Image description

দেশে ফেরার বিমান টিকিট হাতেই ছিল। কিন্তু বন্ধ হয়ে গেল দরজাটাই। সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে চাকরির ‘অফার লেটার’ এবং কারণ ছাড়াই তা ‘সাসপেন্ড’ হয়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন এক শিক্ষক। যিনি সর্বশেষ অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি করছিলেন।অক্সফোর্ড ও ব্র্যাক— বর্তমানে উভয় কূল হারানো ওই ব্যক্তির নাম মুহাম্মদ উবায়দুল হক (জাবের উবায়েদ)। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষার্থী তিনি।

‘অক্সফোর্ডে ভালো পজিশনে চাকরি করছিলাম। কিন্তু মনটা পড়ে ছিল বাংলাদেশে। ভেবেছিলাম, দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় কিছু অবদান রাখব। কিন্তু ১৫ মে আমার অফার লেটার বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। কিন্তু এই বাতিলের কারণ আমাকে জানানো হয়নি’— এমন কথায় শুরু হওয়া উবায়েদের ফেসবুক স্ট্যাটাস ইতোমধ্যেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আলোচনার জন্ম দিয়েছে।

আজ সোমবার (১৯ মে) নিজ আইডিতে ওই পোস্ট করেন তিনি। জাবের ওবায়েদের স্ট্যাটাসটিতে ইতোমধ্যেই কয়েক হাজার ফেসবুকার রিয়্যাকশন দেখিয়েছেন। পোস্টটিকে শেয়ার করে ‘দুঃখজনক’ বলার পাশাপাশি প্রশাসনের সুস্পষ্ট ব্যাখ্যাও চেয়েছেন অনেকে। আইনী পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কেউ কেউ। পোস্টটি শেয়ার করা এমনই একজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান। তিনি লিখেছেন, ‘দুইযুগ আগে ওরা (ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি) আমার সাথে একই আচরণ করেছিল।’

আশরাফুল ইমরান নামে একজন লিখেছেন, ‘ব্র্যাক জাবের ওমরকে যত বেতন দিত, তার থেকে সে ৪-৫ গুন বেশি বেতনের জব করছিল অক্সফোর্ডে। তারপরেও সে চেয়েছিল দেশে গিয়ে যদি নিজের মেধাটা কাজে লাগানো যায়— এটাই বোধহয় তার বড় অপরাধ’। ইয়াছিন আরাফাত লিছেন, ‘এটা জঘন্য একটা কাজ হয়েছে। কাউকে না নিতে চাইলে আগেই সব কনফার্ম করা উচিত ছিল।’

বিষয়টি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে চাইলে উবায়দুল হক দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘মার্চের ১৯ তারিখ অনলাইনে ইন্টারভিউ নেয় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। ২৮ এপ্রিল কনফার্মেশন লেটার এবং মে মাসের ৯ তারিখ অফার লেটার পাই। কিন্তু ১৫ মে আমার অফার লেটার বাতিল করে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। এই বাতিলের কারণ আমাকে জানানো হয়নি। বিষয়টি জানতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেও কোনো সাড়া পাইনি। বিষয়টি নিয়ে আমি আইনজীবীর সঙ্গে কথা বলবো, কী করা যায়।’ 

তিনি আরও বলেন, ‘অক্সফোর্ডে চাকরি ছেড়ে দেওয়ার ফলে সেখানে আপাতত আর জয়েন করার সুযোগ নেই। তবে পরবর্তীতে হয়তো অন্য পদের জন্য আবার আবেদন করবো।

জানা যায়, উবায়দুল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) লোকপ্রশাসন বিভাগের ২০১২-১৩ সেশনের শিক্ষার্থী ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শেষ করার পর অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যায়ে চাকরিতে যোগদান করেন। এর আগে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে সেকেন্ড মাস্টার্স করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যালামনাই।

এদিকে এক প্রতিষ্ঠান থেকে পদত্যাগ এবং অন্য প্রতিষ্ঠান থেকে বঞ্চিত হওয়ায় বিপাকে পড়েছেন মেধাবী এই শিক্ষক। উবায়েদের ভাষ্য, তার  ব্যাকগ্রাউন্ড মাদ্রাসা এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় লেখালেখি করেন। জুলাই কেন্দ্রিক একটিভিজমকে সর্বাত্মক প্রমোটও করে থাকেন তিনি। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় তার সেকেন্ড মাস্টার্স্ট করা বিশ্ববিদ্যালয় হওয়ায় ইতোপূর্বে প্রতিষ্ঠানটি তার সাকসেস স্টোরি বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইট ও স্যোশাল মিডিয়ায় প্রচার করেছে বলেও জানান তিনি।

বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বিস্তারিত তুলে ধরে ওই শিক্ষক লেখেন, ‘সম্প্রতি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় আমার সাথে বড় ধরনের একটি অন্যায় আচরণ করেছে। আমি স্কুল অব জেনারেল এডুকেশনে ফ্যাকাল্টি মেম্বার হিসেবে জয়েন করার জন্য আবেদন করি গত ফেব্রুয়ারিতে। দুই দফা ইন্টারভিউ, প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টস চেক ও সব প্রক্রিয়া শেষে কনফার্মেশন ই-মেইল পাই ২৮ এপ্রিল। লেকচারার হিসেবে অফার লেটার পাই গত ৯ মে। জয়েনিং ডেট উল্লেখ করা হয় জুনের ১ তারিখ। আমার সাথে এইচআর থেকে যিনি যোগাযোগ করছিলেন; তার পরামর্শক্রমে আমি দেশে ফেরার সার্বিক প্রস্তুতি নিতে থাকি। 

উবায়েদ লেখেন, ‘অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো পজিশনে জব করছিলাম গত মার্চ মাস থেকে। তবে দেশে আসতে চাচ্ছিলাম দেশের শিক্ষাব্যবস্থায় যদি কিছু অবদান রাখা যায়— সেই চিন্তা থেকে। তাই অফিসারের সাথে আলাপের ভিত্তিতে আমি আমার অক্সফোর্ডের অফিসে মে মাসের শুরুতেই নোটিস দেই। সে অনুযায়ী তারা আমার রিপ্লেসমেন্ট হায়ার করে গত ১৩ মে। আর আমি রিজাইন করি ১৪ মে। একই সাথে ২০ তারিখে দেশে আসার বিমানের টিকেটও বুক করি।’

তিনি আরও লেখেন, ‘আমি যখন দেশে আসার সব প্রস্তুতি নিয়ে নিয়েছি এর মধ্যে গত ১৫ মে একতরফাভাবে কোন কারণ না বলে আমার অফার লেটার সাসপেন্ড করে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়। অক্সফোর্ডে আমার রিপ্লেসমেন্ট নিয়ে নেয়ায় আগের জবে জয়েন করার আর সুযোগ নাই। আমি ব্র্যাকের ফিরতি ইমেইলে কারণ জানতে চেয়েছি। এর কোন জবাব পাইনি। আজ আবার জেনারেল এডুকেশনে স্কুলের ডিনের সাথে যোগাযোগ করলে আমাকে এইচআরের নোটিশ ও জবাবের দিকে রেফার করেন। আর বিস্তারিত কারণ বলার প্রয়োজন বোধ করেননি।’

উবায়েদ ফেসবুকে লেখেন, ‘এইচআরে যে অফিসার আমার সাথে সবকিছু নিয়ে আলাপ করেছেন; শুরু থেকে তিনিও অফার সাসপেন্ডের ইমেইলের কপিতে আছে। তার এ ব্যাপারের জানার কথা থাকলেও উনি বলছেন— কিছু জানেন না। উনি যেন কিছু লুকানোর চেষ্টা করছেন ও অসত্য বলছেন। অফার লেটারে উল্লেখ ছিল, জয়েনিং সন্তোষজনক ব্যাকগ্রাউন্ড ভেরিফিকেশনের উপরে নির্ভর করবে। আমার বিরুদ্ধে কোন ক্রিমিনাল রেকর্ড নাই। আমার মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ড ও সোশ্যাল মিডিয়ায় টুকটাক লিখি। জুলাই কেন্দ্রিক একটিভিজমকে প্রমোট করি।’

তিনি ফেসবুকে লেখেন, ‘আমি ব্র্যাক থেকে আমার সেকেন্ড মাস্টার্স করেছি। সম্মানজনক শিভেনিং স্কলারশিপ পেয়ে বিশ্বের ১ নম্বর এডুকেশন স্কুল (টাইমস হায়ার এডুকেশন সাবজেক্ট র‍্যাংকিং অনুযায়ী) ইনস্টিটিউট অব এডুকেশন- ইউসি-তে পড়েছি। আমি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০২১ জানুয়ারি থেকে ২০২২ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত কর্মরতও ছিলাম। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে সব মিলিয়ে ১ বছর কাজ করেছি ‘আউটরিচ ডেলিভারি অ্যাসিসট্যান্স’ এবং ‘অ্যাসেসমেন্ট অফিসার’ হিসেবে। আমার বিভিন্ন সাকসেস স্টোরি ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় ওয়েবসাইট ও স্যোশাল মিডিয়ায় প্রচারও করেছে দুইবার।’

বিষয়টির সুরাহা চেয়ে এব পুরো বিষয়টিকে ব্র্যাকের ‘অন্যায্য’ এবং ‘জঘন্য আচরণ’ দাবি উবায়েদ আরও লেখেন, ‘আমি কোনভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আমি আর ব্র্যাকে জয়েন করব না। কিন্তু এমন আচরণ তারা কীভাবে একজন মানুষের সাথে করতে পারে— সেটা বুঝতে চাই। কীভাবে আমার যোগ্যতা, দক্ষতাকে ওদের অগ্রাহ্য করে আমাকে অপমান করলো— এর জবাব চাই। আমার মতো একজনের সাথে এমন আচরণ করতে পারলে আরো কত মানুষের সাথে এমন অন্যায় আচরণ করে সেটাও এর থেকে বুঝা যায়। এর  প্রতিকার জুলাই বিপ্লব পরবর্তী বাংলাদেশে হতেই হবে।’

বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে সোমবার বিশ্ববিদ্যালয়টির উপাচার্য অধ্যাপক ড. সৈয়দ ফারহাত আনোয়ারের সঙ্গে যোগাযোগ করার চেষ্টা করে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস। এ সময় তার মুঠোফোন নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বরাতে কমিউনিকেশন অফিস জানায়, ‘১৮৭২ সালের চুক্তি আইনের ধারা ৫ অনুসারে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন তার অফার লেটারটি প্রত্যাহার করেছে। যথাযথ বিবেচনার পর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে।’