
ডোনাল্ড রামসফেল্ড একবার বলেছিলেন, There are known knowns, there are known unknowns, but there are also unknown unknowns। এটার সহজ অর্থ হলো কিছু কিছু জিনিস আমরা জানি যে আমরা জানি, কিছু বিষয় আমরা জানি যে আমরা জানি না, কিন্তু এমন কিছু বিষয় আছে যেগুলোর অস্তিত্ব আমরা জানিই না।
অধ্যাপক ইউনুস সত্যিই পদত্যাগ করলে, তৎপরবর্তী বাংলাদেশে আমাদের পরিস্থিতি হবে unknown unknowns যুগের। আমাদের অনেকের অনেক পরিকল্পনাই আছে, কিন্তু আসলেই কী হবে সেটি হয়তো আমরা কেউই আঁচ করতে পারছি না।
বিএনপি ভাবছে ইউনুস সরে গেলে, ওয়াকারের সাথে মিলে (ওয়াকার যদি সত্যি সত্যি যা বলছে তা মিন করে) তারা একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করবে এবং তিনমাস বা ছয় মাসের মধ্যে নির্বাচন করে ক্ষমতায় চলে যাবে। ভালো পরিকল্পনা। আমিও চাই যে এমনটি সফল হোক। কিন্তু এই আউটকাম আসলে কয়েকটা এজাম্পশানের উপর নির্ভরশীল।
প্রথম এজাম্পশন/ অনুমান হচ্ছে বিএনপি’র বলয়ের বাইরের যে এলায়েন্স (এনসিপি, জামাত, ইসলামিক আন্দোলন, খেলাফত মজলিস, এবি পার্টি প্রভৃতি) তারা বিএনপির এই পরিকল্পনায় সায় দিবে এবং ইউনুস-পরবর্তী সরকারকে সহযোগিতা করবে। এখন, প্রশ্ন করেন, এই বিএনপি-বিরোধী এলায়েন্স, যারা নির্বাচন-পরবর্তী আসন্ন বিরোধী ককাসও, তারা যদি বলে যে তোমরা ইউনুস সরকারকে সহায়তা কর নাই এবং তোমাদের যৌথ প্রচেষ্টায় (ওয়াকার ও বিএনপি) ইউনুস চলে যেতে বাধ্য হয়েছে, তোমরা রাষ্ট্রের সেসব সংস্কার মানো নাই যে সংস্কারে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হবে, নির্বাচনটা জিরো-সাম গেম হবে না, তাহলে আমরা কেন সেই জিরো-সাম গেমের নির্বাচনের আয়োজনে তোমাকে সহায়তা করবো, যেখানে নির্বাচনে জিতে বিএনপি পুরনো বন্দোবস্ত মতো ক্ষমতা কুক্ষিগত করবে? তারা যদি বলে ও সিদ্ধান্ত নেয় যে ইউনুস সরকারকে ও তার সংস্কার পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করে দিতে মাঠে-ঘাটে তোমরা যা যা করেছো, তোমাদের সংস্কার-বিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পুরনো পথে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টায় আমরাও বাগড়া দিবো? আপনার প্রথম এজাম্পশন হচ্ছে বিএনপি-বিরোধী দলগুলো এসব করবে না। সত্যিই কি তাই? কেন করবে না? আমরা জানি না (unknown unknowns)।
দ্বিতীয় এজাম্পশন হচ্ছে সে ধরনের সরকারকে বিএনপি-বিরোধী দলগুলো অসহযোগিতা করলেও বিএনপি যেহেতু সবচেয়ে বড় দল তারা ওয়াকারের সহযোগিতায় সেটি উৎরে যেতে পারবে। এই অনুমানটিও সমস্যাপূর্ণ। এটি সত্য যে বিএনপি এখন ক্রিয়াশীল বাকী দলগুলোর চেয়ে জনপ্রিয়তায় বা ভোটের সংখ্যায় সবচেয়ে বড় দল। কিন্তু তাদের ভোটের শেয়ার স্টিল ৩০-৩৫ শতাংশ। বাকী ৬৫-৭০ শতাংশ লোক এখনও বিএনপিকে ট্রাস্ট করে না। এছাড়া এই এজাম্পশনের সবচেয়ে বড় ত্রুটি হচ্ছে স্ট্রিট ফাইটিং ফোর্স হিসেবে বিএনপি-বিরোধী যে রেজিমেন্টেড গ্রুপ (এনসিপি-ইসলামীক-ফোর্স), সেটিকে ম্যাচ করার মতো বিএনপি’র সেই স্ট্রিট ফাইটিং ফোর্স নেই। এটি রূঢ় বাস্তবতা। যেমন ধরেন, এটি থাকলে ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবরেই শেখ হাসিনা সরকার পড়ে যেতো - সেদিন বিএনপি ঢাকা শহরে ১০ লক্ষের বেশি লোকসমাগম করেছিলো বলে মনে করা হয়। কিন্তু শেখ হাসিনা ঢাকার কয়েকটি পয়েন্টে কয়েকটি ককটেল/ পটকা/ সাউন্ড গ্রেনেড ফুটিয়ে, কোন সিগনিফিকেন্ট ড্যামেজ ছাড়া রাস্তা খালি করে ফেলে। তো এই হচ্ছে বিএনপি’র স্ট্রিট ফাইটিং ফোর্সের সর্বোচ্চ সক্ষমতা। শেখ হাসিনা-বিরোধী আন্দোলনের সময় পল্টনের এক বড় সমাবেশ থেকে ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদকে একবার বিএনপির এক নেতা “সিট ইন/ অবস্থান” কর্মসূচি ঘোষণা দেওয়ার অনুরোধ করে। মওদুদ উনাকে বলেছিলেন, আপনি যে এই হাজার-হাজার লোক দেখছেন, পুলিশ কয়েকটা পটকা ফুটালে তারা ভেগে যাবে। সুতরাং রাস্তার লড়াইয়ের সক্ষমতা নিয়ে বিএনপি’র অতি-আত্মবিশ্বাসী হওয়ার কোন যৌক্তিক ভিত্তি নেই। বিএনপি যদি মনে করে নিঝর্ঞ্জাটে সংস্কার-বিহীন একটা নির্বাচনে তারা ক্ষমতায় গিয়ে আগের বন্দোবস্তে ফিরে যাবে, তাদেরকে এটাও মনে করতে হবে যে বিএনপি-বিরোধী বাকী স্ট্রিট ফাইটিং ফোর্স তাদের এই এন্তেজামে কোন বাগড়া দিবে না। যদি তারা বাগড়া দেয়? যদি ইশরাকের হটকারিতার মতো ঢাকার বিভিন্ন রাস্তা দখল করে বসে পড়ে বিভিন্ন দাবিতে? যদি তারা এমনটি করে ওয়াকারের ফোর্সের ভিতরের অনুষঙ্গের অনুসমর্থনে, যেমনটি বিএনপি এখন করছে? যদি উভয় শক্তিই সেদিনকার সরকারকে ব্যর্থ করতে চায়, ঠিক এখনকার মতো? যদি উভয় শক্তিরই কমন গোল থাকে? বলছি না এমনটিই হবে, যদি হয়, নির্বাচন হবে? বিএনপি ক্ষমতায় যাবে? আমরা জানি না (unknown unknowns)।
তৃতীয় এজাম্পশন হচ্ছে, ওয়াকার একজন ইনোসেন্ট এক্টর। তার আসলে কোন আওয়ামী প্রেম নাই এবং আওয়ামী লীগকে সে পুনর্বাসন করতে চায় না। বা সীমান্তের ওপারের সংযোগও নেই। ওয়েল, এগেইন, এরকম হলে খুবই ভালো। কিন্তু ওয়াকার যদি সত্যিই ইনোসেন্ট এক্টর না হন? তিনি যদি সত্যি-সত্যিই আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসন করতে চান? তিনি যদি সত্যি-সত্যিই সীমান্তের ওপারের লোকজনের সাথে দহরম-মহরম করেন? সেক্ষেত্রে কী হবে? সীমান্তের ওপারের লোকজন পরীক্ষিত দা** ছেড়ে, অপরীক্ষিত দা***কে বেছে নিবে? কেন বেছে নেবে? তাছাড়া উর্দি ক্ষমতার সুগন্ধে, ক্ষমতার এতটা কাছাকাছি থেকে কেন নিজেরাই সেটি নিয়ে নিবে না? তারা কেন রাস্তার আসন্ন ক্রমাগত “অস্থিতিশীলতা” “স্থিতিশীল” করতে নিজেরাই চালকের আসনে যাবে না যখন উপরের স্ট্রিট ফাইটিং ফোর্সটি নিজেদের উইথড্র করবে? তারা এসবই করবে বলছি না, কিন্তু করবে না সেটিও কেউ জোর দিয়ে বলতে পারবে না। এগেইন, এনাদার unknown unknowns। তাদের আগের ইতিহাস আছে এ ধরনের পরিস্থিতিতে হস্তক্ষেপ করার।
সবচেয়ে নির্বিবাদী অনুমান হচ্ছে উপরের সব অনুমান ভুল হবে, সবাই বিএনপি ও ওয়াকার যেভাবে বলছে বা চাইছে সেভাবে সুড়সুড় করে সংস্কার-বিহীন, জিরো-সাম নির্বাচনে যাবে এবং বিএনপি’র পাতে বাংলাদেশটাকে তুলে দিবে যাতে লুটপাটের পুরনো সমস্ত বন্দোবস্ত বজায় থাকে, রাষ্ট্রের সমস্ত ক্ষমতা শেখ হাসিনার মতো রহমান সাহেবের হাতে কুক্ষিগত হয়ে আরেকটি নির্বাচিত স্বৈরাচার কায়েম হয়, এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলো শেখ হাসিনার বদলে রহমান সাহেবকে সার্ভ করা শুরু করে। আপনারা তো নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ক্ষমতায়ন চান না, চাইলে যেসব সংস্কার জনগণের ক্ষমতায়ন করে বা যেসব সংস্কারের ফলে রাষ্ট্র জনগণের নিপীড়ক হয়ে উঠতে না পারে সেগুলোতে রাজী হতেন। তো আপনাদের কী মনে হয় সবাই আপনাদের পাতে নির্বিবাদে এভাবে বাংলাদেশ লুটের বন্দোবস্ত তুলে দিবে? কেন দিবে?
রাজনীতি আপোষ ও সমঝোতার খেলা। আপনি আপনারটা সবটা চাইবেন (জিরো-সাম), আর বাকীদের দাবী-দাওয়াকে (মৌলিক সংস্কার) আপনার পথে কাঁটা (নির্বাচনের মাধ্যমে আপনাকে পীর বানাইয়া দেওয়া) ভাববেন, হবে?
মনে রাইখেন, পোস্ট-ইউনুস সরকারের উপর বিএনপির বাইরের সম্মিলিত-বিরোধী এলায়েন্সের যৌথ দাবীগুলোর একটি হবে, সংসদে (উচ্চকক্ষ ও নিম্নকক্ষ উভয়কক্ষেই) সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন করা। তারাও নির্বাচনেরই দাবি করবে। বলবে “প্রতিটি ভোট কাউন্ট হোক”। এবং বরং এটিই বেশি জনবান্ধব দাবি। বিএনপি ও তার জোট ছাড়া প্রায় প্রতিটি রাজনৈতিক দলের জন্য সেটি উইন-উইন দাবী। তারা ১ শতাংশ ভোট পেলেও সংসদে ৩ টি সিট থাকবে। তারা চাইবে না কেন? না মানলে তারা নির্বাচনে যাবে না। আর পোয়েটিক জাস্টিস হচ্ছে সংখ্যানুপাতিক সংসদে বিএনপি হবে মাইনরিটি। বলছি না এমনটিই হবে। হলে কী করবেন?
ইন্টারেস্টিং টাইম এহেড!
শুলতান মোহাম্মদ জাকারিয়া