
রাজধানীর পল্লবী থানার কাছে কালশী বালুর মাঠ বস্তি। ওই বস্তিতেই শাহানাজের মাদক কারবারের স্পট।
সেই স্পটে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রি করতে দেখা যায়। কালশী এলাকাতেই মাদক কারবারি শফিকের নেতৃত্বে শাহানাজ তিনটি মাদকের স্পট পরিচালনা করছেন। স্পটগুলোর বেশিরভাগ বিক্রেতাই নারী। ইয়াবা, হেরোইন, গাঁজাসহ সব ধরনের মাদক বিক্রি হয় প্রকাশ্যেই।
মাদকের এমন রমরমা কারবারে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। সন্তান নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকেন অভিভাককরা। মাদক কারবার ঘিরে রয়েছে চুরি-ছিনতাইয়েরও অভিযোগ। মাদক কেনার টাকা জোগাড়ে চুরি-ছিনতাইয়ের পথ বেছে নিচ্ছে মাদকাসক্তরা।
এলাকাবাসী জানান, কালশী বালুর মাঠ বস্তিটি শাহনাজের স্পট নামে পরিচিত। হেরোইন, ইয়াবা ও গাঁজাসহ সব ধরনের মাদক পাওয়া যায় এখানে। শাহনাজ ও তার দুই মেয়ে আঁখি ও হালিমার নেতৃত্বে চলে কালশী বালুর মাঠ বস্তিসহ মাদকের তিনটি স্পট।
স্থানীয়রা অভিযোগ করে বলছেন, সকাল-বিকাল ঘর থেকে বের হলেই চোখে পড়ে মাদক কেনাবেচা। সন্ধ্যায় কিংবা রাতে ঘরে ফেরার সময়েও একই চিত্র দেখা যায়। মাঝেমধ্যে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি) ও পুলিশ অভিযান চালালেও মাদকের কারবারে কোনো প্রভাব পড়ছে না।
স্থানীয়রা বলেন, মাদক কারবারিরা সাধারণত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে ধরা পড়ে না। ধরা পড়লেও সহজে ছাড়া পেয়ে যায়। তারা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কিছু অসাধু কর্মকর্তাসহ প্রশাসনের লোকদের ম্যানেজ করেই ব্যবসা করে। মাদক কারবারের প্রতিবাদ করতে গেলে উল্টো প্রশাসন ও কারবারিদের সন্ত্রাসী গ্যাং দিয়ে আমাদেরই হয়রানি করা হয়। তাই ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করতেও সাহস পায় না।
শাহানাজ পল্লবী থানা এলাকায় তিনটি মাদকের স্পট পরিচালনা করেন বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর
কালশী বালুর মাঠ বস্তিতে সরেজমিনে গিয়ে প্রকাশ্যে মাদক বিক্রির চিত্র দেখা যায়। বস্তির গলির ভেতরে কয়েকজন তরুণ-তরুণী ইয়াবা, হেরোইন ও গাঁজা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। রাস্তার উপর থেকে কেউ কেউ আবার প্রাচীর টপকে নিচে নেমে টাকা দিয়ে নির্ভয়ে মাদক নিয়ে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছিল, এ যেন মাদক কারবারিদের অভয়ারণ্য!
অনুসন্ধানে জানা যায়, কালশী বালুর মাঠ বস্তিসহ পল্লবীর একাধিক স্পটের মাদক কারবার পরিচালনা করেন শাহানাজ এবং তার দুই মেয়ে আঁখি ও হালিমা। আর তাদের সহযোগিতা করেন শাহানাজের স্বামী মো. আলমগীর হোসেন ও তার দুই মেয়ের স্বামী রুবেল ও রনি।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক তাদের একজন প্রতিবেশী জানান, এদের প্রত্যেকের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মাদক ও মারামারির মামলা রয়েছে। কয়েক মাস আগেও পল্লবী থানা পুলিশের অভিযানে মাদকসহ ধরা পড়েন শাহানাজের দুই মেয়ে আঁখি ও হালিমা। পুলিশ তাদের থানায় নিয়ে যায়। কোনো এক অদৃশ্য কারণে তারা আবার ছাড়াও পেয়ে যান।
একাধিক সূত্র জানায়, শাহনাজ, আঁখি, হালিমা, রাহি, শিল্পী, লাইলী, মর্জিনা ও মরণসহ ওই এলাকার মাদক বিক্রেতারা সবাই কালশী বালুর মাঠ বস্তি এলাকার মাদক কারবারি শফিকের অধীনে কাজ করেন। বালুর মাঠ বস্তি ছাড়াও পল্লবী থানার পাশের শাহপরান বস্তি ও নতুন বস্তি এলাকায়ও একইভাবে মাদক কারবার চলছে।
সূত্র আরও জানায়, পল্লবী থানার পেছনে বিআরবি অফিসের পেছনে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা ও গাঁজা। মাদকের এই স্পট পরিচালনা করছেন আনোয়ার হোসেন নামের এক ব্যক্তি।
মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে সংঘর্ষ
চলতি বছরের ১৪ ফেব্রুয়ারি মধ্যরাতে রাজধানীর মিরপুরে পল্লবী থানা এলাকায় মাদকের টাকা ভাগাভাগি নিয়ে রাস্তায় গুলিবিদ্ধ হয়েছেন দুজন। মিরপুর ১১ নম্বর সেকশনের ‘ই’ ব্লকের ১ নম্বর সড়কে এ ঘটনা ঘটে। এ সময় আহত হন মো. জসিম উদ্দিন (৪৪) ও তার বোন শাহিনুর বেগম (৩২)। তাদের একজন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছেন।
পুলিশ জানায়, মাদক ব্যবসার টাকা ভাগাভাগি নিয়ে ওই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মিরপুর ১১ নম্বর সেকশন এলাকার শহীদুল ও তুহিন গ্রুপের সঙ্গে জসিম ও তার বোন শাহিনুর মাদক ব্যবসা করেন। তাদের মধ্যে টাকা ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব বাঁধে। এক পর্যায়ে তাদের মধ্যে গুলি বিনিময় হয়। এতে জসিম ও তার বোন শাহিনুর গুলিবিদ্ধ হন।
মাদক কারবারিদের গুলিতে গৃহবধূ নিহত
২০২৪ সালের ৩০ অক্টোবর বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে পল্লবী থানাধীন মিরপুর ১১ নম্বরের বাউনিয়াবাঁধ ‘বি’ ব্লকে চিহ্নিত মাদক কারবারি মমিন, শাবু, সম্রাট, শামিম, জয়নাল, ইদ্রিস, কালা মোতালেব, কামাল, জাহাঙ্গীর, আল ইসলাম, ভেজাল মামুন, জয়, ইউনুস, রুবেলসহ অজ্ঞাতনামা ১৪-১৫ জন এলাকার শীর্ষ মাদক কারবারি মামুনের কাছে চাঁদা দাবি করেন। এ নিয়ে দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ ও গোলাগুলির ঘটনা ঘটে। এতে বাউনিয়াবাঁধ ‘বি’ ব্লকের একটি বাসার দ্বিতীয় তলার সিঁড়ির করিডোরে দাঁড়িয়ে থাকা আয়েশা আক্তার গুলিবিদ্ধ হয়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান।
পল্লবী থানা পুলিশের ভাষ্য
থানার কাছে মাদকের কারবার নিয়ে পল্লবী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নজরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, মাদক কারবার পল্লবী এলাকায় আগেও হয়েছে, এখনও হচ্ছে। আমরা নিয়ন্ত্রণে কাজ করছি।
তিনি বলেন, কোনো এসআই বা আমার বিরুদ্ধে যদি অভিযোগ থাকে লিখিত আকারে অভিযোগ দেন। তদন্ত সাপেক্ষে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপরাধ বিশেষজ্ঞ যা বলছেন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষক এবং অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বাংলানিউজকে বলেন, যখন কোথাও মাদকের আখড়া গড়ে ওঠে, তখন মাদককে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব ও সংঘর্ষের সৃষ্টি হয়। মাদক কারবারি ও সেবনকারীদের মাঝে নানা অবস্থানগত আধিপত্যের কারণে সংঘাত-সহিংসতার সৃষ্টি হয়। সেসব সংঘাতে মাদক কারবারি, সেবনকারী বা মাদকের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ব্যক্তিরও কখনো কখনো প্রাণহানি ঘটে।
তিনি বলেন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর থানা বা ইউনিটের আশেপাশে ঘনবসতি বা বস্তি এলাকায় মাদকের কেনাবেচা হরহামেশাই চলছে। ঘনবসতি বা বস্তি এলাকার মানুষজনের একটি অংশ মাদক বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অফিস বা থানার পাশে মাদক কেনাবেচা হয়—এ বিষয় তাদের অজানা নয়। তারা (পুলিশ) এ বিষয়ে অবগত। থানার আশেপাশের এলাকায় যদি মাদক ও অপরাধের অরণ্য গড়ে ওঠার ক্ষেত্র তৈরি হয়ে যায়, তখন বোঝা যায়—ওই থানার কোনো কোনো কর্মকর্তা মাদক কারবারিদের মদত দিতেও যুক্ত। শুধু আর্থিক সুবিধার জন্যই পুলিশ এই কাজ করছে। এসব অসৎ ও অসাধু পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। এসব কর্মকর্তার শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে, নইলে মাদকের প্রভাব সমাজ থেকে কোনদিন কমবে না।