
কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনে ঐতিহ্যগতভাবে চলে আসা কোরবানি দেওয়ার প্রথা বন্ধের নির্দেশ দিয়েছেন নবনিযুক্ত ডেপুটি হাইকমিশনার শাবাব বিন আহমেদ। কলকাতা মিশনে যোগদানের আগেই কোরবানি বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেছেন ডেপুটি হাইকমিশনার।একাধিক কূটনৈতিক সূত্র আমার দেশকে এসব তথ্য জানিয়ে বলেছে, নতুন ডেপুটি হাইকমিশনারের এই পদক্ষেপে কলকাতা মিশনে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। এ ছাড়া এই পদক্ষেপ কার্যকর হলে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কের অবনতি হওয়ার পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গে এটা একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হতে পারে বলে আশঙ্কা সংশ্লিষ্ট কূটনীতিকদের। এদিকে স্পর্শকাতর এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে যোগাযোগ করা হলে ডেপুটি হাইকমিশনার শাবাব বিন আহমেদ আমার দেশকে তার পদক্ষেপের সপক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলেছেন, হোস্ট কান্ট্রির (ভারত) আস্থা অর্জন করাটা আমাদের জন্য জরুরি।
তিনি আরো বলেন, ‘যারা আমাদের মিশনের নিরাপত্তায় থাকে, তাদের সংখ্যা ২৫ জনেরও বেশি। এই নিরাপত্তাকর্মীরা গরুর পূজা করে। আমরা যদি এখন সেই গরু জবাই করি, তাহলে তাদের মনের অবস্থা কী হতে পারে, তা কি একবার ভেবে দেখেছেন?’ভারতে দায়িত্ব পালন করেছেন এমন একজন কূটনীতিক ডেপুটি হাইকমিশনারের এই পদক্ষেপের ব্যাপারে আমার দেশকে বলেন, কলকাতার নতুন মিশনপ্রধান এখনো মিশনে যোগ দেননি। তার আগেই তিনি এ ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যুতে পদক্ষেপ নিচ্ছেন, যা রীতিমতো বিস্ময়কর। তার বক্তব্য আর আরএসএসের বক্তব্যের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। দেশের জন্য এটা বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। তিনি বলেন, কলকাতা মিশনে কোরবানি করার রেওয়াজ দীর্ঘদিনের। ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে কলকাতা মিশনে কোরবানি হয়ে আসছে। প্রতিবছরই পাঁচ থেকে সাতটি গরু এবং ছাগল কোরবানি করা হয়। এই কোরবানির গোশতের একটি বড় অংশ বিভিন্ন এতিমখানায় পাঠানো হয়। তা ছাড়া মিশনের চারপাশে বসবাসকারী মানুষের প্রায় ৯০ ভাগই মুসলিম। এই মুসলিমরাও প্রতিবছর বাংলাদেশ মিশন থেকে গোশত পেয়ে থাকে। এভাবেই আমাদের কলকাতা মিশনের কোরবানি ঐতিহ্যে পরিণত হয়েছে।
কলকাতা মিশনের কোরবানির বিষয়টি ধর্মীয় ঐতিহ্যের পাশাপাশি এর একটি সামাজিক এবং রাজনৈতিক তাৎপর্য রয়েছে বলে মন্তব্য করে ওই কূটনীতিক বলেন, কলকাতা মিশনের কোরবানিকে বিগত এবং বর্তমান মমতা সরকার ইতিবাচক হিসেবে দেখে। তারা এটাকে উদাহরণ হিসেবে দেখাতে চায়, পশ্চিমবঙ্গে সব ধর্মের মানুষের সমান ধর্মীয় স্বাধীনতা রয়েছে। আগামী বছর পশ্চিমবঙ্গে নির্বাচন। সুতরাং কলকাতা মিশনে কোরবানি বন্ধ হলে এটা একটি রাজনৈতিক ইস্যুতে পরিণত হবে। বিজেপি-আরএসএস এটাকে তাদের পক্ষে ব্যবহারের চেষ্টা করবে। মমতা সরকার এটাকে মোটেই ভালোভাবে নেবে না। সুতরাং ইস্যুটি বাংলাদেশের জন্য বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।
কলকাতার নতুন মিশনপ্রধানের কোরবানির বিষয়ে নেওয়া পদক্ষেপ সম্পর্কে কলকাতা মিশনে কর্মরত একাধিক কর্মকর্তা আমার দেশকে বলেন, নতুন মিশনপ্রধান এখন হেগে মিনিস্টার (রাজনৈতিক) হিসেবে কর্মরত আছেন। গত জানুয়ারি মাসে ডেপুটি হাইকমিশনার হিসেবে তার কলকাতায় পোস্টিং অর্ডার হয়। আগামী জুন মাসের মধ্যে তার দায়িত্ব নেওয়ার কথা। কিন্তু তিনি দায়িত্ব নেওয়ার আগেই কয়েক মাস ধরে মিশনে কোরবানি বন্ধের ব্যাপারে তৎপর হন। তিনি সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কোরবানি বন্ধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা তাকে মিশনের কোরবানির বিষয়টি নিয়ে এর স্পর্শকাতরতার কথা বারবার তুলে ধরে এ ধরনের পদক্ষেপ নিতে অপারগতা জানান। কিন্তু তিনি কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেননি। একপর্যায়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা নতুন মিশনপ্রধানকে জানান, আপনি দায়িত্ব গ্রহণের পর আপনার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করবেন। আমাদের পক্ষে কোরবানি বন্ধ করা সম্ভব না।
নতুন মিশনপ্রধানকে প্রয়োজনে কোরবানির শেষে দায়িত্ব নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। কিন্তু তিনি সেই অনুরোধ উপেক্ষা করে মিশনের কর্মকর্তাদের গত সপ্তাহে সাফ জানিয়ে দেন, তিনি আগামী ২ জুন দায়িত্ব নেবেন এবং কোরবানির সব ধরনের প্রস্তুতি বন্ধ করতে বলেন। কলকাতা মিশনের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, নতুন মিশনপ্রধানের এই সিদ্ধান্তে মিশনের ভেতরে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছে। তার এই সিদ্ধান্তের সঙ্গে কেউই একমত নন। এ ছাড়া বিষয়টি এখন মিশনের বাইরেও জানাজানি হয়েছে। কলকাতার অনেক সাংবাদিক এবং বুদ্ধিজীবী ফোন করছেন। তারা সবাই হিন্দু সম্প্রদায়ের। তারা বলছেন, বাংলাদেশ যেন কোনোভাবেই কোরবানি বন্ধের সিদ্ধান্ত না নেয়। কারণ এর একটি সুদূরপ্রসারী প্রভাব পড়বে পশ্চিমবঙ্গের রাজনীতিতে।
বিষয়টি নিয়ে আমার দেশ-এর পক্ষ থেকে শাবাব বিন আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, আমি তো এখন দায়িত্ব গ্রহণ করিনি। কিন্তু পরক্ষণেই তিনি তার পদক্ষেপের সপক্ষে নিজের বয়ান তুলে ধরে বলেন, কলকাতা ছাড়া আর কোনো মিশনে কোরবানি হয় না। আমি এর আগে আরো পাঁচটি মিশনে দায়িত্ব পালন করেছি। কোথাও কোরবানি করা হয় না। আমরা কূটনীতিকরা দেশের জন্য কাজ করি। আমরা যেখানে কাজ করব, সেখানকার পরিবেশ পরিস্থিতির কথা আমাদের মাথায় রাখা দরকার। তিনি বলেন, আমাদের স্বাগতিক দেশের রীতিনীতি মেনে চলা উচিত। কূটনীতিক হিসেবে হোস্ট কান্ট্রির আস্থা অর্জন করা জরুরি। তিনি আরো বলেন, আমাদের কলকাতা মিশনের নিরাপত্তায় ২৫ জনের মতো নিরাপত্তাকর্মী থাকে। তারা তো গরুকে পূজা করে। একবার ভেবে দেখেছেন, তারা যাকে পূজা করে, যখন আমরা সেটাকে জবাই করি, তাদের মনের অবস্থা কী হয়? তিনি বলেন, গত বছর পাঁচটি গরু এবং দুটি ছাগল কোরবানি করা হয়েছিল। এতে মিশনের ভেতরের পরিবেশ নোংরা হয়। এ ছাড়া যেখানে-সেখানে পশু জবাই করা যাবে না বলে কলকাতা হাইকোর্টের একটি রায়ও রয়েছে। এগুলো আমাদের মাথায় রাখতে হবে।
শাবাব বিন আহমেদের এই বক্তব্যে রীতিমতো বিস্ময় তৈরি হয়েছে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন সিনিয়র কূটনীতিক এ ব্যাপারে আমার দেশকে বলেন, আমি বিস্মিত। এ ধরনের বক্তব্য তার দেওয়ার কথা নয়। কোরবানি বন্ধ হবে কি না, সেই সিদ্ধান্ত তো হেডকোয়ার্টার অথবা হাইকমিশনারের কাছ থেকে আসতে হবে। ডেপুটি হাইকমিশনার কীভাবে এ ধরনের স্পর্শকাতর ইস্যুতে সিদ্ধান্ত দিচ্ছেন, যিনি এখনো দায়িত্বই গ্রহণ করেননি। এটি সত্যিই রহস্যজনক? এখানে অন্যকিছু থাকতে পারে।
তিনি আরো বলেন, এর আগে এই কূটনীতিক বাংলাদেশের দিল্লি হাইকমিশনে কাজ করেছেন। সে সময় হয়ত তিনি ভারতে ক্ষমতাসীন দল বিজেপির আদর্শে দীক্ষিত হয়েছেন।
কলকাতার মিশনপ্রধান হিসেবে শাবাব বিন আহমেদের নিয়োগের পর মোদি সরকারের অন্যতম প্রধান মুখপত্র দ্য ইন্ডিয়া টুডেতে ওই নিয়োগের বিষয়ে বিশাল প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। প্রতিবেদনে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পদস্থ কর্মকর্তাদের উদ্ধৃত করে শাবাব বিন আহমেদের ভূয়সী প্রশংসা করা হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক যখন রীতিমতো পরীক্ষার মধ্যে পড়েছে, ঠিক সে সময় কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে ডেপুটি হাইকমিশনারের নিয়োগটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। আমরা অত্যন্ত আনন্দিত যে, আমরা একজনকে পেতে যাচ্ছি, যিনি দুদেশের সম্পর্কের ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, অবৈধ অনুপ্রবেশ, সাম্প্রদায়িক সহিংসতাসহ স্পর্শকাতর ইস্যুগুলো সমাধানে ভূমিকা নেবেন। প্রতিবেদনে দৃঢ় আশাবাদ ব্যক্ত করে বলা হয়, শাবাব বিন আহমেদের দায়িত্ব পালনকালে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এক নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে।