
অবস্থানগত কারণে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল পলিপ্রবণ। নিয়মিত ড্রেজিং করলে বন্দর চ্যানেলে জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ সাড়ে নয় মিটার গভীরতা পাওয়া যায়। ভাটার সময় গভীরতা নেমে আসে ছয়-সাত মিটারে।
অবস্থানগত কারণে চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেল পলিপ্রবণ। নিয়মিত ড্রেজিং করলে বন্দর চ্যানেলে জোয়ারের সময় সর্বোচ্চ সাড়ে নয় মিটার গভীরতা পাওয়া যায়। ভাটার সময় গভীরতা নেমে আসে ছয়-সাত মিটারে। এ নাব্য সীমাবদ্ধতায় বন্দরে বড় জাহাজ ভিড়তে পারে না। এ সংকট ছাড়াও কাস্টমসে জটিলতা এবং দেশের অর্থনৈতিক হাবগুলোর সঙ্গে দুর্বল সংযোগ চট্টগ্রাম বন্দরকে আন্তর্জাতিক মান থেকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। এমন পরিপ্রেক্ষিতে তারা বলছেন, বন্দর পরিচালনায় যত দক্ষ প্রতিষ্ঠানই নিযুক্ত করা হোক না কেন, তারা বন্দরের কার্যক্ষমতা খুব একটা বাড়াতে পারবে না।
সিঙ্গাপুর বন্দরে ভিড়তে সক্ষম জাহাজের ড্রাফট বা গভীরতা (জাহাজের যে অংশ পানির নিচে থাকে) ১৬ মিটার পর্যন্ত। শ্রীলংকার কলম্বো বন্দরের সর্বোচ্চ অনুমোদিত ড্রাফট বা গভীরতা ১৮ মিটার। ভিয়েতনামের সায়গন বন্দরে সাড়ে ১১ মিটার পর্যন্ত। অন্যদিকে দেশটির কাই মেপ বন্দর বর্তমানে বিশ্বের বৃহৎ কনটেইনার জাহাজ পরিচালনাযোগ্য একটি গভীর সমুদ্রবন্দর, যেখানে ১৬ থেকে ১৮ মিটার ড্রাফটের জাহাজ অনায়াসে প্রবেশ করতে পারে। আর বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বন্দরের সর্বোচ্চ গভীরতা সাড়ে নয় মিটার এবং যা কেবল জোয়ারের সময়ই পাওয়া যায়।
বর্তমান বিশ্বে সমুদ্রপথে পণ্য পরিবহনে ব্যবহৃত হয় বড় আকারের জাহাজ, যেগুলোর প্রতিটি ১০ থেকে ২০ হাজার পর্যন্ত একক কনটেইনার পরিবহনে সক্ষম। এ ধরনের জাহাজ চলাচলের জন্য ১২ থেকে ১৫ মিটার পর্যন্ত গভীরতা দরকার হয়। চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলের গভীরতা কম হওয়ায় এ ধরনের বড় জাহাজ প্রবেশ করতে পারে না। বাংলাদেশগামী বড় জাহাজগুলো তাই প্রথমে সিঙ্গাপুর বা কলম্বোর মতো বন্দরে নোঙর করে। সেখান থেকে ছোট জাহাজে পণ্য স্থানান্তর করা হয়, যেগুলোর ধারণক্ষমতা এক থেকে দুই হাজার একক কনটেইনার। আর এ প্রক্রিয়াটি সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল।
চাল, গম, চিনি, ভোজ্য ও জ্বালানি তেল, কয়লার মতো খোলা পণ্য নিয়ে আসা বড় আকারের কার্গো ভেসেলেরও সর্বনিম্ন ড্রাফট থাকে অন্তত ১২ মিটার। আবার এক ধরনের কার্গো ভেসেল আছে যাদের ড্রাফট ২৫ মিটার পর্যন্ত হয়। স্বভাবতই নিত্যপণ্যবাহী এসব জাহাজও চট্টগ্রাম বন্দরে ভিড়তে পারে না। মূলত এগুলো গভীর সমুদ্রে নোঙর করে এবং লাইটার জাহাজের মাধ্যমে সেগুলো থেকে পণ্য নিয়ে আসা হয় বন্দরে। ফলে দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া কিংবা ধর্মঘটের মতো নানা ইস্যুতে লাইটার জাহাজ বন্ধ থাকলে নিত্যপণ্যের সরবরাহ চেইনে প্রভাব পড়ে।
কর্ণফুলী নদীর মোহনায় চট্টগ্রাম বন্দর চ্যানেলের প্রশস্ততা ও গভীরতা—দুটোই সময়ের সঙ্গে কমেছে। নিয়মিত ড্রেজিং না করলে জেটিমুখে পলি জমে বন্দরে জাহাজ চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। নাব্য হারিয়ে চট্টগ্রামসহ এ অঞ্চলের অনেক সমুদ্রবন্দর একসময় অভ্যন্তরীণ নৌবন্দরে রূপ নিতে পারে বলে উঠে এসেছে নেদারল্যান্ডস ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল রিলেশনসের (ক্লিঙ্গেন্ডেল) প্রতিবেদনেও।
চট্টগ্রাম বন্দরের কোনো ভবিষ্যৎ নেই বলে মন্তব্য করেছেন পানিসম্পদ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত। বণিক বার্তাকে তিনি বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের নাব্য সমস্যার স্থায়ী সমাধানের সুযোগ এখন আর নেই। বর্তমানে ২৬-২৭ ফুট (আট মিটারের মতো) গভীরতা পাওয়া যায়। নদীর যে অংশে বাঁক রয়েছে, সেখান থেকে চট্টগ্রাম ইপিজেড দিয়ে কেটে চ্যানেলের গতিপথ পরিবর্তন করে দিতে পারলে একটা স্থায়ী সমাধান করা যেত। অবকাঠামো গড়ে ওঠায় এ পদক্ষেপটিও এখন আর বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। বলা যায় ৫০ বছর আগেই এ সুযোগ শেষ হয়ে গেছে। নাব্য সংকটের কারণে ভারতের কলকাতা এখন পরিণত হয়েছে স্থানীয় নৌবন্দরে, একই অবস্থা নারায়ণগঞ্জ বন্দরেরও। চট্টগ্রাম বন্দরও এমন পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে।’
এ বিশেষজ্ঞ আরো বলেন, ‘নাব্য বাড়ানোর সুযোগ না থাকায় বন্দর পরিচালনার জন্য যত দক্ষ অপারেটর নিয়োগ করা হোক না কেন, বড় জাহাজ প্রবেশ করতে পারবে না। আর বড় জাহাজ যদি বন্দরে প্রবেশ করতে না-ই পারে, তাহলে বন্দরের সক্ষমতা বাড়বে কীভাবে?’
চট্টগ্রাম বন্দরকে সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে আলোচনায় এনেছে এর টার্মিনাল পরিচালনায় বিদেশী অপারেটর নিয়োগের উদ্যোগ। নিউমুরিং টার্মিনালটি বিদেশী অপারেটরের হাতে ছেড়ে দেয়ার সিদ্ধান্তটি ২০২৩ সালে নিয়েছিল তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। আর সে কাজটিই সম্পন্ন করছে অন্তর্বর্তী সরকার। চট্টগ্রাম বন্দরকে দক্ষিণ এশিয়ার বিজনেস হাব হিসেবে তৈরির পরিকল্পনার কথা বলা হচ্ছে সরকারের পক্ষ থেকে। প্রতিবেশী দেশগুলোর জন্য এ বন্দর ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে বলে সম্প্রতি প্রধান উপদেষ্টাও জানিয়েছেন।
চট্টগ্রাম বন্দরকে ‘বাংলাদেশের অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড’ উল্লেখ করে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘এ হৃৎপিণ্ডকে আমাদের প্রতিবেশীদের সঙ্গে সংযুক্ত করতে হবে। এজন্য আমি নেপাল ও ভারতের সাতটি উত্তর-পূর্ব রাজ্যের (সেভেন সিস্টার্স) কথা বলেছি। যদি এতে যুক্ত হয়, তারা উপকৃত হবে, আমরাও হব। আর যারা যুক্ত হবে না, তারা পিছিয়ে পড়বে।’ সে জন্য তিনি বন্দরের পরিচালনার দায়িত্ব বিশ্বের শীর্ষ অপারেটরদের হাতে তুলে দেয়ার কথা বলেন।
বন্দর বিশেষজ্ঞরা অবশ্য বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা বাড়ানোর সুযোগ খুব একটা নেই। বিদেশী প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিলেও বন্দরের উৎপাদনশীলতায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসবে না। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দরের সাবেক পর্ষদ সদস্য জাফর আলম বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দরের সক্ষমতা কেবল তার জেটি বা গ্যান্ট্রি ক্রেন দিয়ে নির্ধারণ করলেই হবে না। একটি কার্যকর মাল্টিমোডাল কানেক্টিভিটি না থাকলে বন্দর কখনই আঞ্চলিক হয়ে উঠতে পারে না। বিশ্বমানের টার্মিনাল অপারেটর এনে দক্ষতার সঙ্গে পণ্য ওঠা-নামার কাজটা এগিয়ে নেয়া যাবে। কিন্তু এখানকার দুর্বল অবকাঠামো দিয়ে বন্দরের উৎপাদনশীলতা খুব একটা বাড়ানো সম্ভব নয়।’
ভিয়েতনামের বন্দরে দিনে দিনেই পণ্য খালাস হয়। শ্রীলংকার কলম্বো বন্দরে পণ্য খালাসে গড়ে সময় লাগে তিনদিন। সিঙ্গাপুরে দুদিনের মধ্যেই কাস্টমস, ক্লিয়ারিং, ডেলিভারির মতো কাজ শেষ হয়ে যায়। কলম্বো ও সিঙ্গাপুরে ট্রান্সশিপমেন্ট কার্যক্রম পরিচালনার কারণে তুলনামূলক বেশি সময় লাগে। অন্যদিকে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্যানুযায়ী, চট্টগ্রাম বন্দরে একটি কনটেইনার খালাসে গড়ে সময় লাগে ৭-১০ দিন। নাব্য সংকট ছাড়াও চট্টগ্রাম বন্দরের কাস্টমস কার্যক্রমের দুর্বলতা এবং দেশের অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর ভালো সংযোগ না থাকাও উৎপাদনশীলতা কমাচ্ছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর, সাভার বা কুমিল্লার মতো রফতানি হাবগুলোয় পণ্য আনা-নেয়ার আলাদা কোনো পথ নেই। খালাস হওয়া কনটেইনার সড়কপথে গন্তব্য পর্যন্ত পৌঁছাতে আরো অন্তত দুদিন সময় লেগে যায়, যা আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়।
চট্টগ্রাম বন্দরের অবকাঠামো-ব্যবস্থাপনাগত দুর্বলতা এবং প্রয়োজনীয় কানেক্টিভিটির অভাবে দেশের আমদানি-রফতানি কার্যক্রমে বিরূপ প্রভাব পড়ার কথা জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, পণ্য উৎপাদন করতে যে সময় লাগছে, তার দ্বিগুণেরও বেশি লেগে যাচ্ছে শিপমেন্টে। এ বিষয়ে প্যাসিফিক জিন্স গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মোহাম্মদ তানভীর বণিক বার্তাকে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বন্দর থেকে ঢাকার মধ্যে পণ্য পরিবহনের আলাদা কোনো এক্সপ্রেস লজিস্টিক করিডোর নেই। সাধারণ যানবাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বন্দরের মালপত্র পরিবহন করা হয়। রেলভিত্তিক কনটেইনার পরিবহনের সুযোগও সীমিত।’ বিশ্বমানের অপারেটর নিয়োগের পরিবর্তে বরং সরকারের এসব বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া উচিত বলে মনে করেন এ ব্যবসায়ী।
বন্দর কর্তৃপক্ষ যদিও বলছে, চট্টগ্রাম বন্দরের সীমাবদ্ধতা দূর করতে গড়ে তোলা হচ্ছে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর। এ গভীর সমুদ্রবন্দরকে রিজিওনাল ট্রান্সশিপমেন্ট হাব হিসেবে রূপ দিতে বাস্তবায়নকারী সংস্থা হিসেবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ কাজ করে যাচ্ছে। এ প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল সৈয়দ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘২০২৯ সালে মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরের অপারেশন শুরু হবে। আর এ বন্দরটি চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের সীমাবদ্ধতাগুলো দূর হয়ে যাবে।’
চট্টগ্রাম বন্দরের চেয়ারম্যান মাতারবাড়ী নিয়ে আশার বাণী শোনালেও ব্যবসায়ীরা বলছেন, মাতারবাড়ীর সঙ্গে দেশের অর্থনৈতিক হাবগুলোর কানেক্টিভিটি উন্নত করতে না পারলে এ বন্দরটিও খুব একটা কাজে আসবে না। এ প্রসঙ্গে বিএসআরএম গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আমের আলীহুসাইন বণিক বার্তাকে বলেন, ‘মাতারবাড়ী বন্দর একটি সম্ভাবনাময় স্বপ্ন। কিন্তু সেটিকে বাস্তবে রূপ দিতে হলে কেবল ড্রাফট ও জেটি নয়, মাল্টি-লেভেল কানেক্টিভিটি, স্টেকহোল্ডারদের সমন্বয়, দক্ষ জনবল, নিরবচ্ছিন্ন অপারেশনাল কাঠামো, আন্তর্জাতিক বাণিজ্য-সমঝোতা—এ সবকিছুর ভিত্তিতে গভীর পরিকল্পনা দরকার। এখন আমরা যদি দেখি পণ্যের চালান মাতারবাড়ী থেকে কারখানায় পৌঁছতে গড়পড়তা সময় ও খরচ দুই-ই বেড়ে যাচ্ছে, সেটা সহযোগিতার বদলে বরং ব্যবসার জন্য প্রতিবন্ধকতা হিসেবে দেখা দেবে।’