
দুই মাস ধরে আমরা ৩৩টি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনার মধ্য দিয়ে প্রথম পর্যায়ের আলোচনা শেষ করেছি। প্রথম পর্যায়ের আলোচনায় আমাদের লক্ষ্য ছিল, রাজনৈতিক দলগুলোর আলাদা আলাদা অবস্থানগুলো কী, তা জানা। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ১৫ ফেব্রুয়ারি যাত্রা শুরু করে। শুরুতেই সব রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। যেখানে প্রধান উপদেষ্টা এবং জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের প্রধান অধ্যাপক ইউনূস উপস্থিত ছিলেন, তিনি বক্তব্য দিয়েছেন।
আমাদের দিক থেকে লক্ষ্য ছিল, ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নেওয়া। আমরা পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদনগুলোর পাশাপাশি সারসংক্ষেপ এবং স্প্রেডশিট আকারে দলগুলোর কাছে পাঠিয়েছিলাম। তাঁরা শুধু স্প্রেডশিটে সীমিত ছিলেন না, বিস্তারিত মতামত দিয়েছেন। এরপর আমরা দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছি, দলগত অবস্থানটা বুঝতে চেয়েছি।
এখন আমরা দলগত অবস্থানগুলো বুঝতে পেরেছি। অনেক বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য আছে। নীতিগত অবস্থানের দিক থেকে ঐকমত্য আছে, কোথাও কোথাও পদ্ধতিগত ক্ষেত্রেও আছে। কিন্তু কিছু বিষয়ে সবাই একমত নয়। এটাই স্বাভাবিক। প্রতিটি রাজনৈতিক দল তাদের অবস্থান-আদর্শ বিবেচনা করবে।
কিন্তু সংস্কারের ক্ষেত্রে বিশেষত, একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হলে ৫৩ বছর ধরে সংবিধান, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচার বিভাগ, জনপ্রশাসনে যে ত্রুটিগুলো দেখা যাচ্ছে, এই ত্রুটিগুলো দূর করার ক্ষেত্রে যে মতপার্থক্য, সেগুলো নিয়ে আরও কাছাকাছি আসা প্রয়োজন।
এখানে কয়েকটা বিষয় সুস্পষ্ট করে বলা দরকার, অনেক বিষয়ে আমরা ঐকমত্য দেখতে পেয়েছি, অনেকগুলো বিষয়ে নীতিগত জায়গা থেকে ঐকমত্য দেখতে পেয়েছি। যেমন বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। এ জন্য বিচারক নিয়োগপ্রক্রিয়া স্বচ্ছ করা, প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্রে দলীয় বিবেচনা যাতে না থাকে, যেন অ্যাটর্নি সার্ভিস স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে, বিচার বিভাগের একটি স্বাধীন সচিবালয় তৈরি করা—এগুলোর ক্ষেত্রে নীতিগতভাবে সবাই একমত।
দুর্নীতি দমন কমিশনকে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দেওয়ার জন্য আইনি প্রক্রিয়ায় পরিবর্তন দরকার, আবার দুদকেরও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা দরকার—সে ক্ষেত্রেও ঐকমত্য হয়েছে।
সংবিধানের ক্ষেত্রেও ঐকমত্য আছে, যেমন তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। একটা বড় বিষয় ছিল প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ (এক ব্যক্তি সর্বোচ্চ কতবার প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন) নির্ধারণ করা। এ ব্যাপারে নীতিগতভাবে প্রায় সব দলই একমত হয়েছে যে এটা করতে হবে। এখন কয়বার করবেন, কীভাবে করবেন, পদ্ধতিগত কিছু প্রশ্ন থেকে যাচ্ছে। কিন্তু নীতিগত অবস্থান এক জায়গায় আছে।
অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বলেছে, ক্ষমতার একধরনের ভারসাম্য তৈরি করতে হবে। কেউ বলছেন রাষ্ট্রপতির সঙ্গে করতে হবে, কেউ বলছেন প্রাতিষ্ঠানিকভাবে করতে হবে। এই ভারসাম্য তৈরির জন্য সংবিধান সংস্কার কমিশন জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাব করেছে। পাশাপাশি আমরা এটাও বলেছি, ভারসাম্য তৈরি করতে সংবিধানের ৪৮ (৩) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির কিছু দায়িত্ব সুনির্দিষ্ট করে দেওয়া হোক। বাকি বিষয়গুলোর ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ নিতে হবে। কারণ, নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব আছে, তাঁকে শাসন করতে হবে। গভর্ন্যান্সের বিষয় আছে, সে জায়গায় যেন প্রতিদিন সংকট তৈরি না হয়। আবার যেন এককভাবে ক্ষমতাটা প্রধানমন্ত্রীর হাতে না থাকে, সেই ব্যবস্থাও থাকতে হবে। কিন্তু কোন দায়িত্বগুলো রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হবে, এটা রাজনীতিবিদেরা সংসদে সিদ্ধান্ত নিন। আমরা এটা উন্মুক্ত রেখেছি।
আবার প্রায় সবাই একমত হচ্ছে যে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় কমিটি যেমন সরকারি হিসাব কমিটি, অনুমিত হিসাব কমিটি, সরকারি প্রতিষ্ঠান কমিটি—এগুলো বিরোধী দলের নেতৃত্বে থাকা উচিত। এটা কমবেশি সফল।
সংবিধানের একটা বড় বিষয় হচ্ছে ৭০ অনুচ্ছেদ। সবাই একমত হয়েছেন এই অনুচ্ছেদের পরিবর্তন জরুরি। সংবিধান সংস্কার কমিশন বলেছিল, অর্থবিল বাদে সব ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যরা ভোট দেওয়ার পূর্ণ স্বাধীনতা পাবেন। আলোচনায় দেখা যাচ্ছে, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ও ইতিহাস বিবেচনায় এখানে অর্থবিলের সঙ্গে আস্থা ভোটের বিষয়টিও রাখা দরকার। কেউ কেউ সংবিধান সংশোধনের বিষয়টিও এখানে রাখতে বলছেন। সংবিধান সংস্কার কমিশন চেয়েছিল যে সব সংসদ সদস্য যদি বিবেক দ্বারা তাড়িত হয়ে ভোট দিতে পারেন, তাহলে সম্ভবত প্রধানমন্ত্রীর ওপর একধরনের জবাবদিহির চাপ তৈরি হবে। কিন্তু আমরা রাজনৈতিক বাস্তবতা বুঝতে পারছি, আলোচনার মধ্য দিয়ে এটা এসেছে যে আস্থা ভোটের বিষয়টিও এখানে রাখা দরকার।
প্রথম পর্যায়ের আলোচনার সবচেয়ে বড় দিক হচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো তাদের অবস্থান থেকে বিভিন্ন বিষয় বলেছে। অনেক বিষয়ে ঐকমত্য আছে, কিছু বিষয়ে নেই। এই কিছু বিষয়ের মধ্যে কিছু কিছু মৌলিক বিষয়ও আছে—গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করা, জবাবদিহিমূলক রাষ্ট্র তৈরি করা, প্রধানমন্ত্রীর জবাবদিহির জায়গাটা করা, ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের কিছু কিছু জায়গা থেকে যাচ্ছে। সে কারণেই আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা করতে যাচ্ছি।
দ্বিতীয় পর্যায়ে আমরা বিষয়ভিত্তিকভাবে আলোচনা করব। এখন আমরা সবার রাজনৈতিক অবস্থান বুঝতে পারি। সবাই মিলে আলাপ করে দেখি, কিছু বিষয়ে আমরা এক জায়গায় আসতে পারি কি না। সব বিষয়ে সবাই একমত হবে, সেটা নয়। তবে অনেক বিষয়ে ইতিমধ্যে ঐকমত্য হয়েছে। অনেক বিষয়ে না হলেও কিছু বিষয়ে ভিন্নমত আছে। কিন্তু খুব যে দূরত্ব আছে, আমি তা মনে করছি না। আমি মনে করি, সবাই কাছাকাছি অবস্থানে আছে। শেষ মাইলটি অতিক্রম করতে হবে। শেষ মাইলটি অতিক্রমে দুই দিক থেকেই এগিয়ে আসতে হবে। এভাবে এগিয়ে এলে আমরা হয়তো এটা অর্জন করতে পারব। আমাদের সে চেষ্টা আছে।