
আওয়ামী লীগকে সুবিধা দিতে পুলিশ-প্রশাসনের ছত্রছায়ায় জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ভোটকেন্দ্র ও কক্ষ স্থাপনের বিতর্কিত নীতিমালা বাদ দিতে যাচ্ছে বর্তমান নির্বাচন কমিশন (ইসি)।
আগের কমিশনের অপরাধের দায় এড়াতে এএমএম নাসির উদ্দিন কমিশন নীতিমালা থেকে বিতর্কিত এ অংশ বাদ দিচ্ছে। ইসি এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছেছে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। এমনকি বিতর্কিত এ বিধান বাদ দিতে শিগগিরই কমিশন সভা ডাকার কথা রয়েছে। সেখানেই এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হবে বলে জানা গেছে।
খবরের সত্যতা স্বীকার করে নির্বাচন কমিশনের সিনিয়র সচিব আখতার আহমেদ আমার দেশকে বলেন, ভোটকেন্দ্র ও কক্ষ স্থাপন নীতিমালা অতীতে কীভাবে প্রণয়ণ করা হয়েছিল, তার তুলনামূলক (কমপারেটিভ) একটি খসড়া প্রস্তাবনা তৈরি করা হয়েছে। নীতিমালায় বিতর্কিত কিছু থাকলে কমিশন চাইলে তা বাদ দিতে পারে। কেননা নির্বাচনের কাজে কাউকে সুবিধা দিতে যদি কিছু প্রণয়ন করা হয়, তবে সেটি পরিবর্তন এবং এটিকে সর্বজনীন করার জন্য পরিবর্তন আনা উচিত। সেটাই করার চেষ্টা করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, কমিশন ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালা নিয়ে নিবিড় পর্যালোচনা করছে। সেখানে বিগত নবম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদের আগ পর্যন্ত প্রয়োজনীয় সংস্কারগুলো তারা খতিয়ে দেখেছে। নীতিমালা পর্যালোচনায় দেখা যায়, সব কমিশনই ভোটকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালায় কিছু কিছু সংযোজন-বিয়োজন করে। তবে সবচেয়ে বিতর্কিত ধারা যুক্ত করে আলোচনার জন্ম দেয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে পদত্যাগী কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন। আগের নীতিমালা থেকে গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ বাদ এবং বিতর্কিত কিছু সংযোজন করেছিল তার কমিশন।
কয়েকটি সংসদের নীতিমালা পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০০৮ সালে গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ, ১৯৭২-এর বিধান অনুসারে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের জন্য নির্বাচন কমিশনের ধার্যকৃত সময়সূচি অনুসারে ভোটকেন্দ্রের স্থান নির্ধারণ করা এবং কেন্দ্রের চূড়ান্ত তালিকা সরকারি গেজেটে প্রকাশ করার দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনের ওপর ন্যস্ত।
নবম সংসদে হুবহু রেখে শুধু গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশের ৮ অনুচ্ছেদে অংশটুকু যোগ করা হয়। পরের সংসদে আগের অংশ ঠিক রেখে ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচন অবাধ, নিরপেক্ষ ও সুষ্ঠুভাবে অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে সর্বোত্তম স্থানে কেন্দ্র স্থাপন অত্যাবশ্যক। ব্যক্তি, গোষ্ঠী, দলের প্রভাবহীন ও ভোটারদের ভোটদানের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা অনুযায়ী ভোটকেন্দ্রের স্থান নির্ধারণের ওপর সুষ্ঠু নির্বাচন বহুলাংশে নির্ভরশীল’- এ অংশ যুক্ত করা হয়।
নবম সংসদে নীতিমালার ১০ নম্বর ধারায় বলা হয়, ভোটকেন্দ্র স্থাপনের ক্ষেত্রে সহকারী রেজিস্ট্রেশন অফিসাররা ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের সময় প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ড পরিদর্শন করেন। কাজেই তাদের স্ব স্ব অধিক্ষেত্রের বিভিন্ন বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা থাকা স্বাভাবিক এবং সংশ্লিষ্ট এলাকায় ভোটকেন্দ্র স্থাপনের উপযোগী সরকারি ভবন সম্পর্কে জানা তাদের পক্ষে সম্ভব। তাই ভোটকেন্দ্রের তালিকা প্রণয়নে প্রয়োজনবোধে তাদের সহায়তা নেওয়া যেতে পারে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত বর্তমান কমিশন এ অংশ বাদ দেওয়ার চিন্তা করছে।
একই ভাবে নীতিমালায় নবম সংসদে ২৩ ও দশম সংসদে ২২ ধারার ভোটকেন্দ্রের স্থান নির্ধারণে ইসির নিরপেক্ষতা ও সাংবিধানিক ভাবমূর্তির প্রতি অবশ্যই লক্ষ রাখতে বলা হয়। কমিশনের নিরপেক্ষতার ভাবমূর্তি কোনোমতেই যেন বিন্দুমাত্র প্রশ্নের সম্মুখীন না হয়, সে বিষয়ে যত্নবান হতে হবে বলে উল্লেখ করা হয়। কিন্তু কেএম নুরুল হুদার মতো হাবিবুল আউয়ালের কমিশনও স্বেচ্ছায় এ অংশ পুরোপুরি বাদ দেয়। বরং রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ভোটকেন্দ্র স্থাপনের জন্য পুলিশ-প্রশাসনকে যুক্ত করে নতুন বিতর্কের জন্ম দেয়।
নীতিমালার ৪ নম্বর ধারায় মহানগর, জেলা, উপজেলা ও থানায় ভোটকেন্দ্র স্থাপনে কমিটি গঠন করার কথা বলা হয়। সেখানে বলা হয়, উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা, উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা, জেলা শিক্ষা কর্মকর্তা ও জেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তারা তাদের অধীন উপজেলা ও জেলার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর অবকাঠামোগত অবস্থা, কক্ষের সংখ্যা, স্থাপনার অবস্থান বা যাতায়াতব্যবস্থা- ইত্যাদি সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত থাকেন। অন্যদিকে পুলিশ সুপার, থানার অফিসার ইনচার্জ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ অন্যান্য স্থাপনার যাতায়াতব্যবস্থা ও সার্বিক নিরাপত্তাব্যবস্থা সম্পর্কে অবগত থাকেন। জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তারা জেলা ও উপজেলাপর্যায়ে সরকার ও ইসির নানাবিধ কার্যক্রমে মুখ্য সমন্বয়ক হিসেবে কাজ করেন। তাই উপজেলা ও জেলাপর্যায়ে এ কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করে তাদের মতামতের ভিত্তিতে ভোটকেন্দ্র স্থাপন কার্যক্রম অধিকতর সহজ ও সুষ্ঠু হবে বলে উল্লেখ করা হয়।
আবার ৪(১) নম্বর ধারায় উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের দায়িত্ব দেওয়া হয় শুধু গঠিত কমিটির সভায় খসড়া ভোটকেন্দ্রের তালিকা উপস্থাপন করা এবং সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসক (ডিসি) ও জেলা পুলিশ সুপারদের (এসপি) মতামত গ্রহণ করা। এ ছাড়া খসড়া এ তালিকা চূড়ান্ত করার আগে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তারা জেলায় ডিসির নেতৃত্বাধীন কমিটি এবং উপজেলায় ইউএনওর তত্ত্বাবধানে কমিটির কাছে পাঠাবেন। তারা যে কেন্দ্র চূড়ান্ত করবেন সেটিই গেজেটে প্রকাশ করা হবে। এ ধরনের বিতর্কিত ধারা যুক্ত করে পুরো নির্বাচন প্রক্রিয়াকে প্রশ্নের মুখে ফেলা হয়।
বর্তমান নির্বাচন কমিশনার মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার আমার দেশকে জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগ পর্যন্ত কমিশনের কর্মকর্তারা তাদের কাজের ধারাবাহিকতা ও অভিজ্ঞতার আলোকে ভোটকেন্দ্র ও কক্ষ নির্ধারণ করে এসেছেন। কিন্তু হঠাৎ বিগত কমিশন সেখানে পুলিশ-প্রশাসনকে যুক্ত করে ইসির করণীয় অন্যের কাঁধে চাপিয়ে দিয়ে নীতিমালা প্রণয়ন করে। আমরা কারো বিতর্কিত সিদ্ধান্তের দায় নেব না। তাই দ্বাদশ সংসদে বিতর্কিত অংশগুলো বাদ দেওয়া হতে পারে।
বিগত তিনটি কমিশন নিরপেক্ষ ছিল না বলে মন্তব্য করেন সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার। তিনি বলেন, ভোটকেন্দ্র স্থাপনে বিতর্কিত নীতিমালা প্রণয়ন করে যে ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের এমপিদের ভোট কাটতে সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল, তাতে অবিলম্বে পরিবর্তন আনা দরকার। এ কাজগুলো নিরপেক্ষতার সঙ্গে করা উচিত। এর মাধ্যমে নির্বাচন সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হবে।