Image description
 

আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত’ গত বুধবার অফিসার্স অ্যাড্রেসে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের এ বক্তব্য এখন টক অব দ্য কান্ট্রি। এ নিয়ে সুশীল সমাজ, রাজনৈতিক অঙ্গনসহ দেশের বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে চলছে ব্যাপক আলোচনা; সরগরম সামাজিক মাধ্যমও। তাদের অনেকেই বলছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত বলে সেনাপ্রধান যে বক্তব্য দিয়েছেন, তাতে করে নির্বাচন নিয়ে যে ধোঁয়াশার সৃষ্টি হয়েছে, তা অনেকখানি কেটে গেছে। নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী ও দায়িত্বশীল মন্তব্য করেছেন সেনাপ্রধান। তার এ বক্তব্য জাতীয় স্বার্থ, জনগণের আকাক্সক্ষা ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার একটি গুরুত্ববহ বার্তা বলে মনে করা হচ্ছে।

বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী আমাদের সময়কে বলেন, দেশে একটি নির্বাচিত সরকার প্রতিষ্ঠা হোকÑ এটা সবারই চাওয়া। ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ দেশের সব শ্রেণি-পেশার মানুষের এতে স্বার্থ আছে। নির্বাচিত সরকার না থাকায় সবাই একটা সিদ্ধান্তহীনতার মধ্যে আছে। এ জন্য আর কত অপেক্ষায় থাকবে দেশের মানুষ? সেনাবাহিনীও তো ব্যারাকে ফিরে যেতে চায়। তারা বেশি দিন ব্যারাকের বাইরে থাকলে তাদের ইন্টিগ্রেটি নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিতে পারে। ফলে সেনাপ্রধান যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা দেশের সর্বস্তরের মানুষের প্রত্যাশা ও মনের কথা।

দেশের চলমান রাজনৈতিক বিষয়ে সার্বক্ষণিক খোঁজখবর রাখেন এবং সেনাপ্রধানকে কাছ থেকে দেখেছেনÑ এমন একজন হচ্ছেন ব্রিগেডিয়ার জেনারেল(অব.) ড. একেএম শামছুল ইসলাম পিএসসি। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বুধবার অফিসার্স অ্যাড্রেসে সেনাপ্রধান যখন বলেন যে, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন হওয়া উচিত, তখন এটি নিঃসন্দেহে একটি সময়োপযোগী ও দায়িত্বশীল মন্তব্য। এই বক্তব্যকে জাতীয় স্বার্থ, জনগণের আকাক্সক্ষা ও গণতান্ত্রিক ধারাবাহিকতা রক্ষার একটি গুরুত্ববহ বার্তা হিসেবে বিবেচনা করা উচিত। তিনি আরও বলেন, বর্তমান প্রেক্ষাপটে, যখন নির্বাচন নিয়ে জনমনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে, তখন সেনাপ্রধানের এই বক্তব্য নির্বাচনের স্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিতে পারে। জাতীয় স্বার্থে, জনগণের অংশগ্রহণ ও মতপ্রকাশের অধিকার নিশ্চিত করতে এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করতে একটি সময়মতো, অংশগ্রহণমূলক ও অবাধ নির্বাচনের বিকল্প নেই।

সাবেক এই সেনা কর্মকর্তা বলেন, এ ছাড়া সেনাবাহিনী সম্পর্কে সোশ্যাল মিডিয়ায় যেসব অপপ্রচার ও ভুল তথ্য ছড়ানো হচ্ছে, এই ধরনের খোলামেলা বক্তব্য তার কিছুটা হলেও নিরসন করতে সহায়ক হবে। এটি সেনাবাহিনীর পেশাদারত্ব ও নিরপেক্ষ অবস্থানের একটি ইঙ্গিত দেয়, যা জনমনে আস্থা সৃষ্টি করবে। আমরা আশা করি, দেশের সব রাজনৈতিক পক্ষ এ ধরনের গঠনমূলক বক্তব্যকে ইতিবাচকভাবে নেবে এবং শান্তিপূর্ণ, সুষ্ঠু নির্বাচনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রাকে সুদৃঢ় করবে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি মাহমুদুর রহমান মান্না আমাদের সময়কে বলেন, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন করা সম্ভব। এটা আগেও বলেছি, এখনও বলছিÑ ভালো নির্বাচন দেওয়া সম্ভব। তিনি বলেন, সেনাপ্রধান যা বলেছেন, তা যৌক্তিক। এটা স্পষ্ট হলো যে, আর্মি মনে করে দেশে ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন হয়ে যাওয়া উচিত। কিন্তু সরকার কিছু বলতে পারে না। এটা হয় নাকি? সরকারের এ জায়গা থেকে ব্যাখ্যা দেওয়া উচিত।

সেনাপ্রধানের বক্তব্যের ধারাবাহিকতায় ডিসেম্বরের মধ্যে দেশে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে বলে মনে করেন বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক। তিনি আমাদের সময়কে বলেন, সেনাপ্রধানের বক্তব্য ইতিবাচকভাবে দেখছি। কারণ, তিনি এর আগেও একই ধরনের কথা বলেছেন। তার বক্তব্যের একটা ধারাবাহিকতা আছে, এক ধরনের সঙ্গতি রয়েছে। তার কথা রাজনৈতিক দল ও জন-আকাক্সক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ।

সাইফুল হক বলেন, সরকারের যে সার্বিক পরিস্থিতি, তাতে মনে হয় পরিস্থিতি সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। তারা হোঁচট খাচ্ছে, কিছুটা পথ হারিয়ে ফেলছে; নানা ধরনের গুরুতর সমন্বয়হীনতা, অকার্যকারিতাÑ এগুলো মানুষ দেখছে। এতে করে আগের মতো নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে যথাসম্ভব দ্রুত নির্বাচন দিয়ে বিদায় নেওয়া তাদের জন্য সবচেয়ে ভালো বিকল্প। অনির্বাচত সরকারের বহুমুখী সংকট এরই মধ্যে আমরা দেখতে পাচ্ছি। এমন পরিস্থিতিতে সেনাপ্রধানের বক্তব্য জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলোর বৃহত্তর বক্তব্যেরই প্রতিধ্বনি। সরকার যদি এটাকে ইতিবাচকভাবে নেয় এবং সরকারের সামগ্রিক কার্যক্রম ছোট করে এনে যদি বাস্তব পদক্ষেপ নেয় সংস্কার ও নির্বাচনের ব্যাপারে, তাহলে সরকার ও জনগণের জন্য তা হবে ইতিবাচক। তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতি তো সরকারের জন্য অস্বস্তিকর। করিডর ও বন্দর নিয়ে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে যৌক্তিক বলে মনে করেন এই নেতা।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স আমাদের সময়কে বলেন, করিডর ও বন্দর যেভাবে দেওয়ার বিষয়ে সরকার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে, এটা যথাযথ সিদ্ধান্ত নয়। বিষয়টা সরকারকে বুঝতে হবে। এটা এই সরকারের কাজও না। বরং এ ধরনের সিদ্ধান্ত যদি সরকার নেয়, তাহলে দেশ সাম্রাজ্যবাদী আধিপত্যবাদী প্রক্সি-ওয়ারের মধ্যে চলে যাবে। তিনি বলেন, আমরা অনেক দিন ধরেই বলে আসছি এটা একটা অন্তর্বর্তী সরকার। তাদের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে একটা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা। এর আগে যে যে সংস্কার করা দরকার, তা করতে হবে। আমার মনে হয়, সরকার এরই মধ্যে দেরি করে ফেলেছে। আমরা আগেই বলেছি, ২০২৫ সাল শেষ হওয়ার আগেই নির্বাচন সম্ভব। আমরা মনে করি এখনও সম্ভব। মানুষের জীবনে নিরাপত্তা নাই। মব সন্ত্রাস চলছে। আজও (বৃহস্পতিবার) আমরা কোর্টে মব সন্ত্রাস হতে দেখলাম। এটা একেবারে অনাকাক্সিক্ষত। এসব ব্যাপারে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে।

সিপিবির সাধারণ সম্পাদক বলেন, সংস্কারের বিষয়ে আমরা বলেছি, ভালো নির্বাচনের জন্য যা যা করা দরকার, তা করতে হবে। কিন্তু সংস্কারের নামে যদি এমন সব এজেন্ডা সামনে নিয়ে আসা হয়, যেসব বিষয়ে ঐকমত্য সম্ভব না এবং এটা এ সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে না, তাহলে মানুষ মনে করবে, নির্বাচনব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে বাধাগ্রস্ত করে অন্য অপশক্তিকে সুযোগ দেওয়া ছাড়া এটি আর কিছুই না। সুতরাং, অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বক্তব্য এবং সেনাপ্রধানের বক্তব্য যতটুকু আমরা শুনতে পেয়েছি সেটা যদি ঠিক হয়, সেটা ধরে সরকার আর এক সেকেন্ডও দেরি না করে দায়িত্বশীল ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছি।

বিএনপি ও এর মিত্র রাজনৈতিক দলগুলো বারবার ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচনের দাবি জানিয়ে আসছে। কিন্তু অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এর মধ্যে, বিভিন্ন উপদেষ্টার ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য এবং নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা না করায় রাজনৈতিক দলসহ সংশ্লিষ্টদের মধ্যে শঙ্কা দেখা দেয়।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে গণ-অধিকার পরিষদের সভাপতি ও ডাকসুর সাবেক ভিপি নুরুল হক নুর আমাদের সময়কে বলেন, বিএনপি, আমরাসহ অনেক রাজনৈতিক দলই বলেছে, ডিসেম্বরের মধ্যে নির্বাচন। আমি এ বক্তব্যকে স্বাভাবিকভাবেই দেখি। বর্তমান সরকারের যদি নির্বাচন করতে হয়, তাহলে রাজনৈতিক দল ও সেনাবাহিনীর একটা ভূমিকা প্রয়োজন হবে। সংকটকালীন সময়ে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্থিতিশীল পর্যায়ে আনয়নে সেনাবাহিনীর একটা ভূমিকা আছে। তারা যদি নির্বাচনের বিষয়ে কনসার্ন থাকে এবং দেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনে সরকারকে সহায়তা করতে চায়, তাহলে আমরা এটাকে ভালো পদক্ষেপই বলব। তিনি বলেন, একটা পক্ষ তো নির্বাচন পেছানোর ষড়যন্ত্র করছে, বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। সেক্ষেত্রে সেনাপ্রধানের অবস্থান সবাইকে একটা স্পষ্ট বার্তা দেবে।