
সেনা কর্মকর্তাদের সাথে এক সভায় (অফিসার্স অ্যাড্রেস) সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে বলেছেন, মানবিক করিডোরের মতো স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার বর্তমান সরকারের নেই। শুধু একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারই যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক এরূপ সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
তিনি আরো বলেন, করিডোর বিষয়ে কী ভাবছে অথবা জাতিকে একটি ছায়া যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে কি না- এ বিষয়ে সরকার স্পষ্টভাবে কিছুই জানাচ্ছে না। অনুষ্ঠানের পরের অংশে এক অফিসারের প্রশ্নের উত্তরে সেনাপ্রধান স্পষ্টভাবে বলেন, কোনো করিডোর দেয়া যাবে না। এর আগে না হলেও ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে।
গতকাল বুধবার সকালে ঢাকা সেনানিবাসে এ সভা অনুষ্ঠিত হয়। একাধিক সূত্রে জানা গেছে, অনুষ্ঠানে কর্মকর্তাদের প্রশ্নের জবাবে সেনাপ্রধান বলেছেন, দেশের সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে কোনো করিডোর দেয়া হবে না। এ বিষয়ে সেনাপ্রধান সর্বোচ্চ মহলে বার্তা দিয়েছেন।
গতকাল সকাল সাড়ে ১০টায় সেনাপ্রধানের সাথে অধীনস্থ অফিসারদের বৈঠক (অফিসার্স অ্যাড্রেস) শুরু হয়। বৈঠকটি শেষে হয় দুপুর সোয়া ১২টায়। সেখানে তিনি সব অফিসার ও সৈনিককে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান। কোনো ধরনের উসকানি বা গুজবে কান না দিতে বলেছেন তিনি।
অফিসারদের উদ্দেশে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার নিরলসভাবে দেশের প্রতি দায়িত্ব পালনের জন্য সেনাবাহিনীর সব সদস্যকে অভিবাদন জানান। তবে দেশের শান্তি-শৃঙ্খলাসহ সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন।
সার্বিকভাবে দেশে একটি অরাজক পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সময়ের সাথে সাথে পরিস্থিতির আরো অবনতি হচ্ছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বেসামরিক প্রশাসনসহ সব সংস্থা ভেঙে পড়েছে এবং তা পুনর্গঠিত হতে পারছে না। শুধু সশস্ত্রবাহিনী এখন পর্যন্ত টিকে আছে এবং দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় কাজ করে যাচ্ছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
৫ আগস্টের পর থেকে আজ পর্যন্ত দেশের সার্বিক পরিস্থিতি স্থিতিশীল রাখতে সেনাবাহিনীর অক্লান্ত ও নিঃস্বার্থ ভূমিকা সত্ত্বেও বিভিন্ন মহল থেকে সেনাবাহিনী ও সেনাপ্রধানকে টার্গেট করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করে তিনি হতাশা ব্যক্ত করেন।
সেনাপ্রধান আরো বলেন, দেশী-বিদেশী স্বার্থান্বেষী মহল পরিস্থিতিকে আরো অবনতি ঘটাতে চাচ্ছে, যাতে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে পারে।
জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক জুলাই-আগস্ট বিষয়ে যে প্রতিবেদন তৈরি করা হয়েছে, তাতে সেনাবাহিনীর কোনো বক্তব্য নেয়া হয়নি বলে তিনি উল্লেখ করেন এবং বলেন, এ বিষয়ে জাতিসঙ্ঘের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানতে পারেন যে, জাতিসঙ্ঘ সেনাবাহিনীর সাথে যোগাযোগ করতে চাইলেও সে সুযোগ দেয়া হয়নি।
সংস্কারসহ বিভিন্ন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সরকার কী সিদ্ধান্ত নিচ্ছে বা কিভাবে নিচ্ছে, সে বিষয়ে দেশবাসীর পাশাপাশি তিনি ও সেনাবাহিনী অবগত নন বলে উল্লেখ করে সেনাপ্রধান এ বিষয়ে হতাশা ব্যক্ত করেন। পরে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি উল্লেখ করেন যে, প্রথম দিন থেকেই প্রয়োজনীয় সংস্কারের বিষয়ে তিনি বারবার সরকারকে অনুরোধ করেছেন। তবে সরকার অনুরূপ সংস্কারের বিষয়ে সত্যিকার অর্থে সিরিয়াস নয় বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মানবিক করিডোরের মতো স্পর্শকাতর ও ঝুঁকিপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার বর্তমান সরকারের নেই বলে উল্লেখ করে সেনাপ্রধান বলেন, শুধু একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারই যথাযথ পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক এরূপ সিদ্ধান্ত নিতে পারে। একইভাবে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার এখতিয়ার এই সরকারের নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন।
একের পর এক গার্মেন্ট ফ্যাক্টরি বন্ধ হয়ে যাচ্ছে উল্লেখ করে জেনারেল ওয়াকার বলেন, এ বিষয়েও সরকারের কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
গত ২০ মে ২০২৫ তারিখ রাতে অনুষ্ঠিত সভায় এর পূর্ব রাতে সেনা ভবনে কোনো গোপন সভা হয়েছিল কি না প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সেনাপ্রধান যেকোনো সময়ে অর্পিত দায়িত্বের খাতিরে সভা আয়োজন করতে পারেন এবং সেনাপ্রধানকে যে সাংবিধানিক অধিকার দেয়া আছে তাতে তার কোনো ষড়যন্ত্রমূলক সভা করার প্রয়োজনীয়তা নেই।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী দেশ ও জনগণের কোনো রকম ক্ষতি হয় এমন কোনো কাজ করবে না এবং কাউকেই এমন কোনো কাজ করতে দেবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন। গত ৯ মাস ধরে সেনাপ্রধান হিসেবে অভিভাবকহীন হয়ে রয়েছেন বলে তিনি কয়েকবার উল্লেখ করেন। এ বিষয়ে সেনাপ্রধান বলেন, তিনি চাতক পাখির মতো একটি নির্বাচিত রাজনৈতিক সরকারের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের দিকে তাকিয়ে আছেন। একটি নির্বাচিত সরকার সেনাবাহিনীর জন্য অভিভাবক হিসেবে দায়িত্ব পালন করবে এবং যার ফলে সার্বিকভাবে দেশের পরিস্থিতি স্থিতিশীল হবে।
যথাশিগগিরই সম্ভব একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে রাজনৈতিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। অনুষ্ঠানের পরের অংশে এক অফিসারের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, আগে না হলেও ২০২৬ সালের ১ জানুয়ারি নির্বাচিত সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। আসন্ন নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে সততার সাথে নিরপেক্ষ থেকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করবার জন্য ও তিনি নির্দেশনা প্রদান করেন।
সেনাপ্রধান বলেন, এত দীর্ঘ সময় ধরে সেনা সদস্যরা শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষায় মোতায়েন রয়েছে, যা সার্বিকভাবে দেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনাকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। তাই তিনি একটি নির্বাচিত সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর যথাশিগগিরই সম্ভব সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেবেন বলে উল্লেখ করেন। এটি না করতে পারলে বিদ্যমান বিশ্ব পরিস্থিতি ও প্রতিবেশী অঞ্চলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাপনা মারাত্মক ঝুঁকির মধ্যে পড়বে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
সেনাপ্রধান সবাইকে অর্পিত দায়িত্ব সর্বোচ্চ কর্তব্যপরায়ণতা ও আনুগত্যের সাথে পালন করার জন্য নির্দেশনা দেন। পরে এক অফিসারের প্রশ্নের উত্তরে তিনি মজলুমদের অশ্রুজল যাতে না ঝরে এবং মজলুমদের অধিকার রক্ষায় সুনির্দিষ্টভাবে কাজ করার জন্য নির্দেশনা দেন।
সেনাবাহিনী সম্পর্কে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নেতিবাচক প্রচারণা চালানো হচ্ছে এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আজকের আলোচনার বিষয়বস্তুও পরিপূর্ণভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রকাশ পাবে বলে উল্লেখ করে একজন অফিসার এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ জানান। সেনাপ্রধান প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সিজিএসকে নির্দেশনা দেন।
সংস্কার কার্যক্রমগুলোর সিদ্ধান্ত গ্রহণে সেনাবাহিনীর যথাযথ প্রতিনিধিত্ব থাকা প্রয়োজন বলে একজন অফিসার মতপ্রকাশ করেন। তবে এ বিষয়ে সেনাপ্রধান বিশেষ কোনো মন্তব্য করেননি।
সবশেষে তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থেকে এবং দেশপ্রেমের আদর্শে উজ্জীবিত থেকে অর্পিত দায়িত্ব পালনের নির্দেশনা দেন। নিজ অবস্থান ও আদর্শে অবিচল থাকলে কোনো মহলই সেনাবাহিনী ও দেশের কোনো ক্ষতি করতে পারবে না বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বৈঠক সূত্র জানায়, সেনাপ্রধান বলেছেন, বিগত ১৬ বছরের মতো কোনো ফ্যাসিস্ট রেজিম যাতে সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করতে না পারে সে কারণে ডেপুটেশনে কর্মরত কর্মকর্তাদের (র্যাব-বিজিবিসহ অন্যান্য বাহিনী) সেনাপ্রধানের নিয়ন্ত্রণে আনার ব্যাপারে মতামত দেয়া হয়েছে। সরকার এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করলে কোনো শক্তি সেনাবাহিনীকে প্রভাবিত করতে পারবে না।
সেনাপ্রধান সঙ্কটময় সময়ে সবাইকে শান্ত থাকার পরামর্শ দেন। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মিথ্যা তথ্য প্রচারের আশঙ্কার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, সারা দেশে সেনাসদস্যরা নিষ্ঠার সাথে যে দায়িত্ব পালন করছে, জাতি তা মনে রাখবে। তিনি সবাইকে পেশাদারিত্ব, নিষ্ঠা ও ধৈর্যের সাথে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পরামর্শ দেন। এ সভায় সেনাবাহিনীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ঢাকার বাইরের কর্মকর্তারা অনলাইনে যুক্ত হন।
সূত্র জানায়, সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় আশ্রিত ৬২৬ জনের ব্যাপারে অপব্যাখ্যা দিয়ে সেনাবাহিনী প্রধান স্পষ্ট করে বলেন, ৫ আগস্টের পরিস্থিতিতে ক্যান্টনমেন্টে ৬২৬ জন অবস্থান করেছিল। এর বেশির ভাগে ছিল থানায় চাকরিরত কনস্টেবল ও অন্যান্য পদবির পরিবারবর্গ, জজ, অ্যাডভোকেট, সরকারি চাকরিজীবী ইত্যাদি। কিছু রাজনৈতিক ব্যক্তিরা ছিল যারা হেভিওয়েট নয়। তাদের সবার তালিকা আশ্রয় নেয়ার দুই দিনের মাঝে সরকারকে অবগত করা হয়। অদ্যাবধি সরকার এ-সংক্রান্তে কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।
বরখাস্ত সেনাসদস্যদের উসকানির বিষয়ে সেনাপ্রধান বলেছেন, বরখাস্ত সেনাসদস্যরা কোনো একটি তৃতীয় মহলের সহায়তায় পরিস্থিতি অস্থিতিশীল করছে। এদের বেশির ভাগ যৌক্তিক কারণ এবং সুনির্দিষ্ট অপরাধের কারণে চাকরি হারিয়েছে। তাদের অপরাধগুলো জনগণের সামনে প্রচার করার পক্ষে সেনাবাহিনী নয়। ভবিষ্যতে এ-সংক্রান্ত বিষয়ে উসকানিদাতাদের আইনের আওতায় আনা হবে। তিনি কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেছেন, দেশের স্বার্থে নির্বাচনের আগ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর আইনশৃঙ্খলা রক্ষার্থে সক্রিয় থাকা প্রয়োজন। বর্তমানে পুলিশ ও আমলারা পূর্ণ সংগঠিত হতে পারেনি। একটি স্বার্থান্বেষী মহল সেনাবাহিনীর অনুপস্থিতিতে দেশটিকে হুমকির মুখে ফেলে দিতে পারে, যার কারণে সাধারণ জনগণ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করার সাথে সাথেই সেনাবাহিনী অবিলম্বে প্রত্যাবর্তন করবে। এ ব্যাপারে আন্তঃবাহিনী জনসংযোগ পরিদফতর (আইএসপিআর) নয়া দিগন্তকে জানান, এটি সেনাবাহিনীর নিয়মিত সভা।