Image description

ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্ত দিয়ে আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালানে সক্রিয় হয়ে উঠেছে আন্তর্জাতিক অস্ত্র কারবারিরা। এ দুই দেশের সঙ্গে সীমান্তের নতুন নতুন পথে অস্ত্র ঢুকছে। একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।

বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) তথ্যমতে, ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সীমান্তের ১৭টি এলাকা দিয়ে অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান করছে কারবারিরা। নিরাপত্তা বিশ্লেষকেরা বলছেন, এই অস্ত্র পাচার দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। তাই সীমান্তের অস্ত্র পাচারের রুটগুলোতে নজরদারি ও অভিযান বাড়াতে হবে।

জানতে চাইলে বিজিবির পরিচালক (অপারেশনস) লেফটেন্যান্ট কর্নেল এস এম শফিকুর রহমান বলেন, আগ্নেয়াস্ত্র চোরাচালান প্রতিরোধে বিজিবি সর্বোচ্চ সতর্কতা ও নজরদারি অব্যাহত রেখেছে।

গোয়েন্দা সংস্থাগুলো বলছে, দেশের উত্তর-পূর্বে সীমান্তের ওপারে ভারতের ত্রিপুরা, মিজোরাম, মণিপুর রাজ্যে অস্থিরতা চলছে। নাগাল্যান্ডেও আছে অস্থিরতা। ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ) বিভিন্ন সীমান্তে পুশ ইনের চেষ্টা করছে বাংলাভাষীদের। এদিকে দক্ষিণ-পূর্বে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের পার্বত্য চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারসংলগ্ন সীমান্ত এলাকা বিদ্রোহী আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে। সেখানে সংঘাত চলছে। এই অস্থিরতার সুযোগ নিচ্ছে আন্তর্জাতিক অস্ত্র কারবারিরা। সীমান্তপথে আনা হচ্ছে অস্ত্রের চালান।

সূত্রগুলো বলছে, কক্সবাজার, বান্দরবান ও খাগড়াছড়ির পার্বত্য এলাকা, ভারতের ত্রিপুরা ও মণিপুর সীমান্তঘেঁষা এলাকাগুলো এখন অস্ত্র পাচারের রুটে পরিণত হয়েছে। বিজিবি বেশ কিছু আগ্নেয়াস্ত্র ও গোলাবারুদ উদ্ধারও করেছে।

বিজিবির একাধিক সূত্র বলেছে, সম্প্রতি তারা যেসব অস্ত্র আটক করেছে, তার মধ্যে রয়েছে অত্যাধুনিক রাইফেল, হ্যান্ড গ্রেনেড, ভারতে তৈরি আগ্নেয়াস্ত্র ও বিপুল গোলাবারুদ। সীমান্তবর্তী পাহাড়ি গ্রামগুলোতে অচেনা মানুষের চলাফেরা বেড়েছে বলে স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন। এসব লোক রাতে পাহাড়ি পথ ব্যবহার করছে এবং কারও সঙ্গে মেশে না। কিছু এলাকায় অস্ত্রের গোপন গুদামের খোঁজ মিলেছে।

সংশ্লিষ্ট পদস্থ এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সীমান্তে নানা গোষ্ঠীর আনাগোনা। বিদ্রোহী গোষ্ঠী ও আন্তর্জাতিক অস্ত্র চক্র এই সুযোগ নিচ্ছে। দ্রুত নজরদারি ও অভিযান না বাড়ালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে।

বিজিবির তথ্য বলছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত তারা ৭৯টি আগ্নেয়াস্ত্র ও ৮ হাজার ৯৮৯টি গুলি উদ্ধার করেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সারা দেশে বিভিন্ন থানা, ফাঁড়ি ও পুলিশ বক্সসহ পুলিশের স্থাপনা থেকে লুট হওয়া ৫ হাজার ৭৫০টি অস্ত্রের মধ্যে ১ হাজার ৪০০ অস্ত্র এখনো উদ্ধার হয়নি।

পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বাহারুল আলম বলেন, ‘এমন পরিস্থিতিতে কিছু অস্ত্র কারবারি সুযোগ নেবে, এটা স্বাভাবিক। আবার আমাদের খোয়া যাওয়া অস্ত্রের কিছু এখনো উদ্ধার হয়নি। পুলিশ কাজ করছে। অস্ত্র উদ্ধারে সবার সহযোগিতা দরকার।’

পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জানায়, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারে বিশেষ অভিযানের প্রস্তুতি চলছে। কারা এই অস্ত্র ব্যবহার করছে, কোথায় লুকিয়ে রেখেছে, তা চিহ্নিত করতে গোয়েন্দা নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।

বিজিবির তথ্যমতে, বাংলাদেশ-ভারত ও বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের অন্তত ১৭টি স্থান এখন অস্ত্র পাচারে ব্যবহৃত হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের রহনপুর, সোনামসজিদ, আজমতপুর, বিলভাতিয়া; সাতক্ষীরার তলুইগাছা, কুড়িগ্রাম, শাঁকারা; যশোরের বেনাপোল ও চৌগাছা; রাজশাহীর গোদাগাড়ী; চুয়াডাঙ্গার দর্শনা; মেহেরপুর, কুষ্টিয়া, কুমিল্লা; বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি এবং কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়া।

সম্প্রতি কুড়িগ্রামের দিয়াডাঙ্গা সীমান্তে বিজিবির ধাওয়ায় পাচারকারীরা ভারতে পালিয়ে যায়। ওই অভিযানে উদ্ধার হয় পাঁচটি গান, একটি পিস্টন অ্যাসেম্বলি, অসংখ্য গুলি ও একটি মোটরসাইকেল।

জানতে চাইলে বিজিবির ২২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মাহবুব-উল-হক বলেন, ‘সীমান্তে সব ধরনের চোরাচালান ও অস্ত্র পাচার রোধে আমরা সর্বোচ্চ তৎপর আছি। প্রতিটি বিওপিতে (বর্ডার আউট পোস্ট) টহল বাড়ানো হয়েছে।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং অপরাধ বিশ্লেষক তৌহিদুল হক বলেন, যেকোনো মূল্যে এই অবৈধ অস্ত্রের প্রবেশ ও ব্যবহার বন্ধ করতে হবে। পাশাপাশি পুলিশের খোয়া যাওয়া অস্ত্রও উদ্ধার করতে হবে। তা না হলে ভবিষ্যতে তা স্থিতিশীলতার জন্য ভয়ংকর হুমকি হয়ে উঠতে পারে।