
সব হিসাব-নিকাশ আর জল্পনা-কল্পনার অবসান হতে চলেছে আজ। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে নিজে থেকে সরে দাঁড়াচ্ছেন বহুল আলোচিত পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন। তার বিদায়টি ‘অস্বাভাবিক’ হলেও এটি যেন ‘অসম্মানজনক’ না হয় তা নিশ্চিত করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের নীতিনির্ধারকরা। দায়িত্বশীল সরকারি সূত্র বলছে, পদত্যাগ করতে যাওয়া পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনকে উত্তর আমেরিকায় রাষ্ট্রদূত করে পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে।
মঙ্গলবার এ সংক্রান্ত ফাইল অনুমোদন করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূস। সেই সঙ্গে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সামলানোর জন্য আপাতত দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ক্রাইসিস ম্যানেজার খ্যাত ১৫ ব্যাচের কর্মকর্তা রাষ্ট্রদূত ড. নজরুল ইসলামকে। পরবর্তী পররাষ্ট্র সচিব (নতুন নিয়োগ) যোগদানের আগ পর্যন্ত ড. ইসলাম রুটিন দায়িত্ব পালন করবেন। দেশের ২৮তম পররাষ্ট্র সচিব নিয়োগের ফাইলেও প্রধান উপদেষ্টা অনুমোদন দিয়েছেন বলে সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সূত্র মতে, দু’টি ফাইল বগলদাবা করে সরকার প্রধানের কাছে নিয়ে যান পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। সিল-সই তথা চূড়ান্ত অনুমোদনের পর একই কায়দায় তা ফিরিয়ে এনে নিজ দপ্তরের ভল্টে (সিন্দুকে) তালাবদ্ধ করে রেখেছেন মিস্টার হোসেন। আজ এ সংক্রান্ত বাকি ওয়ার্ক অর্ডার এবং তা নিয়ে উপদেষ্টা গণমাধ্যমের মুখোমুখি হতে পারেন বলে আভাস মিলেছে। উল্লেখ্য ‘বিদায়ের মুডে পররাষ্ট্র সচিব/হ-য-ব-র-ল সেগুনবাগিচা’ শিরোনামে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অচলাবস্থা নিয়ে সর্বপ্রথম রিপোর্ট করে মানবজমিন। গত ১৪ই মে প্রকাশিত সেই রিপোর্টে সরকারের দায়িত্বশীল একাধিক সূত্রের উদ্ধৃতি ছিল। বলা হয়েছিল পররাষ্ট্র সচিব পদে পরিবর্তন অত্যাসন্ন। ৮ মাসে অনেকটা ‘তালগোল’ পাকিয়ে ফেলেছেন পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিন! তাই তাকে বিদায় দিয়ে নতুন কাউকে সচিব পদে পদায়নের নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়েছে। চলতি মাসের শুরুতে গুরুত্বপূর্ণ ওই রদবদল বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের মৌখিক নির্দেশনা বজ্রপাতের মতো এসে পড়ে সেগুনবাগিচায়। মুহূর্তেই তা ছড়ায় এক বিল্ডিং থেকে অন্য বিল্ডিংয়ে। যার প্রভাব পড়ে মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম বিশেষ করে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে যোগাযোগ তথা সম্পর্কে। অন্তর্বর্তী সরকারের আচমকা এমন সিদ্ধান্ত স্বভাবতই ব্যথিত করে জসীম উদ্দিনকে। ঘনিষ্ঠ মহলে তিনি এমন প্রতিক্রিয়াই ব্যক্ত করেন। পেশাগত জীবনের একেবারে শেষলগ্নে থাকা মিস্টার উদ্দিন বিষয়টির ‘সম্মানজনক’ সুরাহা চান। তার ঘনিষ্ঠরা তখন জানান, পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের বিষয়টি জানাজানির পর থেকে ‘মনমরা’ অবস্থায় রয়েছেন জসীম উদ্দিন। তিনি মন্ত্রণালয়ে অফিস করছেন অনেকটা ‘না করার’ মতো। তিনি কারও সঙ্গে তেমন দেখা-সাক্ষাৎ করছেন না, বৈঠকাদিতেও অংশ নিচ্ছেন না। সচিবের নির্লিপ্ততার প্রভাব পড়ে জাপানের সঙ্গে এফওসিতে। উল্লেখ্য, আগামী ২৮শে মে জাপান সফরে যাচ্ছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। হাই প্রোফাইল ওই সফরের প্রস্তুতিমূলক আলোচনা ও দ্বিপক্ষীয় অন্যান্য বিষয় নিয়ে গত ১৫ই মে টোকিওতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের পূর্ব নির্ধারিত বৈঠক (ফরেন অফিস কনসালটেশন বা এফওসি) হয়। ওই বৈঠকে নেতৃত্ব দেয়ার কথা ছিল পররাষ্ট্র সচিব মো. জসীম উদ্দিনের। কিন্তু নিজের চেয়ার নিয়ে অনিশ্চয়তায় অর্থাৎ যেতে পারছেন না বলে এফওসি স্থগিত করে দেন তিনি। যা নিয়ে ঢাকা-টোকিও ভুল বোঝাবুঝি হয়। অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের হস্তক্ষেপে জরুরিভিত্তিতে এফওসি স্থগিত সংক্রান্ত চিঠি (নোট ভারবাল) প্রত্যাহার এবং ১৫ই মে টোকিওতে এফওসি হয়। পররাষ্ট্র সচিব জসীম উদ্দিনের বদলে সেই বৈঠকে মন্ত্রণালয়ের সচিব (পূর্ব) ড. নজরুল ইসলামকে পাঠানো হয়। ওয়াকিবহাল সূত্র তখন জানায়, উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সচিব পদে পরিবর্তনে সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্ত, পররাষ্ট্র সচিবের মর্যাদা এবং ব্যক্তি জসীম উদ্দিনের ক্যারিয়ারÑ সব কিছুর মধ্যে একটি সমন্বয়ের দায়িত্ব নেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন। এ নিয়ে একাধিক বিকল্প প্রস্তাব ছিল তখন আলোচনার টেবিলে। এক. পররাষ্ট্র সচিবের পদ থেকে নিজে থেকে সরে দাঁড়ানো, এটা ছুটি বা অন্যভাবে। দুই. তাকে একটি দেশে রাষ্ট্রদূত পদে পদায়ন। ৩. আপাতত তাকে ফরেন সার্ভিস একাডেমির রেক্টর (শূন্য) পদে বদলি। স্মরণ করা যায়, ছাত্র-জনতার রক্তাক্ত অভ্যুত্থানের পর বেশ তড়িঘড়ি করে নিয়োগ দেয়া হয় জসীম উদ্দিনকে। অনেকটা নিঃশব্দে গত বছরের ৮ই সেপ্টেম্বর তার নাম নতুন পররাষ্ট্র সচিব হিসেবে জুড়ে দেয়া হয় মন্ত্রণালয়ের অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে। তখনো তার নিয়োগ সংক্রান্ত অফিস আদেশের কপি প্রকাশ হয়নি। সব কিছু ঠিক থাকলে আগামী বছরের ১২ই ডিসেম্বর জসীম উদ্দিনের অবসরোত্তর ছুটি শুরু হওয়ার কথা।