
চট্টগ্রামের একসময়ের সম্ভাবনাময় চামড়াশিল্প ঢাকার ট্যানারি মালিকদের সিন্ডিকেটের কারণে জিম্মি হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে স্থানীয় চামড়া আড়তদারদের ব্যবসা কার্যত স্থবির হয়ে পড়েছে বলে জানান তাঁরা।
দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য ও রপ্তানি আয়ে পোশাকশিল্পের পরই রয়েছে চামড়াশিল্প। চট্টগ্রামে একসময় ২২টি ট্যানারি থাকলেও কমতে কমতে তা একটিতে নেমে এসেছে। এর কারণ হিসেবে চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা দুষছেন ঢাকার ট্যানারি সিন্ডিকেট ও সরকারসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের। তাঁরা বলছেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উদাসীনতা আর সিন্ডিকেটের আধিপত্যে দীর্ঘদিন ধরে ধুঁকছে দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই শিল্প।
চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, প্রতিবছর কোরবানির ঈদ এলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় রকমভেদে চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দায় সারে। পরে এসবের আর খবর রাখে না তারা। একই অবস্থা ট্যানারির দায়িত্বে থাকা শিল্প মন্ত্রণালয়ের ক্ষেত্রেও। এই মন্ত্রণালয় তৃণমূল পর্যায়ের ব্যবসায়ীদের ঋণসুবিধা না দিয়ে ঋণ দেয় ট্যানারি মালিকদের।
চট্টগ্রামের ২২ ট্যানারির মধ্যে টিকে আছে একটি : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিভিন্ন সময় চামড়া প্রক্রিয়াকরণ ও রপ্তানি বাণিজ্যে অবদান রাখতে চট্টগ্রামে মোট ২২টি ট্যানারি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান চালু হয়। এসব ট্যানারির ২১টি নানা জটিলতায় বন্ধ হয়ে যায়। বর্তমানে টিকে আছে রীফ লেদার নামের একটি প্রতিষ্ঠান। যারা বছরে চামড়া কেনে মাত্র এক লাখ পিস। অথচ চট্টগ্রামে প্রতিবছর শুধু গরুর চামড়া মেলে চার লাখের বেশি। নগরীর আতুড়ার ডিপো চামড়া আড়তদার সমিতির অধীনে একসময় প্রায় আড়াই শ চামড়া আড়তদার থাকলেও এখন আছেন মাত্র ১৫ থেকে ২০ জন।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিনসহ অন্য ব্যবসায়ীরা জানান, চট্টগ্রামে একসময় মদিনা ট্যানারি ও রীফ লেদার নগদ টাকায় চামড়া কিনত। সরকারের কিছু বিধি-নিষেধের কারণে মদিনা ট্যানারি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর এখন টিকে আছে রীফ লেদার নামের একমাত্র প্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ সময় ধরে দেশের চামড়া ব্যবসার সঙ্গে জড়িত এসব ব্যবসায়ীর প্রত্যাশা, সরকার যদি বন্ধ হয়ে যাওয়া ট্যানারিগুলো নতুন করে চালু করার উদ্যোগ নেয়, তাহলে চট্টগ্রামের সম্ভাবনাময় চামড়া ও চামড়াজাত ব্যবসার সুদিন ফিরে আসবে।
বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘বৈশ্বিক মানদণ্ড প্রতিপালন (কমপ্লায়েন্স) করতে না পারায় দেশের ট্যানারি ও চামড়া শিল্প বিপর্যয়ের মুখে। ফলে একে একে ট্যানারিগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।’
ট্যানারি সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হওয়ার কথা বলছেন ব্যবসায়ীরা : চট্টগ্রামের ট্যানারিগুলো বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে এই এলাকার চামড়া ব্যবসায়ীরা বাধ্য হয়ে ঢাকার ট্যানারিমুখী হয়ে পড়েছেন। অভিযোগ রয়েছে, চট্টগ্রামে উৎপাদন অনুযায়ী চামড়ার চাহিদা কম থাকার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এখানকার কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ীদের জিম্মি করে রেখেছেন ঢাকার ব্যবসায়ীরা।
নগরীর আতুড়ার ডিপু এলাকার একজন প্রসিদ্ধ কাঁচা চামড়া ব্যবসায়ী নিজের নাম ও প্রতিষ্ঠানের পরিচয় গোপন রাখার শর্তে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘চট্টগ্রামে মাত্র একটি ট্যানারি থাকায় আমাদের বেশির ভাগ চামড়া ঢাকার ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করতে হয়। এতে তাঁরা প্রতিবছর আমাদের কোটি কোটি টাকা আটকে রাখে।’
ওই ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, গত এক দশকের ব্যবসায় চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীরা ঢাকার ট্যানারি মালিকদের কাছে ৩০ কোটি টাকা পাবেন। তাঁরা এই টাকা পরিশোধে সব সময় গড়িমসি করেন।
ট্যানারির জন্য সরকারি সব সুবিধা : তৃণমূল পর্যায় থেকে কাঁচা চামড়া সংগ্রহের পর পরিষ্কার করে তা লবণ দিয়ে পক্রিয়াকরণসহ সব কিছু নগদ অর্থে করে থাকেন কাঁচা চামড়ার আড়তদাররা। অথচ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন দেশের ট্যানারি মালিকরা।
আড়তদারদের ভাষ্য, কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে মাঠ পর্যায় থেকে চামড়া আহরণ শেষে তা গুদামজাত করার পর লবণজাত করে আরো টাকা বিনিয়োগ করেন তাঁরা। অথচ ঢাকার ব্যবসায়ীরা বাকিতে চামড়া নিয়ে অর্থ পরিশোধের ক্ষেত্রে গড়িমসি করেন নিয়মিত। আবার ট্যানারি মালিকরা চামড়াশিল্প লাইসেন্স ব্যবহার করে ব্যাংক থেকে সহজশর্তে ঋণ পেয়ে থাকেন।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমরা কোটি কোটি টাকা লগ্নি করে ব্যাংকের ঋণসুবিধা থেকে বঞ্চিত। অথচ ট্যানারি মালিকরা ঠিকই সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা পান।’
দর নির্ধারণ করে দায় শেষ সরকারের : খোঁঁজ নিয়ে জানা গেছে, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত বছর ঢাকার বাইরে প্রতি বর্গফুট লবণযুক্ত গরুর চামড়ার দাম নির্ধারণ করে দিয়েছিল ৫০ থেকে ৫৫ টাকা, যা ২০২৩ সালে ছিল ৪৫ থেকে ৪৮ টাকা। এ ছাড়া খাসির লবণযুক্ত চামড়া ২ থেকে ২৫ টাকা এবং বকরির চামড়া ১৮ থেকে ২০ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল। এ বছর এখনোও চামড়ার দাম নির্ধারণ করা হয়নি।
চট্টগ্রামের আড়তদারদের অভিযোগ, কোনো বছর সরকার নির্ধারিত মূল্যে চামড়া বিক্রি করা যায়নি, এ বিষয়ে সরকারও নজরদারি করে না।
চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ মুসলিম উদ্দিন এ বিষয়ে কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘প্রতিবছর আমরা প্রতি বর্গফুট গরুর চামড়া ৩০ থেকে ৩৫ টাকায় কিনি। লবণ দেওয়ার পর ট্যানারি মালিকরা যখন আমাদের কাছ থেকে চামড়া নিতে আসেন, তখন তাঁরা বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে অনেক চামড়া বাদ দিয়ে দেন।’
চট্টগ্রামের কাঁচা চামড়ার শীর্ষস্থানীয় এই ব্যবসায়ী অভিযোগ করেন, ‘গুদাম ভাড়া, শ্রমিকের বেতন ও লবণ দিয়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা সব কিছুই আমাদের নগদ টাকায় করতে হয়। কিন্তু ট্যানারি মালিকরা বাকিতে চামড়া নিয়ে যান।’
আড়তদাররা পাওনা টাকা না পাওয়ার অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে বিটিএ সাধারণ সম্পাদক সাখাওয়াত উল্লাহ কালের কণ্ঠকে বলেন, এটি একটি প্রচলিত নিয়ম, সারা বছরই আড়তদারদের সঙ্গে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যবসা করা হয়। শুধু অভিযোগ আসে কোরবানির সময়। ব্যবসায় লেনদেন থাকবেই। সব টাকা পুরোপুরি পরিশোধ করে কেউ ব্যবসা করে না। কারণ সবারই টানাপড়েন থাকে। তবে সার্বিক পরিস্থিতিতে দেশ-বিদেশ মিলিয়ে চামড়াশিল্পের অবস্থা ভালো নয়। অনেক বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ট্যানারিও এখন বন্ধ হওয়ার পথে।
সরকারি লক্ষ্যমাত্রা কাগজে-কলমে : সরকারের প্রাণিসম্পদ বিভাগ প্রতিবছর জেলা পর্যায়ে কোরবানির পশুর চামড়া সংগ্রহের লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করে দেয়। ২০২৪ সালে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৮ থেকে ৯ লাখ। অথচ ওই বছর চট্টগ্রামের আড়তদাররা সাকুল্যে চামড়া সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন মাত্র তিন লাখ ৬১ হাজার পিস।
প্রাণিসম্পদ বিভাগের লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে চামড়া সংগ্রহ অর্ধেকেরও কম হয় জানিয়ে চট্টগ্রাম কাঁচা চামড়া আড়তদার সমবায় সমিতির সাবেক সভাপতি মুসলিম উদ্দিন বলেন, ‘প্রতিবছর জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগ থেকে যে পরিমাণ কোরবানি হবে বলে তথ্য দেওয়া হয়, কোরবানি শেষে আমরা সেই পরিমাণ চামড়া খুঁজে পাই না।’
কোরবানির চামড়া সম্পর্কিত সভা শেষে বুধবার বাণিজ্য উপদেষ্টা সেখ বশির উদ্দিন বলেন, ‘আসন্ন ঈদুল আজহায় কোরবানির পশুর চামড়া সংরক্ষণে বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন লবণ দেবে সরকার। চামড়ার ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা, পশু আনা-নেওয়া, বর্জ্য ব্যবস্থাপনাসহ সার্বিক বিষয়ে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে চায় সরকার।’
তিনি বলেন, দাম না পেলে আমরা প্রয়োজনে সরাসরি কাঁচা চামড়া রপ্তানি করব। এবার স্থানীয় পর্যায়ে চামড়ার উপযুক্ত দাম পাওয়ার আশা প্রকাশ করেন তিনি।