Image description

যারা লুটপাটের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাত্ করেছেন, তাদের জব্দ করা টাকা ও শেয়ার দিয়ে একটি তহবিল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এ তহবিল গঠনের সরকারি উদ্যোগকে সময়োপযোগী ও ইতিবাচক হিসেবে দেখছেন বিশেষজ্ঞরা। তবে এর সফল বাস্তবায়নে প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামোর কথা যেমন বলা হচ্ছে, তেমনি ভবিষ্যতে কোনো রাজনৈতিক সরকারের আমলে এ তহবিলের কার্যকারিতা ও অর্থ পুনরুদ্ধারের সম্ভাব্যতা নিয়েও সংশয় রয়েছে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।

গত সোমবার এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, লুটপাটের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো এ তহবিল থেকে টাকা ফেরত পাবে। এই টাকা আমানতকারীদের ফেরত দিতে পারবে ব্যাংকগুলো। আর ব্যাংকঋণের বাইরে অবৈধ উপায়ে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দরিদ্র জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হবে।

এ প্রসঙ্গে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান ইত্তেফাককে বলেন, ‘এ ধরনের উদ্যোগ সরকার নিতে পারে। তবে এর জন্য প্রয়োজনীয় আইনি কাঠামো তৈরি করতে হবে। এটা একটি ভালো চিন্তা এবং সময়োপযোগী উদ্যোগ।’ তিনি আরো বলেন, ‘ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংকগুলো এই তহবিল থেকে অর্থ ফেরত পাবে, যা দিয়ে তারা আমানতকারীদের পাওনা মেটাতে পারবে। অন্যদিকে দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ দরিদ্র জনগণের কল্যাণে ব্যয় করা হলে তা হবে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।’ এদিকে দেশের বড় ১০টি ব্যবসায়ী গ্রুপ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পরিবারের বিরুদ্ধে ওঠা অর্থ পাচারের অভিযোগ তদন্ত করছে আন্তঃসংস্থা টাস্কফোর্সের আওতাধীন ১১টি টিম। এই দলে রয়েছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর), নেতৃত্ব দিচ্ছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। সমন্বয়ের দায়িত্বে রয়েছে বিএফআইইউ। শেখ হাসিনার পরিবারের বাইরে যে ১০ শিল্পগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে, সেগুলো হচ্ছে এস আলম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ, নাবিল গ্রুপ, সামিট গ্রুপ, ওরিয়ন গ্রুপ, জেমকন গ্রুপ, নাসা গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, সিকদার গ্রুপ ও আরামিট গ্রুপ।

তবে তহবিল গঠনের এই উদ্যোগ কতটা ফলপ্রসূ হবে, তা নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম। তিনি ইত্তেফাককে বলেন, ‘সরকার দুর্নীতিবাজদের জব্দ করা টাকা ও শেয়ার দিয়ে তহবিল গঠনের কথা বলছে। কিন্তু বাস্তবে পাচার হওয়া অর্থ কতটা উদ্ধার করা যাবে, তা নিয়ে সন্দেহ আছে। এই তহবিলের মাধ্যমে কিছু রাজনৈতিক বাহ্বা পাওয়া যেতে পারে, তবে এটি কতটা শক্তিশালী হবে, তা নিয়ে যথেষ্ট সংশয় রয়েছে।’

ড. মইনুল আরো বলেন, ‘পাচার করা অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনা মোটেও সহজ নয়। এই পুরো প্রক্রিয়াটিই অত্যন্ত জটিল এবং দীর্ঘমেয়াদি।’ তিনি বলেন, ‘এই উদ্যোগ বাস্তবায়নে স্বচ্ছতা, কঠোর আইন প্রয়োগ ও রাজনৈতিক সদিচ্ছার সমন্বয় নিশ্চিত করা না গেলে তা শুধু কাগজে কলমেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারে।’

ঐ সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম জানান, মাঝারি আকারের আরো ১২৫টি অনিয়ম তদন্তের আওতায় আসছে, যারা ২০০ কোটি টাকার বেশি অর্থ লুট করেছে। সরকার ২০টি বিদেশি আইনি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করছে। এখন এসব প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কী কাজ হবে, তার কার্যপরিধি ঠিক করা হচ্ছে।

জব্দ করা অর্থ ও সম্পদ দিয়ে তহবিল গঠন করা হচ্ছে জানিয়ে গভর্নর বলেন, সরকার প্রথম বারের মতো এ ধরনের একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ জব্দ করা অর্থ ও সম্পদ এরই মধ্যে সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসেছে। দ্রুততম সময়ের মধ্যেই এ তহবিলের কার্যক্রম শুরু করা সম্ভব হবে। প্রয়োজনে আইনে পরিবর্তন আনা হবে। ব্যাংকের টাকা ব্যাংককে ফেরত দেওয়া হবে। অন্য খাত থেকে যেসব অর্থ আত্মসাত্ করা হয়েছে, তা জনহিতকর কাজে ব্যয় করা হবে।

তিনি বলেন, ইসলামী ব্যাংকের ক্ষেত্রে এস আলম গ্রুপের ১২-১৫ হাজার কোটি টাকার শেয়ার জব্দ করা হয়েছে। এই শেয়ার একটি স্ট্র্যাটেজিক বিনিয়োগকারীর কাছে হস্তান্তর করা হবে। সেখান থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যাংক পাবে, যা আমানতকারীদের ফেরত দেওয়ার কাজে ব্যবহার করা হবে। এভাবে অর্থ পাওয়া সম্ভব হবে।

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী আহসানুল করিম ইত্তেফাককে বলেন, এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে আইনগত কোনো অসুবিধা নেই। বিপুল পরিমাণ অর্থ লুট বা পাচার হওয়ায় ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়ে পড়েছে। সেই পাচার বা লুট হওয়া অর্থ ফিরিয়ে এনে যদি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ফেরত দেওয়া যায়, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াবে। তিনি বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সরকারের কিছু নীতি প্রণয়ন করা দরকার। যারা অর্থ পাচার করেছে, তারা যদি নিজ ইচ্ছায় অর্থ ফেরত নিয়ে আসে, তাহলে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ট্যাক্স হিসেবে আরোপ করা উচিত। এতে সরকার লাভবান হবে। আহসানুল করিম বলেন, পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ক্ষেত্রে অনেক রাষ্ট্র সহায়তা করতে পারে। আবার অনেক রাষ্ট্র সহায়তা না-ও করতে পারে। কারণ পাচার হওয়া অর্থে বিদেশি অনেক রাষ্ট্র লাভবান হয়েছে।

ঐ সংবাদ সম্মেলনে শফিকুল আলম জানান, যারা তদন্তের আওতায় এসেছেন, তাদের ১ লাখ ৩০ হাজার ৭৫৮ কোটি টাকার স্থাবর সম্পদ সংযুক্ত করা হয়েছে। পাশাপাশি ১৬ কোটি ৪০ লাখ মার্কিন ডলার বিদেশে এবং ৪২ হাজার ৬১৪ কোটি টাকার অস্থাবর সম্পদ জব্দ করা হয়েছে।