
রাজনীতিতে বন্ধুহীন হয়ে পড়েছে গণ-অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া শিক্ষার্থীদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি। বিএনপি-জামায়াতসহ প্রায় সব রাজনৈতিক শক্তির সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়ে এখন রাজনীতির মাঠে অনেকটা কোণঠাসা দলটি। যেটি নিয়ে অস্বস্তি আছে এনসিপি’র অন্দরেও। বিষয়টি নিয়ে প্রকাশ্যে লেখালেখি হচ্ছে এনসিপি’র হোয়াট্সঅ্যাপ গ্রুপেও। জুলাইয়ের শক্তিগুলোর সঙ্গে ঐক্য পুনরুদ্ধারে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে সোচ্চার হয়েছেন তারা। একই সঙ্গে আত্মসমালোচনা চলছে এনসিপি’র নেতাদের মধ্যেও। ঐক্য বিনষ্টের জন্য আকারে- ইঙ্গিতে বিভিন্ন নেতাকে উদ্দেশ করে স্ট্যাটাস দিচ্ছেন তারা। সব মিলিয়ে রাজনীতির মাঠে স্বস্তিতে নেই নাহিদ ইসলাম ও আখতার হোসেনের নেতৃত্বাধীন দলটি। চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে গুঞ্জন উঠে পদত্যাগ করতে চাইছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এরপরই সন্ধ্যায় তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পদত্যাগ না করা ও নিজেরা সংযত হবেন বলে প্রধান উপদেষ্টা জানান এনসিপি’র আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম।
কয়েকদিন ধরেই দেশের বৃহৎ রাজনৈতিক শক্তি বিএনপি’র সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়েছে এনসিপি। কাউন্টার দিতে গিয়ে অভ্যুত্থানে বিএনপি’র ভূমিকাকেও ছোট করা হচ্ছে। বিশেষ করে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র পদে তরুণ নেতা ইশরাক হোসেনের শপথ নিয়ে এনসিপি ও বিএনপি নেতাকর্মীরা মুখোমুখি। বিএনপি যখন এর জন্য সরকারকে দায়ী করছে তখন এনসিপি নেমে পড়েছে সরকারের হয়ে বিএনপি’র বিরোধিতা করার জন্য। এ প্রেক্ষাপটে তারা নির্বাচন কমিশন ভবনও ঘেরাও করেছেন। সেখানে গিয়ে সরকারের তিন উপদেষ্টাকে বিএনপিপন্থি দাবি করে পদত্যাগ দাবি করেছেন।
গেল বছরের ৮ই আগস্ট প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হওয়ার পর রাজনীতিতে মনযোগী হয়েছেন অভ্যুত্থানের নেতারা। জুলাই সনদ, জুলাই ঘোষণা, গণহত্যাকারীদের বিচার, আহত ও নিহতদের পরিবারের পুনর্বাসনসহ মৌলিক বিষয়গুলোতে নজর না দিয়ে কেবল ক্ষমতা আর রাজনীতির উচ্চাভিলাষে মেতেছেন ছাত্রনেতারা। যেটি করতে গিয়ে অভ্যুত্থানের অন্যতম শক্তিগুলোর সঙ্গে প্রকাশ্য বিরোধে জড়িয়েছেন তারা। গঠনমূলক সমালোচনা না করে গতানুগতিক ধারা বেছে নিয়েছেন তারা। গত ২৮শে ফেব্রুয়ারি আত্মপ্রকাশের পর নতুন ধারার রাজনীতি তো হাজির করতে পারেনি এনসিপি বরং পুরনো পথেই হেঁটেছে। দলটির নেতাদের বিরুদ্ধে একের পর এক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ উঠছে। অন্যদিকে দুই ছাত্র উপদেষ্টাও সরকারে থেকে এনসিপি’র হয়ে কাজ করছেন বলে অভিযোগ রাজনৈতিক দলগুলোর। এমনকি প্রকাশ্যে তারা বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিচ্ছেন। যা নিয়ে স্বস্তি নেই এনসিপি’র মধ্যেও।
এদিকে কয়েকদিন ধরে রাজধানীসহ সারা দেশে যে অস্থিরতা চলছে তার মধ্যে গত বুধবার রাতে সেনাসদরে সেনাবাহিনী প্রধানের বক্তব্য ঘিরে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে। এক একজন সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে এক একভাবে বিশ্লেষণ করছেন। সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোও দুই পথের পথিক। এ নিয়ে দেশে যখন অস্থিরতা বিরাজ করছে তখন হুঁশ ফিরেছে ছাত্র উপদেষ্টা ও এনসিপি নেতাদের। বিশেষ করে জুলাইয়ের ঐক্য বিনষ্টের জন্য সবচেয়ে বেশি দায়ী করা হয় উপদেষ্টা মাহফুজ আলমকে। এবার তারও সুর নরম হয়েছে। কারণ চলমান পরিস্থিতিতে সরকারপ্রধান ড. ইউনূস জুলাই আন্দোলনের নায়কদের ডেকে সংযত না হলে দায়িত্ব ছেড়ে চলে যাবেন বলে জানিয়ে দিয়েছেন। গতকাল উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকেও নিজের পদত্যাগের বিষয়টি সামনে আনেন প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস। তিনি বলেন, নতুন কারও নেতৃত্বে যেন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তবে উপস্থিত উপদেষ্টারা তাকে এমন সিদ্ধান্ত না নেয়ার অনুরোধ করেন বলে সূত্র জানিয়েছে। এরপরই উপদেষ্টা মাহফুজ আলম এক স্ট্যাটাসে তার অতীত বক্তব্য ও শব্দচয়নের জন্য দুঃখপ্রকাশ করেন। স্ট্যাটাসে তিনি লেখেন, ব্যক্তির আদর্শ, সম্মান ও আবেগের চেয়ে দেশ বড়। দেশপ্রেমিক শক্তির ঐক্য অনিবার্য। আগেকার যেকোনো বক্তব্য ও শব্দচয়ন, যা বিভাজনমূলক ছিল- সেগুলোর জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত। সরকারে আর একদিনও থাকলে অভ্যুত্থানের সকল শক্তির প্রতি সম্মান ও সংবেদনশীলতা রেখে কাজ করতে চাই। পুরাতন বন্দোবস্তের বিভেদকামী স্লোগান ও তকমাবাজি, যা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে হত্যাযোগ্য করে তোলে, সেগুলো পরিহার করলেই আশা করি ভবিষ্যৎ রাষ্ট্র গণতান্ত্রিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হবে। বাংলাদেশের শত্রুরা ঐক্যবদ্ধ ও আগ্রাসী। সার্বভৌমত্ব ও গণতান্ত্রিক সকল প্রতিষ্ঠান হুমকির মুখে। দেশপ্রেমিক জনগণ যারা জুলাই অভ্যুত্থানে ঐক্যবদ্ধ ছিলেন, তাদের সামনে দীর্ঘ পরীক্ষা। এ পরীক্ষা ঐক্যের এবং ধৈর্য্যের। এ পরীক্ষা উৎরে যেতেই হবে।
এনসিপি’র যুগ্ম সদস্য সচিব রিফাত রশিদ এক স্ট্যাটাসে লেখেন, পলিটিক্যাল লাইন ঠিক করার নামে গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জাতীয় ঐক্যের বদলে বিভাজনের রাজনীতি করার মাধ্যমে কে কী অর্জন করছে জানি না, তবে বাংলাদেশ অনেক কিছু হারাইছে। আর দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখপাত্র হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, জুলাইয়ের ফ্যাসিবাদবিরোধী সকল শক্তির প্রতি আহ্বান- যে বিভাজনটা অপ্রত্যাশিতভাবে আমাদের মধ্যে এসেছিল, সেই বিভাজনকে দেশ ও জাতির স্বার্থে মিটিয়ে ফেলতে হবে। এ দেশের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য এবং পতিত ফ্যাসিবাদের নগ্ন দেশবিরোধী ষড়যন্ত্র থেকে মুক্তির জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। মনে রাখবেন, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের পতনে দেশে-বিদেশে অনেকে নাখোশ হয়ে আছে। এই নাখোশ বান্দারা আমাদের বিভাজনের সুযোগ নিতে নিতে আজকের এই অস্থিতিশীল দিন এনেছে। আমরা সবাই এক হয়েছিলাম বলে দীর্ঘ দেড় যুগের শক্তিশালী ফ্যাসিবাদকে তছনছ করতে পেরেছিলাম। আমরা খণ্ড-বিখণ্ড হলে পতিত ফ্যাসিবাদ ও তার দেশি-বিদেশি দোসররা আমাদের তছনছ করার হীন পাঁয়তারা করবে। দেশ ও জাতির প্রতি দায় এবং দরদ আছে বলেই আমরা এক হয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়েছিলাম। দেশ ও জাতির জন্যই এবার আমাদেরকে এক হয়ে আমাদের স্বদেশকে বিনির্মাণ করতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর স্বার্থের জন্য এই ঐক্য নয়, বরং আমাদের দেশের জন্য আমাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার কোনো বিকল্প নেই। আব্দুল্লাহ হিল বাকী নামে এনসিপি’র এক সমর্থক লেখেন, সবাইকে শত্রু বানানোর রাজনীতির সফলতা কতটুকু? একটু বলে গেলে কৃতজ্ঞ থাকতাম। এ পোস্টের নিচে হাসনাত আব্দুল্লাহ কমেন্ট করেন- জিরো।
এনসিপি’র আরেক বিতর্কিত নেতা আব্দুল হান্নান মাসুদ এক স্ট্যাটাসে লেখেন- দল গঠনের পর মিত্রের খোঁজে না গিয়ে, নিজ স্বার্থে আপনারাই জুলাইকে ধ্বংস করেছেন। বহুবার বলেছি ঐক্য বিনষ্ট করবেন না, উপরন্তু শুধু দেখেছি স্বেচ্ছাচারিতা আর অহংকার। বারবার অপ্রিয় কথাগুলো বলায় সবক্ষেত্রেই হয়েছি কোণঠাসা। প্রত্যেককেই হিসাব দিতে হবে, জুলাইয়ের হিসাব। রাজনীতিতে ক্রমেই কোণঠাসা হচ্ছে জুলাই আন্দোলনে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি। এনসিপি’র আরেক সদস্য ইমরান তুহিন লেখেন- বাগছাসের নেতৃবৃন্দ (ছোডো ভাইরা) তোরা চুপ থাকলে মনে হয় দেশবাসী বেশি খুশি থাকবে। সো ফডর ফডর করা বন্ধ রাখ। আমরা আল্লাহ্ ভরসা করে আবার নাইমা পড়বো যেকোনো সংকটে ইনশাআল্লাহ্।
নাম প্রকাশ না করা শর্তে এনসিপি’র এক যুগ্ম আহ্বায়ক মানবজমিনকে বলেন, জুলাইকে আমরা কেবল নিজস্ব সম্পদ ধরে নিয়েছি। এটি করতে গিয়ে আমরা কোনো শত্রু-মিত্র ভাবিনি। সবাইকে শত্রু বানিয়ে ফেলেছি। যার খেসারত দিতে হচ্ছে এখন। রাজনীতিতে লম্বা রেসের খেলা সেটি এনসিপি’র অনেক নেতাই ভুলে গেছেন। শত্রু-মিত্র না চিনলে আগামীতে করুণ পরিণতি ভোগ করতে হবে।