
সাহেব আলী সরদারের বয়স তখন ১৫। সহকর্মীদের সঙ্গে চোরাপথে ভারত গিয়েছিলেন ফল, চকলেট আনতে। হঠাৎ ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) গুলি ছোড়ে। ছররা গুলি বিদ্ধ হয় তার বুক থেকে মাথা পর্যন্ত।
উদ্ধার করে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে নিয়ে যাওয়া হয় রাজধানীর পিজি হাসপাতালে। ভিটেবাড়ির দলিল জমা রেখে মহাজনের কাছ থেকে টাকা ধার নিয়ে প্রায় ২০ দিন তাকে ঢাকায় চিকিৎসা করানো হয়। বাড়ি ফেরার অল্প দিনের মধ্যে তার মাথায় গণ্ডগোল শুরু হয়। এখন তিনি বদ্ধ উন্মাদ, ২৪ ঘণ্টা তাকে তালাবদ্ধ করে রাখা হয় ঘরে।
বিএসএফের নির্মমতার শিকার সাহেব আলীর বয়স এখন ৩২ বছর। প্রায় তিন বছর নিজ ঘরে তালাবদ্ধ মানসিকভাবে অসুস্থ এই যুবককে নিয়ে গরিব পরিবারটির দুর্বিষহ অবস্থা।
মোছাম্মৎ হাসির জীবনের ঘটনাটি ঠিক এমন নয়। স্বামী সাবুর আলী ঝাল-মুড়ি বেচতেন। সবকিছু বাড়িতে গুছিয়ে দিতেন হাসি। কিন্তু সীমান্তহত্যার শিকার স্বামীকে হারিয়ে ছোট দুই সন্তান নিয়ে একটি ছাপড়াঘরে উঠেছেন হাসি। গৃহস্থবাড়িতে ফুটফরমাশ খেটে সন্তান দুটোর মুখে খাবার তুলে দিচ্ছেন এই নারী।
আর সীমান্তে নিহত জাহাঙ্গীর মোড়লের একমাত্র মেয়ে সুইটি সামনের বছর এসএসসি পরীক্ষা দেবে। মা বেশিরভাগ সময় থাকেন মুম্বাইতে। বাবা-মাকে নিয়ে সহপাঠীদের প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত মেধাবী মেয়েটি লেখাপড়া আর এগিয়ে নিতে পারবে কি না সন্দিহান। পরিবারটিও তাকে দ্রুত বিয়ে দিয়ে বিদায় করতে চায়।
এমন হাজারো কাহিনি রয়েছে যশোরের সীমান্তবর্তী এলাকায়। এসব পরিবারের কেউ না কেউ সীমান্তহত্যা বা সহিংসতার শিকার। তারা স্বজন হত্যা বা নির্যাতনের বিচারও চাইতে পারেন না। কোনো সহযোগিতা মেলে না সরকারের কাছ থেকেও।
সাহেব আলীর বাড়ি যশোরের বেনাপোল পোর্ট থানার ভবেরবেড় পশ্চিমপাড়ায়। পাশের সাদিপুর সীমান্তে সকাল দশটার দিকে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে বিএসএফের ছোড়া গুলিতে তিনি আহত হন। ওই সময় শাওন নামে আরেক যুবকের বুকেও গুলিবিদ্ধ হয়েছিল। তিনি মোটামুটি সুস্থ আছেন।
সাহেব আলীর বৃদ্ধা মা জানালেন, তার পাঁচ সন্তানের মধ্যে দুই মেয়ের বিয়ে হয়ে গেছে। বড় ছেলে নবাব সরদার ঢাকায় রিকশা চালান। আরেক ছেলে রজব আলী বাড়িতে থেকে রাজমিস্ত্রির সহকারীর কাজ করেন। গ্রামে থাকা পাঁচ সদস্যের এই পরিবারটির নির্ভরতা একমাত্র উপার্জনক্ষম রজব আলীর ওপর।
প্রতিবেশীরা জানালেন, রজব যে টাকা আয় করে তা দিয়ে অসুস্থ মা ও ভাইয়ের চিকিৎসা করালে পরিবার-সদস্যদের না খেয়ে থাকতে হয়, আবার খাবার জুটলে চিকিৎসা হয় না। রজবের একমাত্র ছেলে বেনাপোল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে সপ্তম শ্রেণির ফার্স্টবয়। মেধাবী এই ছেলেটির লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে নেওয়াও কঠিন।
রজবের স্ত্রী জুলেখা জানালেন, মাথা বিগড়ে যাওয়া দেবর বাইরে গেলেই কোনো না কোনো ঝামেলা হতো। তাই টানা তিন বছর তাকে ঘরে তালাবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। ঘরের সঙ্গেই টয়লেট বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। খাবার সরবরাহ করা হয় জানালা দিয়ে। সামান্যতেই রেগে যান সাহেব আলী। দরজা খোলার উপায় না থাকায় জানালা দিয়ে খাবারসহ অন্যান্য জিনিসপত্র সরবরাহ করা হয়।
আমার দেশ প্রতিবেদক জানালা দিয়ে ছবি তোলার চেষ্টা করলে তেড়ে আসেন সাহেব আলী। বলেন, ‘তোরা কেন এসেছিস? আমাকে ক্ষতি করতে চাস? ছবি তুললে লাঠি দিয়ে মাথা ফাটিয়ে দেব।’
পরিবারটি শার্শা উপজেলা পরিষদ, বেনাপোল পৌরসভাসহ বিভিন্ন স্থানে আবেদন-নিবেদন করেও কোনো অর্থ সহায়তা পায়নি। সাহেব আলীর মা বললেন, ‘মাথায় অপারেশন করতে পারলে ছেলেটি সুস্থ হয়ে উঠত। কিন্তু টাকার অভাবে তা হয়তো আর হবে না।’
ভবেরবেড় এলাকার আরেক বাসিন্দা জাহিদুল ইসলাম (২৫) ঢাকায় একটি কোম্পানিতে প্লাস্টিকের দরজা বানানোর কাজ করতেন। মাস পাঁচেক আগে বাড়িতে ফিরে আসেন তিনি। কিছুদিন পর কাউকে কিছু না বলে হঠাৎ চলে যান ভারত সীমান্তবর্তী দৌলতপুর এলাকায়। সেখানে সীমান্তনদী ইছামতিতে পড়ে প্রচণ্ড শীতে মারা পড়েন জাহিদুল।
জাহিদুলের মা শাহিদা খাতুনের (৬৫) দাবি, তার ছেলে চোরাচালানে যুক্ত ছিলেন না। তবে কী কারণে জাহিদুল সীমান্তনদীতে গিয়েছিলেন, সেই প্রশ্নের জবাব নেই শাহিদার কাছে।
আমার দেশ প্রতিবেদক জাহিদুলের বাড়িতে থাকাবস্থায় সেখানে হাজির হন বেনাপোল পোর্ট থানার উপ-সহকারী পরিদর্শক (এএসআই) আবুল বাশার। তিনি জানান, একটি মাদক মামলায় জাহিদুলের নামে থানায় ওয়ারেন্ট রয়েছে। পরিবার-সদস্যদের তিনি অনুরোধ করেন, জাহিদুল যে মারা গেছেনÑ এই কথাটি থানায় গিয়ে জানিয়ে আসতে। এক প্রশ্নের জবাবে এএসআই আবুল বাশার বলেন, ‘আমরা শুনেছিলাম বিএসএফের হাতে জাহিদুল মারা গেছে। এর বেশি কিছু জানি না।’
স্থানীয়রা জানালেন, নেশাসক্ত জাহিদুল ছিলেন শারীরিকভাবে দুর্বল। কনকনে শীতে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর তাড়া খেয়ে নদীতে পড়ে তিনি আর উঠতে পারেননি।
স্বামীর অপমৃত্যুর পর জাহিদুলের স্ত্রী সুমাইয়া বাপের বাড়িতে চলে গেছেন। মৃত জাহিদুলের তিন ভাই। একজন বেনাপোল মাছবাজারের শ্রমিক, একজন ইজিবাইক চালক, আরেকজন রাজমিস্ত্রির সহকারী। একমাত্র বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। মাছবাজারের শ্রমিক হাফিজুল গাজীর শারীরিক অবস্থা ভীষণ দুর্বল। ঠিকমতো কাজ করতে পারেন না। ফলে অর্ধাহারে-অনাহারে জীবন কাটে তাদের। আমার দেশ প্রতিবেদকের কাছে তার বিনীত অনুরোধ, ‘আমাদের বাঁচার একটা ব্যবস্থা করে দেন।’ মা শাহিদা খাতুন আফসোস করে বলছিলেন, ‘২০০৪ সালে বিধবা হয়েছি। আজ পর্যন্ত কেউ একটা বিধবা কার্ডও করে দিল না।’
গত বছর ১৭ ডিসেম্বর গভীর রাতে বেনাপোল পোর্ট থানার পাচভুলোট-পুটখালি এলাকায় বাংলাদেশি তিন নাগরিককে নির্মমভাবে হত্যা করে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা। স্বজনদের বরাত দিয়ে সে সময় বাংলাদেশের গণমাধ্যম খবর দেয়, বিএসএফ পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করেছে তাদের। যদিও বিএসএফ এই অভিযোগ অস্বীকার করে। পোর্ট থানা পুলিশ সে সময় জানিয়েছিল, বিএসএফ তাদের পিটিয়ে মেরেছে বলে স্বজনরা অভিযোগ করেছেন।
সেদিনের ঘটনায় প্রাণ হারানোদের মধ্যে একজন বেনাপোলের কাগজপুকুর এলাকার জাহাঙ্গীর মোড়ল (৩৫)। বাংলাদেশি স্ত্রীর সঙ্গে ছাড়াছাড়ি হওয়ার পর ভারতে গিয়ে কলকাতা শিয়ালদহে দিনমজুরি করতেন তিনি। সেখানে তার স্ত্রী-সন্তান আছে।
জাহাঙ্গীরের ভাই মো. আলমগীর মোড়ল বলেন, ‘সীমান্ত থেকে বেশ দূরে বাংলাদেশের ভূখণ্ডে নাসিরের খাটালের কাছে আমার ভাই আধমরা অবস্থায় পড়ে ছিল। তার বুক, হাত ও মাথায় আঘাত ছিল। এক হাত ভাঙা ছিল। কপালে গভীর গর্ত ছিল, তবে তা গুলির না। হাসপাতালে নেওয়ার পর তার মৃত্যু হয়।’
স্ত্রী শিল্পী আক্তারের সঙ্গে আগেই ছাড়াছাড়ি হয়ে যাওয়া মৃত জাহাঙ্গীরের একমাত্র মেয়ে সুইটি আক্তার শার্শা সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী। মানবিক বিভাগের এই ছাত্রীর শ্রেণি রোল নম্বর ৩। ভ্যানচালক মামা আব্দুর রহিম তাকে মানুষ করছেন।
শিল্পী আক্তার স্বামী জাহাঙ্গীরকে কোর্টে তালাক দিয়ে প্রায় দশ বছর ভারতের মুম্বাই নগরীতে থাকেন। ৭/৮ দিন হলো দেশে ফিরেছেন। আমার দেশকে তিনি বলছিলেন, ‘স্বামীর সংসার করতে পারিনি। একমাত্র মেয়েকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য দেশ ছাড়ি। সেখানে বসেই খবর পাই মেয়ের বাবা বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে।’
ভাগ্নিকে আশ্রয় দেওয়া আব্দুর রহিম বলেন, ‘আমরা সুইটিকে যত্নেই রেখেছি। কিন্তু মা-বাবার অভাব তো পূরণ করা যায় না।’
সুইটিরও একই কথা। মেধাবী এই মেয়েটি লেখাপড়া চালিয়ে যেতে চায়। কিন্তু পারিপার্শ্বিক অবস্থা ও পারিবারিক সীমাবদ্ধতা অনুধাবন করার মতো বুদ্ধি হয়েছে তার। ফলে সে মনে করে, লেখাপড়ায় আর বেশিদূর এগোনো যাবে না। হয়তো তাড়াতাড়ি বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হবে।
ঝাল-মুড়ি বিক্রেতা সাবুর আলীর স্ত্রী মোছাম্মৎ হাসির জীবনের সব হাসি শেষ হয়ে যায় ওই ১৭ ডিসেম্বর। সেদিন আরো দুজনের সঙ্গে নির্মম হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন সাবু। হাসি সেই রাতের বর্ণনা দিতে গিয়ে বলছিলেন, ‘রাত তিনটার দিকে খারাপ খবর পাই। সীমান্তের পুটখালি মাঠে যখন স্বামীকে আহত উলঙ্গ অবস্থায় পাই, তখনও সে বেঁচে ছিল। ভ্যানে উঠিয়ে বাড়িতে আনি। হাসপাতালে নেওয়ার প্রস্তুতির সময় সে মারা যায়। তার সারা গায়ে আঘাতের চিহ্ন ছিল। এক হাত ভেঙে দিয়েছিল খুনিরা।’
‘বাড়ি থেকে আমি সব গুছিয়ে দিতাম। স্বামী বেনাপোল বাজারে ভ্যানে করে ঝাল-মুড়ি বিক্রি করত। ভালোই ছিলাম। স্বামীর মৃত্যুর পর বস্তির ঘরে উঠেছি। বাসাবাড়িতে কাজ করে দুটো বাচ্চার মুখে খাবার তুলে দিই’, বলছিলেন হাসি।
১৭ ডিসেম্বরের ঘটনার আরেক শিকার বেনাপোলের দীঘিরপাড় এলাকার কিশোর সাকিবুর। অল্প বয়সি এই ছেলেটিকে যেভাবে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়, তা বর্ণনাতীত। ওই এলাকার জিহাদ হাসান জানান, সাকিবুরের একটি চোখ তুলে ফেলেছিল হত্যাকারীরা। এলাকাবাসীর প্রশ্ন, সীমান্ত এলাকায় যাওয়া কি অপরাধ? সাকিবুর তো সীমান্ত পাড়ি দেয়নি।
সুইটি, আলমগীর, হাসি তাদের স্বজনদের নির্মম হত্যার রহস্য উদ্ঘাটনের দাবি জানান। একই সঙ্গে অসহায় পরিবারগুলোর জন্য সরকারি সহায়তা প্রত্যাশা করেন।