Image description

‘আওয়ামী দোসরদের ঠাঁই নাই’ স্লোগান দিয়ে সোমবার রাতে রাজধানীর ধানমন্ডির একটি বাসায় হামলা ও ভাংচুর করা হয়। এর পর পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে ৩জনকে আটক করে। পরে এনসিপি নেতা হান্নান মাসুদের উপস্থিতিতে পরিবারের জিম্মায় মুচলেকা নিয়ে ওই তিনজন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতাকে ছাড়িয়ে আনা হয়। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থী শাহারিয়ার আলম সাম্যকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করা হয় গত ১৩ মে রাতে। সাম্য ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই ঘটনায় পুলিশ তাৎক্ষণিকভাবে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। এ নিয়ে ছাত্ররা আন্দোলন করছেন। প্রশ্ন উঠেছে, যারা মব তৈরিতে জড়িত, তাদের আইনের আওতায় আনতে পারছে না আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। সম্প্রতি রাজধানীতে মব সন্ত্রাসসহ দাবি আদায়ের নামে রাস্তা দখল করে আন্দোলনের বিরুদ্ধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে থাকলেও এর তেমন কোন প্রভাব পড়ছে না। পুলিশ কঠোর হস্তে এদের দমন করতে ব্যর্থ হওয়ায় দুর্ভোগ বাড়ছে সাধারন মানুষের।

অভ্যুত্থানের প্রায় ১০ মাস পরও পুলিশের বিরুদ্ধেই প্রতিদিন গড়ে একাধিক মব হচ্ছে। সর্বশেষ এপ্রিলে পুলিশের বিরুদ্ধেই ৩৭টি মব হয়েছে এবং মার্চে ৩৫টি। এই ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, পুলিশ কোনো আসামি গ্রেপ্তারের পর একদল মানুষ সংগঠিত হয়েছে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে বা পুলিশের ওপর হামলা করে আসামি ছিনিয়ে নিতে চাইছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কিংবা পুলিশ সদর দফতরের সঠিক মনিটরিংয়ের অভাব রয়েছে বলে অভিযোগ মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের। আইজিপি বাহারুল আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, শুধু পুলিশের একার পক্ষে মব বন্ধ করা কঠিন। এখানে সবার সম্মিলিত প্রয়াস দরকার।

অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মব জাস্টিসের নামে এ ধরনের অপরাধ বেড়ে যাওয়া, গণপিটুনি, হামলা, ভাঙচুর, লুটপাটসহ একের পর এক বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের ঘটনা ঘটছে। একদিকে যেমন ডাকাতি ও ছিনতাইয়ের ঘটনা বেড়েছে। সঙ্গে বেড়েছে মব সংস্কৃতির ঘটনাও। প্রায় প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও কিছু মানুষ সংঘটিত হয়ে নিজের হাতে আইন তুলে নিয়ে মবের ঘটনা সংঘটিত করছে, এতে বাড়ছে হত্যাকা-সহ নানা অপরাধ। ডাকাত-ছিনতাইকারীর পাশাপাশি অনেক সময় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষও ঘায়েল হচ্ছে এই মব জাস্টিসে। ফলে উদ্বেগ ছড়াচ্ছে নাগরিক সমাজে।

ডিএমপির রমনা বিভাগের ডিসি মাসুদ আলম বলেন, আওয়ামী লীগের দোসরদের ধরিয়ে দেয়ার নামে কোনো ধরনের মব সৃষ্টি করতে দেয়া হবে না। কারো বিষয়ে তথ্য থাকলে পুলিশকে জানাবেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা আমাদের দায়িত্ব, কাউকে সেই ভূমিকা নেওয়ার সুযোগ দেওয়া হবে না। যদি কেউ অপরাধ করে, তাহলে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবো। কিন্তু এভাবে কেউ নিজের হাতে আইন তুলে নিতে পারে না।

পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট থেকে ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ছয় মাসে দায়িত্ব পালনকালে পুলিশ সদস্যের ওপর হামলার ২২৫টি ঘটনার মধ্যে ৭০টি ছিল বড় ধরনের আক্রমণ। গত বছরের সেপ্টেম্বরে ২৪টি, অক্টোবরে ৩৪, নভেম্বরে ৪৯, ডিসেম্বরে ৪৩, জানুয়ারিতে ৩৮ এবং ফেব্রুয়ারিতে ৩৭টি হামলার ঘটনা ঘটেছে। পুলিশের এই পরিসংখ্যানের বাইরেও সড়কে পুলিশ সদস্যদের সঙ্গে বিরূপ আচরণের বিভিন্ন ঘটনা ঘটেছে। ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মব তৈরি করে হামলাগুলো করা হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে পেশাদার অপরাধী ও রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীরাও মব তৈরিতে ভূমিকা রাখছেন। এই মব তৈরি করে শুধু পুলিশের ওপরেই হামলা হচ্ছে তা নয়, বরং কোথাও কোথাও সাধারণ মানুষের ওপরও হামলা বা গণপিটুনির ঘটনা ঘটছে। বাংলাদেশে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দলবদ্ধভাবে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে আইন নিজের হাতে তুলে নেওয়ার ঘটনা বেড়েছে।

রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় গত ৪ মার্চ ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে ইরানের দুই নাগরিককে মারধর করে একদল ব্যক্তি। এতে ওই দুজন আহত হন। তাদের উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে পুলিশ। পুলিশের ভাষ্য, ইরানের এই দুই নাগরিক ছিনতাইকারী ছিলেন না। বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ে তর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন তারা। একপর্যায়ে ছিনতাইকারী তকমা দিয়ে তাদের মারধর করা হয়। সম্প্রতি গুলশানে একটি বাড়িতে আওয়ামী লীগের এক নেতার টাকা লুকানো আছে বলে প্রচার করে সেই বাড়িতে জনতা তল্লাশি চালায়। সেখানে কিন্তু পুলিশ খোঁজ নিয়ে জেনেছে এই ঘটনার সঙ্গে ওই বাড়িতে কাজ করতেন তারাই জড়িত। পরে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আবার ফিলিস্তিনিদের পক্ষে আন্দোলনের সময় সিলেটসহ বেশ কিছু জায়গায় কিছু প্রতিষ্ঠানে লুটপাট হয়েছে। তখন কিন্তু আইন শৃঙ্খলা বাহিনী ৬০-৭০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর ইনকিলাবকে বলেন, কেউ অন্যায় করলে বা অপরাধী হলে দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী তার বিচারের বিধান রয়েছে। আইন নিজের হাতে তুলে নেয়ার কোনো সুযোগ কারও নেই। কোনো ব্যক্তি অন্যায় কিংবা অপরাধ করলে তাকে আইনের হাতে সোপর্দ করতে হবে। কোনোভাবেই আইন নিজের হাতে তুলে নেয়া যাবে না। কোনো ব্যক্তি অন্যায় বা অপরাধের মুখোমুখি হলে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯-এ অথবা কাছের থানায় যোগাযোগ করতে পারেন। পুলিশ দ্রুততার সঙ্গে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। পাশাপাশি মব মোকাবিলায় জনগণকেও আরও সচেতন হতে হবে।