
অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব, নীতিগত মতবিরোধ ও ভূ-রাজনৈতিক কৌশলগত অবস্থানের জেরে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দীনকে শেষ পর্যন্ত সরে যেতে হল। তিনি সকল দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি নিয়েছেন বলে গতকাল বৃহস্পতিবার মন্ত্রণালয়ের এক আদেশে জানানো হয়। মন্ত্রণালয়ের সচিব রুহুল আলম সিদ্দিকী তাঁর রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন।
অবশ্য এই রদবদলের ঠিক আগেই গত বুধবার পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, ‘তিনি (জসীম উদ্দীন) নিজেই দায়িত্ব ছাড়তে চাইছেন কিছু কারণবশত। এখানে সরানোর কোনো বিষয় নেই।’
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ২৭তম পররাষ্ট্রসচিব হিসেবে নিয়োগ পেয়েছিলেন মো. জসীম উদ্দীন। কূটনীতিক হিসেবে প্রায় তিন দশকের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এই কর্মকর্তা ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসে যোগ দেন। ১৩তম বিসিএস (পররাষ্ট্র) ক্যাডারের সদস্য জসীম দেশে-বিদেশে বহু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন।
কিন্তু পররাষ্ট্রসচিব হওয়ার মাত্র আট মাস পরই তাকে দায়িত্ব ছাড়তে হলো। নীতিগত মতপার্থক্য, পররাষ্ট্রনীতিতে অগ্রাধিকারের দ্বন্দ্ব এবং ক্রমবর্ধমান রাজনৈতিক চাপ- সব মিলে এক জটিল সংমিশ্রণ এর পেছনে কাজ করেছে । এই রদবদল শুধু একজন কর্মকর্তা পরিবর্তন নয়, এটি যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কূটনৈতিক কৌশলের প্রতিফলন তা পর্যবেক্ষকেরা জানেন।
২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে দায়িত্ব নেন জসীম উদ্দীন। কিন্তু শিগগিরই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রভাবশালী শক্তির সঙ্গে তাঁর মতবিরোধ দেখা দেয়। বিশেষ করে বিশেষ করে রোহিঙ্গা সংকট ও রাখাইন করিডর নিয়ে তাঁর অবস্থান যে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির বিপরীতে ছিল, তা নিয়ে শুধু গণমাধ্যম নয় সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ও জনপরিসরও বেশ সরগরম।
কূটনৈতিক সূত্রমতে, মিয়ানমারের রাখাইনের ভেতরে ‘মানবিক করিডর’ ও ‘সেফ জোন’ গঠনের যে প্রস্তাব জাতিসংঘ ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা খলিলুর রহমানের মাধ্যমে বেশ জোরালো এসেছিল, সেটি নিয়ে জসীম উদ্দীন বেঁকে বসেছিলেন। তাঁর আশঙ্কা, এটি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের জন্য হুমকি হতে পারে এবং এতে করে সীমান্তবর্তী অঞ্চলে অ-রাষ্ট্রীয় সশস্ত্র গোষ্ঠীর অনুপ্রবেশের ঝুঁকি আছে। তাঁর বক্তব্য ছিল, ‘প্রত্যাবাসনের বিনিময়ে এই পরিকল্পনা রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশকেই উৎসাহিত করবে।’
জসীম উদ্দীনের সরে যাওয়ার বিষয়টি সামনে আসে তখন, যখন মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) নজরুল ইসলাম তাঁর বেশকিছু দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এর মধ্যে গত ১৫ মে টোকিওতে জাপানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠকে নেতৃত্ব দেন নজরুল। পাঁচ দশকে এই প্রথম পররাষ্ট্র সচিব ছাড়াই এ ধরনের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। জসীমকে যে মন্ত্রণালয়ের ভেতরে তাঁকে কার্যত অকার্যকর করে রাখা হয়েছে, এর মধ্য দিয়ে তা স্পষ্ট হয়।
এর আগে ১৭ এপ্রিল ঢাকায় পাকিস্তানের সঙ্গে অনুষ্ঠিত পররাষ্ট্র পর্যায়ের পরামর্শক সভায় জসীম উদ্দীন নেতৃত্ব দেন। সেখানে তিনি সরাসরি দাবি তোলেন— ১৯৭১ সালের পূর্বে অখণ্ড পাকিস্তানের জাতীয় সম্পদ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্য ৪.৩২ বিলিয়ন ডলার এবং ১৯৭০ সালের ভোলার ঘূর্ণিঝড়ে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ঘোষিত ২০০ মিলিয়ন ডলারের বৈদেশিক অনুদান ফেরত দেওয়া হোক।
তাঁর এই ধরনের আগ্রাসী কূটনৈতিক অবস্থান পাকিস্তান ও ঢাকার একটি অংশের মধ্যে অসন্তোষের জন্ম দেয়। ৫ আগস্ট পটপরিবর্তনের পর ক্ষমতা নেওয়া ইউনূসের নেতৃত্বে সরকারের ভেতরে একটি লবি দীর্ঘদিন ধরে পাকিস্তানের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক তৈরির জন্য সক্রিয় ছিল। তাঁরা মনে করে অতীতের ক্ষত নিয়ে আলোচনা না করাই উত্তম। পাকিস্তানের সঙ্গে জসীম উদ্দীনের ‘মৌলিক দাবি’ তোলার বিষয়টি তাদের একেবারেই ভালো লাগেনি।
রাজনীতি ও সমাজ বিশ্লেষকদের কেউ কেউ বলছেন, মুহাম্মদ ইউনুসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার ইসলামপন্থী প্রভাবাধীন প্রশাসন গড়ে তুলতে যাচ্ছে। এর পেছনে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানের পক্ষে মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনকারী জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু কট্টর ইসলামপন্থী গোষ্ঠীর চাপ, যারা ‘শরিয়াহ-ভিত্তিক’ রাষ্ট্রকাঠামো তৈরি করতে চায়। ফলে ঐতিহাসিক বাস্তবতাভিত্তিক, সেনাবাহিনীর ঘনিষ্ঠ ও জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতন কর্মকর্তারা প্রশাসনে অগ্রাধিকার হারাচ্ছেন।
জসীম উদ্দীনের দায়িত্ব সাময়িকভাবে পালন করতে যিনি আসছেন, সেই রুহুল আলম সিদ্দিকী দীর্ঘদিন পাকিস্তানে হাইকমিশনার হিসেবে কাজ করেছেন এবং ভারতের দিল্লিতেও দায়িত্ব পালন করেছেন। বৃহস্পতিবার (২২ মে) পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক আদেশে জানিয়েছে, ফরেন সেক্রেটারি জসীম উদ্দীনের পরিবর্তে সচিব (পূর্ব) রুহুল আলম সিদ্দিকী দায়িত্ব পালন করবেন ‘পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত’। তিনি ১১তম বিসিএসের কর্মকর্তা এবং ২০২০ সালের অক্টোবর থেকে ২০২৪ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানে বাংলাদেশের হাইকমিশনার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
তাঁর পেশাগত প্রোফাইল রাজনীতি-বিমুখ এবং তিনি সরকারের সঙ্গে ‘সহজে চলার’ মতো কূটনৈতিক হিসেবে পরিচিত। মূলত তাঁর নিরপেক্ষ ও মৃদু অবস্থানের কারণেই তাঁকে সাময়িক দায়িত্বে আনা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে।
এদিকে পররাষ্ট্রসচিব পদে পরবর্তী দায়িত্বে আসতে যাচ্ছেন ওয়াশিংটনে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূত আসাদ আলম সিয়াম। মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে, তিন জনের সংক্ষিপ্ত তালিকা থেকে তাকে বেছে নেওয়া হয়েছে। চূড়ান্ত নিয়োগ না হওয়া পর্যন্ত একজন ‘ভারপ্রাপ্ত পররাষ্ট্রসচিব’ হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। আন্দাজ করা যায়, আপাতত রুটিন দায়িত্বে থেকে সেই ভার সামলাবেন রুহুল আমিন।
জসীম উদ্দীনের সরে যাওয়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতির ভবিষ্যৎ কৌশলের গুরুত্বপূর্ণ মোড় হতে পারে। বিশ্লেষকরা মনে করছেন, জসীম উদ্দীনের অপসারণ কেবল একজন কূটনীতিকের দায়িত্ব বদলের বিষয় নয়; এটি পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতির ইঙ্গিতও বহন করছে। ক্ষমতাসীন অন্তর্বর্তী সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্কোন্নয়ন এবং নতুন ধর্মীয় রাজনৈতিক ভারসাম্যের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।
মিয়ানমার-পাকিস্তান-বিশ্বশক্তির মাঝে ভারসাম্য রক্ষার জটিল পররাষ্ট্র নীতিতে আদর্শবাদ বনাম বাস্তববাদের দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে উঠছে। এই প্রেক্ষাপটে নিরপেক্ষ ও বাস্তববাদী পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করা কর্মকর্তারা ক্রমেই কোণঠাসা হয়ে পড়ছেন। ‘নতুন বাংলাদেশ’ কীভাবে সামনের পথচলা নির্ধারণ করবে, সেটাই এখন দেখার বিষয়।