দলগুলোকে আশস্ত করতে এবার সে সুনির্দিষ্ট তারিখসহ নির্বাচনের ঘোষণা ঈদের পর আসতে পারে। একই সাথে বিএনপির সাথে দূরত্ব ঘোচানোরও উদ্যোগ নিতে বিভিন্ন মাধ্যমে আলোচনা চলবে। জানা গেছে, ড. ইউনূস নিজেও দ্রুত নির্বাচন চান। তিনি যে প্রাথমিক রোডম্যাপ ঘোষণা করেছেন, সেটির বাইরে তিনি শুরু থেকে না যাওয়ার সিদ্ধান্তে অনড় ছিলেন। তবে তার উপদেষ্টা পরিষদের দু’-তিনজন উপদেষ্টা যারা জাসদের রাজনীতির সাথে একসময় জড়িত ছিলেন তারাই তাকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখার জন্য নানান পরামর্শ দিয়ে আসছিলেন। এতে করে তিনি কিছুটা বিভ্রান্তিতে পড়েছিলেন। তবে গত ২১ মে সেনাপ্রধানের দেয়া বক্তব্যের পর প্রধান উপদেষ্টা তার আগের সিদ্ধান্তে ফিরে এসেছেন। এখন রাজনৈতিক দলগুলোর চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ডিসেম্বর থেকে ফেব্রুয়ারি প্রথম সপ্তাহের মধ্যেই জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করতে পারেন। তার আগে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে প্রধান উপদেষ্টা তার পরামর্শ নিতে পারেন।

গণ-অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে যাওয়ার ৯ মাসের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকারের সাথে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে এক ধরনের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। গত এক সপ্তাহ ধরে রাজনৈতিক অঙ্গনে নানা ঘটনার উদ্ভব হয়। ঢাকার দক্ষিণে মেয়র পদে ইঞ্জিনিয়ার ইশরাকের শপথ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের নেতা সৌম্য হত্যার প্রতিবাদে রাজধানীতে তীব্র আন্দোলন গড়ে তোলে বিএনপি নেতাকর্মীরা। আদালতের রায় এবং নির্বাচন কমিশনের গেজেট প্রকাশের পরও ইশরাকের শপথ না পড়ানোর জন্য বিএনপির পক্ষ থেকে স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়াকে দায়ী করা হয়। ফলে ইশরাকের পক্ষে মাঠে নেতাকর্মীরা আসিফ মাহমুদ এবং ছাত্রদের প্রতিনিধিত্ব করা আরেক উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের পদত্যাগ চেয়ে রাজপথে অবস্থান নেয়। অন্যদিকে ছাত্রদের রাজনৈতিক দল এনসিপি বিএনপির এই অবস্থানকে চ্যালেঞ্জ করে। তারা পাল্টা কর্মসূচি দিয়ে নির্বাচন কমিশনে বিক্ষোভ করে কমিশন সদস্যদের পদত্যাগ দাবি করে। সেই সাথে বিএনপি সমর্থিত তিন উপদেষ্টারও পদত্যাগ চায় তারা। এই নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে পাল্টাপাল্টি রাজনীতি চলে। এই পরিস্থিতিতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করার জন্য একটি শ্রেণি ওঁৎপেতে থাকে। তারা এ বিষয়টিকে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক মাঠ আরো উত্তপ্ত করে তোলে এবং পাশাপাশি নানান গুজব ও গুঞ্জন ছড়াতে থাকে। এর মধ্যে যারা নির্বাচন চায় না তারই প্রধান উপদেষ্টার পদত্যাগের বিষয়টি অত্যন্ত সুকৌশলে প্রচার করতে থাকে। প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী যখন তার স্ট্যাটাসের মাধ্যমে জানিয়ে দেনÑ প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করছেন না, তখন এই চক্রান্তকারীরা জাতীয় সরকারের সেই পুরোনো ফর্মুলাকে আবার সামনে নিয়ে আসে। তবে ভারতীয় এ দেশীয় এসব এজেন্টদের এমন কৌশল এখন আর কাজ করবে না। প্রধান উপদেষ্টা নিজেই এখন নির্বাচনের তারিখ ঘোষণার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আর এই ঘোষণা সম্ভবত আগামী ঈদের পরপরই আসতে পারে। সরকারের উপদেষ্টাদের বক্তব্য থেকেও এটি এখন স্পষ্ট। যে সব উপদেষ্টা নির্বাচনের বিরুদ্ধে ছিলেন। যারা অন্তত তিন বছর ক্ষমতায় থাকার পক্ষে ছিলেন তারাই এখন বলছেন নির্বাচনের কথা। গতকাল এক উপদেষ্টা বলেছেন, আমাদের প্রধান দায়িত্ব হলো একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন আয়োজন করা। আমরা সে পথেই অগ্রসর হচ্ছি। নির্বাচন আগামী ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যেই হবে। এর কোনো পরিবর্তন হবে না।

বিশিষ্ট রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক প্রফেসর ড. দিলারা চৌধুরী ইনকিলাবকে বলন, ‘ড. মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগ করলেই সব সঙ্কটের সমাধান হয়ে যাবেÑ এটি মনে করার কারণ নেই; বরং সঙ্কট আরো তীব্র হবে। তাই তাকে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার প্রতি দেশবাসীর অনেক আশা-আকাক্সক্ষা রয়েছে। তিনি একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে একটি নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে দায়িত্ব দিয়ে যাবেনÑ এটিই দেশবাসীর প্রত্যাশা। আমি মনে করি, তিনি তাই করবেন।’ বর্তমান সঙ্কট উত্তোরণে বেগম খালেদা জিয়া কোনো ভূমিকা রাখতে পারেন কি-না, জানতে চাইলে দিলারা চৌধুরী বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া এখন গোটা দেশবাসীর আশা-ভরসার প্রতীক। তিনি লন্ডন থেকে চিকিৎসা শেষে দেশে ফিরে এখন সম্পূর্ণ বিশ্রামে আছেন। এই মুহূর্তে প্রধান উপদেষ্টা যদি তার বাসায় দেখা করতে যান তাহলে সেটি হবে রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বহিঃপ্রকাশ। পাশাপাশি তিনি তার সাথে একান্তে আলোচনা করে বর্তমান সঙ্কটের একটি উত্তম সমাধানও পেতে পারেন বলে আমি মনে করি।’

কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নিজের ভেরিফায়েড আইডিতে দেয়া এক পোস্টে বলেছেন, প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস পদত্যাগের ইচ্ছা প্রকাশ করে ‘ভুল করেছেন’। পদত্যাগ করা হবে ড. ইউনূসের ব্যর্থতা, তার জন্য আত্মঘাতী। কোনো ব্যক্তি বা দল নয়, তার উচিত জনগণের ঐতিহাসিক অভিপ্রায়কে সম্মান করা, কোনো দল বা গোষ্ঠীর চাপে বিভ্রান্ত না হয়ে জনগণের ওপর আস্থা রাখা।
শুধু রাজনৈতিক বিশ্লেষকরাই নন, রাজনৈতিক দলগুলো প্রধান উপদেষ্টা পদত্যাগ করুকÑ এমনটি চায় না। এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেন, পদত্যাগ কোনো সমাধান নয়। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে যত দ্রুত নির্বাচন ও নির্বাচিত সরকার হবে ততই অস্থিরতা কমে আসবে। বর্তমানে দেশ রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে দিন পার করছে। সরকার নির্বাচনের পথে যত দ্রুত হাঁটবে তত তাড়াতাড়ি অস্থিরতা মুক্ত হবে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহ উদ্দিন আহমেদ বলেছেন, আমরা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পদত্যাগ চাই না। আমরা আশা করব, তিনি একজন বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্ব, তিনি বিষয়টি অনুধাবন করবেন। অতি শিগগিরই জাতির আকাক্সক্ষা অনুযায়ী ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য একটি রোডম্যাপ তিনি স্পেসিফিক ঘোষণা করবেন।
অন্যদিকে এবি পার্টি গতকাল এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছে, রাষ্ট্রের সম্ভাব্য রাজনৈতিক সঙ্কট ও জটিল পরিস্থিতিতে ড. ইউনূসের পদত্যাগ নয়; বরং আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে সব পক্ষকে সমঝোতামূলক সমাধানে পৌঁছাতে হবে।