
স্যাটেলাইটের মাধ্যমে ইন্টারনেট সেবাদাতা মার্কিন কোম্পানি স্টারলিংক বাংলাদেশে আনুষ্ঠানিকভাবে সেবা শুরু করেছে। আর খুব অল্প সময়ে আইনগত কাঠামো তৈরি করে স্টারলিংককে ব্যবসার সুযোগ তৈরি করে দেওয়াকে নিজেদের সাফল্য হিসেবে দেখছে অন্তর্বর্তী সরকার।
শুধু সাফল্য নয়, স্টারলিংক নিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা থেকে শুরু করে কর্তাব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় আগ্রহ ও উচ্ছ্বাস দেখিয়েছেন। স্টারলিংকের জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ‘তাড়াহুড়া’ এবং ‘অতি প্রচার’ চালানো হয়েছে বলেও অনেকে মনে করেন।
তবে তাড়াহুড়া বা প্রচার চালানোর বিষয়টি অস্বীকার করে প্রধান উপদেষ্টার আইসিটি বিষয়ক বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বিষয়টি অন্যভাবে দেখতে চান।
তিনি বলছেন, দেশের বিদ্যমান ইন্টারনেট সেবার মান খুবই খারাপ। এ অবস্থায় দেশের প্রত্যন্ত এলাকাতেও দ্রুতগতির মানসম্পন্ন ইন্টারনেট নিশ্চিত করতে পারে স্টারলিংক। ইন্টারনেট নিয়ে একসঙ্গে অনেকগুলো সমস্যার সমাধান হিসেবে স্টারলিংক নিয়ে সরকারের আগ্রহও উচ্ছ্বাস আছে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে আসা কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়, স্টারলিংকের ব্যবসা বাড়াতে মার্কিন প্রশাসন দেশে দেশে চাপাচাপি করছে।
গত ১৫ মে পুলিৎজার জয়ী অলাভজনক সংবাদ সংস্থা ‘প্রোপাবলিকা’র এক প্রতিবেদনেও এমন কিছু বিষয় উঠে আসে। প্রতিবেদনটির শিরোনাম ছিল, ‘আফ্রিকার দেশগুলোর দিকে নজর দিয়েছে ট্রাম্প প্রশাসন, লক্ষ্য ইলন মাস্কের জন্য ব্যবসা আনা।’
প্রতিবেদনে বলা হয়, মাস্কের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কোম্পানির ব্যবসা বৃদ্ধির জন্য প্রচার চালানোর পাশাপাশি চাপ দিচ্ছে স্টেট ডিপার্টমেন্ট।
সেখানে বাংলাদেশ প্রসঙ্গে বলা হয়, “বাংলাদেশে স্টারলিংকের কার্যক্রম চালুর পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কূটনীতিকরা সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। সাম্প্রতিক একটি কেবল বার্তায় উঠে এসেছে, বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের সঙ্গে ‘প্রায় শুরু থেকেই এবং বারবার’ স্টারলিংকের পক্ষে তদবির করেছেন তারা।
“পাশাপাশি স্টারলিংকের সঙ্গে যৌথভাবে তাদের বাংলাদেশি অংশীদারদের জন্য একটি ‘শিক্ষামূলক কৌশল’ তৈরিতে কাজ করেছেন এবং প্রতিষ্ঠানটির প্রধান ইলন মাস্কের সঙ্গে বাংলাদেশের সরকার প্রধানের কথোপকথনের ব্যবস্থা করেছেন।”
পত্রিকাটি লিখেছে, এই উদ্যোগের শুরু হয়েছিল বাইডেন প্রশাসনের আমলে, তবে এর ফল মিলেছে ট্রাম্প প্রশাসন দায়িত্ব নেওয়ার পর।
“যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ কূটনীতিক গত মাসে বলেছেন, এসব প্রচেষ্টার ফলেই বাংলাদেশে স্টারলিংকের ব্যবসার অনুমোদন মিলেছে— যে অনুমোদনের জন্য মাস্কের কোম্পানি বহু বছর ধরেই চেষ্টা করছিল।”
বাংলাদেশে স্টারলিংকের যাত্রা
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস গত ১৩ ফেব্রুয়ারি ওয়ার্ল্ড গভার্নমেন্টস সামিটে অংশ নিতে দুবাই সফরে গিয়ে স্টারলিংক প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্কের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। বাংলাদেশে স্পেসএক্সের স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট সেবা চালুর বিষয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হয় বলে তখন প্রধান উপদেষ্টার দপ্তরের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়।
সেখানে বলা হয়, এরই ধারাবাহিকতায় অধ্যাপক ইউনূস গত ১৯ ফেব্রুয়ারি মাস্ককে চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানান।
চিঠির বরাতে বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, স্টারলিংকের ইন্টারনেট সংযোগ বাংলাদেশের কাঠামোতে রূপান্তরমূলক পরিবর্তন, বিশেষ করে তরুণদের বিভিন্ন উদ্যোগ, গ্রামীণ ও পিছিয়ে পড়া নারী এবং প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগোষ্ঠীর মধ্যে এটি ‘বড় রূপান্তর’ ঘটাবে।

“প্রধান উপদেষ্টা তার বিশেষ সহকারী ড. খলিলুর রহমানকে এ বিষয়ে স্পেসএক্সের সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করতে বলেছেন, যেন আগামী ৯০ দিনের মধ্যে বাংলাদেশে এ পরিষেবা চালু করা সম্ভব হয়।”
এরপর গত ২৩ মার্চ বহুল আলোচিত বিনিয়োগ সম্মেলন নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনেও স্টারলিংকের প্রসঙ্গটি আসে। সেখানে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নির্বাহী চেয়ারম্যান চৌধুরী আশিক মাহমুদ বিন হারুন বলেন, ৯ এপ্রিল স্টারলিংকের পরীক্ষামূলক ব্যবহার হবে। ওই দিন (৯ এপ্রিল) আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল স্টারলিংকের কাভারেজের আওতায় থাকবে।
এরপর ২৫ মার্চ প্রধান উপদেষ্টা কার্যালয়ের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশে ৯০ দিনের মধ্যে বাণিজ্যিকভাবে স্টারলিংকের স্যাটেলাইট ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সেবা চালুর নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। এক মাসের মাথায়, ২৮ এপ্রিল আরেক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, প্রধান উপদেষ্টা স্টারলিংকের লাইসেন্সে অনুমোদন দিয়েছেন।
সেই বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি) গত ২৫ মার্চ ‘নন-জিওস্টেশনারি অরবিট (এনজিএসও) স্যাটেলাইট সার্ভিসেস অপারেটর ইন বাংলাদেশ' শীর্ষক লাইসেন্সিং গাইডলাইন জারি করে। ওই গাইডলাইনের আওতায় স্টারলিংক লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে। এ কোম্পানির নামে লাইসেন্স ইস্যুর জন্য ২১ এপ্রিল বিটিআরসির ২৯৪তম কমিশন সভায় নীতিগত সিদ্ধান্ত হয়।
লাইসেন্স পাওয়ার একমাসের মধ্যেই মঙ্গলবার ভোরে নিজেদের এক্স হ্যান্ডেলে বাংলাদেশের জন্য ইন্টারনেটের দুটি প্যাকেজ ঘোষণা করে স্টারলিংক। এর কিছুক্ষণ পর প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বিষয়টি জানিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দেন।
তার পোস্টের শেষ লাইনটি ছিল, “মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা সংশ্লিষ্ট সবাইকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।”
এরপর দুপুরে বিষয়টি নিয়ে সংবাদ সম্মেলন ডাকে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস। সেখানে কথা বলেন তৈয়্যব। স্টারলিংক নিয়ে এর আগেও প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিস সংবাদ সম্মেলন করেছে।
স্টারলিংককে ব্যবসা দিতে শুধু তড়িঘড়ি নয়, প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো রীতিমতো প্রচার চালিয়ে আসছে বলে মনে করছেন অনেকে।
তারা বলছেন, স্টারলিংক দুনিয়ার শীর্ষ ধনীর ইলন মাস্কের মালিকানাধীন বিরাট কোম্পানি। তারা বাংলাদেশে ব্যবসা করতে আসছে, সরকার দ্রুততার সঙ্গে সেই ব্যবসার পরিবেশ তৈরি করে দিয়েছে- এ পর্যন্ত খুবই ভালো কথা। কিন্তু সরকারকেই কেন এর প্রচারণায় নামতে হল?
তড়িঘড়ি কেন?
স্টারলিংক চালুর ক্ষেত্রে ‘অস্বাভাবিক তড়িঘড়ির’ যে অভিযোগ রয়েছে, সে বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “কোনো ধরনের অস্বাভাবিক তড়িঘড়ি করা হয়নি। প্রতিটি কাজই সরকার অত্যন্ত দ্রুততার সাথে সম্পন্ন করার একটা তাড়া আছে। আমরা প্রতিদিন সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত অফিস করি।
“স্টারলিংকের মাধ্যমে আমাদের বিদেশি বিনিয়োগকারীদের (এফডিআই) বার্তা দিতে চেয়েছি যে, বাংলাদেশ বিনিয়োগবান্ধব পলিসি সংস্কার করতে পারে। স্টারলিংক যেহেতু এই সুবিধা পেয়েছে। এই উদাহরণ আমরা অন্যান্য গ্লোবাল প্লেয়ারদের কাছে উপস্থাপন করতে পারছি। বিনিয়োগকারীদের কাছে গৌরবের সঙ্গে আমরা বিষয়গুরো উপস্থাপন করতে পারছি। সুতরাং আমি মনে করি না এখানে অস্বাভাবিক তড়িঘড়ি করা হয়েছে।”
তবে এর পরে আরেক প্রশ্নের জবাব দিতে গিয়ে তিনি বলেন, একটি ‘যৌক্তিক কারণে ও জনস্বার্থ রক্ষায়’ তাদের এই তাড়াহুড়া।

স্টারলিংকে সরকারের ‘রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি’
মঙ্গলবার স্টারলিংকের বাণিজ্যিক যাত্রা শুরুর পর প্রধান উপদেষ্টার প্রেস অফিসের ডাকা সংবাদ সম্মেলনে ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, স্টারলিংক বাংলাদেশে যাত্রা শুরু করেছে, এটা সাফল্যের নিদর্শন।
“প্রথমত, ৯০ দিন আগে বাংলাদেশে কোনো এনজিএসও লাইসেন্স ছিল না। এই ৯০ দিনের মধ্যে রেকর্ড দ্রুততার মধ্য দিযে বাংলাদেশ একটা এনজিএসও গাইডলাইন করেছে এবং সেটির অনুকূলে একটা অপারেটর স্যাটেলাইট ইন্টারনেট অপারেটর আবেদন করেছে এবং সেই আবেদনটাও প্রসেস করে চার মাসের সময়ের মধ্যে ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাসের মধ্যে এটা কমার্শিয়াল যাত্রা শুরু করতে পেরেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই ধরনের টেলিকমিউনিকেশন লাইসেন্সের রোল আউটের ইতিহাসের প্রথম ও অনন্য ঘটনা।”
এর আগে গত ৯মার্চ জাতীয় প্রেসক্লাবে এক আলোচনা সভায় বিশেষ সহকারী তৈয়্যব বলেন, “সরকার যে কোনো মূল্যে বাংলাদেশে স্টারলিংক নিয়ে আসবে; এটা সরকারের ‘পলিটিক্যাল প্রমিজ’ (রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি)।
“এই প্রতিশ্রুতির মাধ্যমে আমরা বিশ্বকে দেখাব, বাংলাদেশ একটা বিনিয়োগবান্ধব দেশ। আমরা এফডিআই (সরাসরি বিদেশি বিনিয়োগ) ব্র্যান্ডিং করার জন্য কাজটা করব।”
সরকার কেন প্রচারে?
স্টারলিংক নিয়ে সরকার প্রধান থেকে শুরু করে কর্তাব্যক্তিরা কথা বলেছেন, উচ্ছ্বাস দেখিয়েছেন। কেন সরকার স্টারলিংকের প্রচার (প্রমোশন) করছে–সেই প্রশ্ন করা হলে তৈয়ব বলেন, “আপনার প্রশ্নের চারটা উত্তর আছে। প্রথমত জুলাইয়ে ইন্টারনেট বন্ধ হওয়ার কারণে গ্লোবাল কমিউনিটিতে বাংলাদেশের বিনিয়োগ সক্ষমতার চিত্র ভয়াবহরকমের ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সেজন্য আমরা হাই স্পিড ও হাই কোয়ালিটি ইন্টারনেটের একটা টেকসই বিকল্প খুঁজেছিলাম। সেই থেকে এটা এসেছে।
“দ্বিতীয়ত হচ্ছে, আমরা বিশ্বকে দেখাতে চেয়েছি যে বাংলাদেশ বিনিয়োগফ্রেন্ডলি। স্টারলিংক বাংলাদেশে এলে এর সিস্টার কনসার্ন হিসেবে আরও বহু কোম্পানি বাংলাদেশে আসবে। ইতোমধ্যে আমরা সেটা দেখতে শুরু করেছি। এনজিএসও অপারেটর হিসেবে অন্তত চারটি কোম্পানি প্রস্তাব করেছে।”
তৈয়্যব বলেন, “তৃতীয়ত হচ্ছে, বাংলাদেশে যে ইন্টারনেট, তা পৃথিবীর মধ্যে অন্যতম নিকৃষ্ট। এটার একটা মানসম্পন্ন বিকল্প তৈরির দায় আমাদের ছিল।”
“চার নম্বর বিষয়টা হচ্ছে, বাংলাদেশের যে ফ্রিল্যান্সার তারা প্রতিনিয়ত বিড়ম্বনার শিকার হয়। তারা একটা ফরেন কোম্পানির সঙ্গে মিটিং করছে হয়ত, মিটিংয়ের মাঝপথে তাদের ইন্টারনেটের কারণে জুমটা বন্ধ হয়ে যায়। তারা কাস্টমারের টাইমটা মেইনটেইন করতে পারে না।”
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব বলেন, “আমরা মনে করি এই চারটা সমস্যার সমাধান করবে স্টারলিংক। প্লাস নতুন জব তৈরি করবে। আমি আগেই বলেছি কো-ওয়ার্কিং স্পেস তৈরি করবে। আপনারা বলতে পারেন আমরা তাড়াহুড়া করেছি, তাহলে এসবের জন্যই করেছি।
“আমি আরেকটা কথা বলতে পারি, আপনারা যদি খেয়াল করে দেখেন, আমরা টেলিকম লাইসেন্সিংয়ের রেজিম চেঞ্জ করতে তাড়াহুড়া করছি। সাত স্তরের লাইসেন্স থেকে তিনস্তরে নামাতে আমরা তাড়াহুড়া করছি। সুতরাং তাড়াহুড়া করেছি একটা যৌক্তিক কারণে করেছি, জনস্বার্থ রক্ষার জন্য করেছি। এবং এই খাতে শৃঙ্খলা ও জনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য করেছি।”
বাংলাদেশে স্টারলিংকের বিনিয়োগ কত?
বাংলাদেশে স্টারলিংকের প্রাক্কলিত বিনিয়োগ কত জানতে চাইলে ফয়েজ আহমদ বলেন, “এটা স্টারলিংক বলতে পারবে। তবে আমাদের এখানে কোনো বিনিয়োগ নেই। দিস ইজ দ্যা গুড পার্ট অফ ইট।
“ইন্দোনেশিয়ায় দেখা গেছে, সেখানে যখন অনেক বেশি কাস্টমার পেয়েছে স্টারলিংক, সেজন্য ডিভাইস সংখ্যা বেঁধে দিতে হয়েছে। আমাদের এখানেও যদি এমন হয়, তাহলে স্টারলিংক সেখানে স্যাটেলাইট বাড়াবে। সেটার বিনিয়োগ আমরা ভালো জানি না, তারাই জানে।”
বাংলাদেশে ব্যবসা করার ক্ষেত্রে স্টারলিংক কীভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স পরিশোধ করবে জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সহকারী বলেন, স্টারলিংক যেহেতু কর্পোরেট কোম্পানি তারা কর্পোরেট ট্যাক্সের আওতায় আসবে।

“প্রতি ডিভাইসের জন্য তারা এক ডলার করে মাসিক চার্জ দেবে। তারপরে তারা লাইসেন্সের জন্য প্রতি বছর ৩০ হাজার ডলার করে দেবে। বিটিআরসির দিক থেকে এই চার্জ বাড়ানোর সুযোগ আছে।”
বাংলাদেশের যে স্যাটেলাইটটি রয়েছে, সেটি দিয়ে স্টারলিংকের মত সেবা দেওয়া যাবে কি না– জানতে চাইলে তৈয়্যব বলেন, “আমাদের যে স্যাটেলাইটটি রয়েছে, সেটি কমার্শিয়াল টেলিযোগাযোগ স্যাটেলাইট নয়। এটা মূলত ডিটিএইচ স্যাটেলাইট, এটা টিভি স্টেশনগুলো ব্যবহার করতে পারে। সেখানে একটামাত্র ডিটিএইচ লাইসেন্স দিয়ে মনোপলি করা হয়েছিল।
“স্যাটেলাইটটার ব্যবহার ও আয় বৃদ্ধির জন্য আমরা আরও একটা লাইসেন্স দিয়েছি। আর সেখানে কিছু ভিস্যাট আছে যেগুলোর একেকটার দাম আড়াই লাখ টাকা। তবে ভি স্যাটের সীমাবদ্ধতা আছে। তবে আমরা চেষ্টা করছি এগুলোর দাম কমিয়ে এনে যাতে স্টারলিংকের সঙ্গে তুলনীয় করা যায়।”
ইন্টারনেট বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে?
আমাদের বর্তমান আইনে সরকার চাইলে ইন্টারনেট বন্ধ করে দিতে পারবে এমন ধারা আছে। এখন ইন্টারনেট শাটডাউন বন্ধে সরকার আইন পাল্টাবে কি না–তা জানতে চাওয়া হয় বিশেষ সহকারীর কাছে।
জবাবে তিনি বলেন, “আমরা অনেকগুলো আইন নিয়ে কাজ করছি। যেহেতু আমাদের সরকার ইন্টারনেট বন্ধ করবে না, আমরা তাই প্রয়োরিটি বেসিসে কাজ করছি। বছরের শেষ নাগাদ এই আইন পরিবর্তন করা হবে।”
এক প্রশ্নের জবাবে তৈয়্যব বলেন, “জুলাই আন্দোলনের সময় আমরা দেশে ইন্টারনেট শাটডাউন দেখেছি। সেই দিক থেকে সরকার ইন্টারনেট নিয়ন্ত্রণ শব্দটার বিষয়ে ভাবেনি। অর্থাৎ এই যে ইন্টারনেট বন্ধ এটা বাংলাদেশের ব্যবসায়ী কমিউনিটিকে এবং যারা বিদেশি বিনিয়োগকারী আছেন, তাদেরকে একটা ভুল বার্তা দেয়।
“ওই সময়ে ইন্টারনেট বন্ধ করে গণহত্যা চালানো হয়েছে। ব্যাংকিং খাতে আন্তর্জাতিক ক্রেডিট রেটিং অবনমন হয়েছিল এবং ফ্রিল্যান্সার কমিউনিটি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এবং একই সাথে রেমিটেন্স প্রবাহ কমে যায়। সেজন্য ইন্টারনেটের ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার যে আওয়ামী পদ্ধতি ছিল, সেখান থেকে আমরা সরে এসেছি।”
তবে লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী স্টারলিংক গেটওয়ে হিসেবে দেশীয় আইআইজি ব্যবহার করবে। সেক্ষেত্রে আইআইজির লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী সরকার চাইলে যে কোনো সময় তাদের মাধ্যমে স্টারলিংকের ইন্টারনেট বন্ধ বা নিয়ন্ত্রণ করার সুযোগ থেকে যাবে বলে এ খাতের বিশেষজ্ঞদের ভাষ্য।
ফয়েজ আহমদ তৈয়্যবও বলছেন, আইআইজিগুলোকে সরকার স্পষ্ট নির্দেশনা দিতে পারবে।
নিয়ন্ত্রণ কার হাতে থাকবে–এমন এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “রেগুলেটরি প্রশ্নে আমরা দুটো বিষয়ে পদক্ষেপ নিয়েছি। প্রথমত আনঅথরাইজড ডিভাইসের বিষয়ে আমরা বলেছি, প্রতিটা ডিভাইসকে বাংলাদেশে অপারেট করতে হলে অনুমোদন নিতে হবে।

“এবং আমরা যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে (আইআইজি) লাইসেন্স দিয়ে থাকি। তাই তাদের স্বার্থে গেটওয়ে হিসেবে স্টারলিংকে লোকাল গেটওয়ে ব্যবহার করতে হবে। আমরা চাইলে গেটওয়েগুলোকে স্পষ্ট নির্দেশনা দিতে পারব এবং কানেক্টেড ডিভাইসগুলোকে মনিটরিংয়ের (নজরদারী) আওতায় রাখতে পারব।”
লাইসেন্সের শর্ত অনুযায়ী স্টারলিংক সরকারকে আড়িপাতার সুযোগ দেবে জানিয়ে তৈয়্যব বলেন, এর মধ্যেই জাতীয় টেলিকম নজরদারি সংস্থা এনটিএমসির সঙ্গে স্টারলিংকের যোগাযোগ হয়েছে।
‘ভুগতে হবে’ আইএসপিদের
দেশের ইন্টারনেট সেবাদাতা ব্যবসায়ীরা (আইএসপি) বলে আসছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে স্টারলিংক গেলে তাদের ব্যবসার ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ নষ্ট হবে, বা তারা গ্রাহক হারাবে এমন শঙ্কা আছে।
এ বিষয়ে ফয়েজ আহমদ বলেন, আইসিটি থেকে এক লাখ নয় হাজার এন্ড ইউজার বা প্রান্তিক গ্রাহকদের সংযোগ দেওয়ার জন্য একটা প্রকল্প চলছে।
“এই প্রকল্প ৩৬টি আইএসপির মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে। আমি আশা করব আইএসপিরা এই প্রকল্পটা সঠিক সময়মতো বাস্তবায়ন করবে।
“দ্বিতীয়ত আমরা আইএসপিদের অনুরোধ করেছি, গত চারমাস ধরে আমরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি তাদের এটা বোঝাতে যে একটা নতুন বিকল্প আসছে, বাজারে নতুন প্রতিযোগিতা তৈরি হবে। সুতরাং আইএসপিরা ইন্টারনেটের পরিবর্তে যে ক্যাশ বিক্রি করে, সেখান থেকে তাদের সরে আসতে হবে। গ্রাহক সন্তুষ্টির জন্য রিয়েল ইন্টারনেট এবং ক্যাশের মধ্যে যে আনুপাতিক হার, সেটা মেনটেইন করতে হবে। সেবার মান নিশ্চিত করতে হবে।”
বিশেষ সহকারী বলেন, “আমরা বলেছি, ৫ এমবিপিএস বা ১০ এমবিপিএস গতিকে তারা যেন আর ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট না বলে। এটা খুবই রং টার্মিনোলজি। ২০ এমবিপিএস এর নিচে কোনো গতিকে আসলে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট বলা যায় না। এই বার্তাগুলো আমরা তাদের একাধিকবার বিভিন্ন ফোরামে দিয়েছি। আমরা পর্যাপ্তভাবে সতর্ক করেছি।
“আর সর্বশেষ বলব, আইএসপিদের রক্ষার জন্য আমরা স্টারলিংকের মোবিলিটি অপশন রাখিনি। মোবিলিটি অপশন রাখলে যে কোনো ব্যক্তি গাড়ির ওপর স্টারলিংক সেটাপ বসিয়ে সেটা ব্যবহার করতে পারত। এখন তারা যদি নিজেরা সেবার মান না বাড়ায়, একশ এমবি যদি ২০০০ মানুষের কাছে বিক্রি করে, তাহলে তাদের ভুগতে হবে।”
‘মোবাইল টাওয়ারের সমান হবে’ একটি স্টারলিংক ডিভাইস?
স্টারলিংকের একটি ৪৭ হাজার টাকার ‘সেটআপ’ একটি মোবাইল টাওয়ারের সমান ইন্টারনেট সরবরাহ করতে পারবে বলে মন্তব্য করেন প্রধান উপদেষ্টা বিশেষ সহকারী।
তিনি বলেন, “বাংলাদেশে এখনও হাজার হাজার মোবাইল টাওয়ার আছে, যারা শুধু ৩০০ এমবিপিএসের ব্যান্ডউইডথ দিয়ে একটা মোবাইল টাওয়ার সচল রাখে ইন্টারনেটের জন্য এবং সেই ডেটা ইন্টারনেটটা কয়েক হাজার গ্রাহকের কাছে বিক্রি করা হয়।”
স্টারলিংকের ক্ষেত্রে মাত্র একটি সেটআপ বক্স দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে জানিয়ে এর ব্যাখ্যায় তৈয়্যব বলেন, “অর্থাৎ গ্রামের একজন উদ্যোক্তা উনি স্টারলিংকের একটা সেটআপ বক্স, যেটা ৪৭ হাজার টাকা দিয়ে কিনবেন, উনি নিজে নিরবচ্ছিন্ন, লো লেটেন্সি এবং উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করতে পারবেন। লো লেটেন্সি অর্থাৎ ডাউনলোড করতে কম সময় খরচ হবে।”