
রাজধানীর ঘরে ঘরে এখন সর্দি, জ্বর ও কাশির রোগী বাড়ছে। ঋতু পরিবর্তনের এ সময় হাঁচি-কাশি-জ্বর হচ্ছে অনেকের। সর্দি-জ্বরের সঙ্গে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হচ্ছে। বিশেষ করে কাশি ভোগাচ্ছে সবচেয়ে বেশি। সর্দি ও জ্বর সেরে যাওয়ার পর শরীর ভীষণ দুর্বল হয়ে যাচ্ছে। ঠিকমতো খেতে পারছে না অনেকেই। বিশেষ করে শিশু, বয়স্ক, শ্বাসকষ্টজনিত রোগী এবং যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের বেশি ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে।
আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এমনিতেই ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ মাথাচাড়া দেয়। তার সঙ্গে ঢাকাসহ বিভিন্ন শহরের বায়ুদূষণ পরিস্থিতি আরও খারাপ করে তুলেছে। ফলে শিশু থেকে বয়স্কদের অনেকেই জ্বর এবং টানা শুকনো কাশির প্রকোপে ভুগছেন। রাতে ঘুমানোর সময় সেই কাশির মাত্রা আরও বাড়ছে। কাশির সিরাপ বা অ্যান্টি-অ্যালার্জিক ওষুধেও সহজে তা নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ইন্টারনাল মেডিসিন (রেসপিরেটরি) বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. শামীম আহমেদ মানবজমিনকে বলেন, ঠাণ্ডা জ্বর সর্দি কাশির রোগী বাড়ছে। আবহাওয়া পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে এমনিতেই ভাইরাসঘটিত সংক্রমণ মাথাচাড়া দেয়। হঠাৎ গরম, বিকালে বৃষ্টির কারণে এ ধরনের রোগী তাদের কাছে বেশি আসছে বলে জানান এই চিকিৎসক। বায়ুদূষণের কারণে গত ৩-৫ বছরের তুলনায় এখন এসব রোগী বেশি আসছেন তাদের চেম্বারে। ঠাণ্ডা কাশি দেখা দিলে চিকিৎসকদের পরামর্শ নেয়ার তাগিদ দেন এই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। এসময়ে রোগীকে তরল খাবার, স্যুপ ও শরবত বেশি দেয়ার পরামর্শ দেন তিনি। ভ্যকসিন নেয়াও জরুরি।
চিকিৎসকরা জানান, ঠাণ্ডা থেকে তাপমাত্রা হঠাৎ বেড়ে গেলে গলায় বসে থাকা ভাইরাসগুলো সক্রিয় হয়ে ওঠে। তখন শ্বাসনালির উপরিভাগে সংক্রমণ ঘটে। প্রতি বছরই শীতের পর এই সমস্যা দেখা যায়। এর চিকিৎসার জন্য সাধারণত ডাক্তারের কাছে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না। কিছু উপদেশ মেনে চললে ঘরে বসেই নিজের যত্ন নেয়া যায়। তা ছাড়া কিছু সতর্কতা অবলম্বন করলে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও কমানো যায়। ফ্লু ও সাধারণ সর্দি-কাশির লক্ষণ প্রায় একই রকম। তবে সাধারণ সর্দি-কাশির তুলনায় ফ্লু-এর লক্ষণগুলোর তীব্রতা বেশি হতে পারে এবং সেরে উঠতেও বেশি সময় লাগতে পারে। শিশুদের ক্ষেত্রে কখনো কখনো লক্ষণগুলো বড়দের তুলনায় বেশিদিন ধরে থাকতে পারে। চিকিৎসকরা ঘরে ঘরে দেখা দেয়া সর্দি-জ্বর-কাশি থেকে রক্ষা পেতে মানুষকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিশেষজ্ঞরা জানান, মৌসুম পরিবর্তনের এ সময় জ্বর, কাশি-সর্দির প্রবণতা বেড়ে যাওয়া নতুন কিছু নয়। প্রতিবছরই এমন হয়। তবে এখন বদলে গেছে প্রেক্ষাপট। করোনাভাইরাস মহামারির পর্যায়ে না থাকলেও ভাইরাসটির প্রকোপ রয়ে গেছে। ফলে জ্বর-কাশি মানেই বিভীষিকা। ওদিকে ডেঙ্গুর মৌসুম না হলেও আক্রান্ত ও মৃত্যু থেমে নেই। আর ফ্লু তো দেশের সুপরিচিত সমস্যা। তাই এ সময় জ্বরজারি হলেই সব কারণই মাথায় রেখে প্রয়োজনীয় সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
গত কয়েকদিন রাজধানীর ঢাকা মেডিকেল কলেজ, শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ, শিশু হাসপাতাল ও মুগদা হাসপাতালে বহিঃ ও জরুরি বিভাগে মৌসুমি রোগব্যাধি নিয়ে চিকিৎসা নিতে আসা রোগীর ভিড় দেখা গেছে। চিকিৎসকরা বলছেন, এ সময়টায় শরীর ঋতু পরিবর্তনের সঙ্গে মানিয়ে নিতে গিয়ে মৌসুমি রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। ঋতু পরিবর্তনের কারণে জ্বর, সর্দি-কাশি, শরীর ব্যথা ইত্যাদিকেই মৌসুমি জ্বর ধরা হয়। হাঁচি-কাশি, নাক দিয়ে পানি পড়া, চোখ লাল হয়ে থাকা, সারা শরীরে ব্যথা, মাথা ভার হয়ে থাকা, খাওয়ায় অরুচি, মুখে তিতাভাব ইত্যাদি ভাইরাস জ্বরের লক্ষণ।
সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল ও চিকিৎসকদের ব্যক্তিগত চেম্বারে এ ধরনের রোগীর চাপ বেড়েছে। এর সঙ্গে দেখা দিচ্ছে নিউমোনিয়াও। চিকিৎসকরা এ বছরের সর্দি-জ্বর ও কাশির তীব্রতায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাদের মতে, সাধারণত ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের কারণে সর্দি-জ্বর দেখা দেয়। এ ধরনের সর্দি-জ্বর তিন-চারদিন পর এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। কিন্তু এবার এর সঙ্গে কাশির তীব্রতা বেড়েছে।
বাংলাদেশ শিশু হাসপাতাল ও ইনস্টিটিউটের চিকিৎসক সুমাইয়া লিজা মানবজমিনকে বলেন, তাদের হাসপাতালে সর্দি-জ্বরের রোগী বাড়ছে প্রতিদিন। গত এক মাসে ২০-২৫ শতাংশ রোগী বেড়েছে। ডেঙ্গু রোগী দু-একজন ভর্তি হলেও ভাইরাসজনিত রোগীই বেশি আসছে।
এ ব্যাপারে সরকারের রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) উপদেষ্টা ও সাবেক প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ডা. মুশতাক হোসেন বলেন, এমনি ঠাণ্ডা লাগতে পারে, কাশি হতে পারে, সেটা হলে কমন কোল্ড। ভাইরাসের জন্য নয়। শীতের জন্য, ধুলোবালির জন্য হতে পারে। সেটা হয় ইনফ্লুয়েঞ্জা বা ব্যাকটেরিয়ার কারণে। কিন্তু জ্বর হলে সেটা করোনা বা ডেঙ্গু হতে পারে। এটা জানতে আরটিপিসিআর টেস্ট করলেই হয়। তাই এখন যাদের জ্বর হচ্ছে তাদের কোভিড ও ডেঙ্গু টেস্ট করা দরকার। সর্দি হলেই নাক বন্ধ হয়ে যায়। ছুটি না নিয়ে অফিসে কাজ করতে পারে। কিন্তু জ্বর হলে শরীর দুর্বল হয়ে গেলে, তাকে কোভিড টেস্ট করতে হবে।