Image description

বরগুনার সাইদুর রহমানের স্বপ্ন ছিল পরিবারের দারিদ্র্য ঘোচাবেন। অভাবের বোঝা কাঁধে নিয়ে মালয়েশিয়ায় গিয়ে গতি আনবেন সংসারের চাকায়। কিন্তু জেলার মোকামিয়া গ্রামের এই তরুণের পরিণতি হয় নির্মম, লাখ লাখ টাকা দিয়ে পড়েন দালালের খপ্পরে। তাকে বিদেশে নিয়ে রাখা হয় টর্চার সেলে, চলত অকথ্য নির্যাতন। অবশেষে আবারও টাকা খরচ করে মাফিয়াদের হাত-পা ধরে মেলে মুক্তি।

জানা গেছে, প্রতিবেশী চাচা মাহফুজ মৃধার মাধ্যমে মানবপাচার চক্রের ফাঁদে পড়েন সাইদুর। তার সঙ্গে এ চক্রে রয়েছেন একই গ্রামের মালয়েশিয়া প্রবাসী সজীব জমাদ্দার, স্থানীয় দালাল রুবেল ও আড়ালে থাকা মাহাবুব রহমান।

ভুক্তভোগী সাইদুর বলেন, পাচারকারীরা তাকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল স্বল্প খরচে মালয়েশিয়া পাঠাবে। সেখানে যাওয়ার পর তার মাসিক আয় হবে ৭০-৮০ হাজার টাকা। কিন্তু তাকে ভিসার বিষয়ে কোনো তথ্য দেওয়া হয়নি। হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয় ঢাকা-কুয়ালালামপুরের একটি ভুয়া টিকিট, সঙ্গে ৮০০ ডলার। টিকিটটি নিয়ে বিমানবন্দরে গেলে এক ব্যক্তি পাসপোর্ট দেখে জিজ্ঞাসা করেন, তোমরা কার লোক। এরপর সাইদুর ও তার সঙ্গে থাকা আরো ২৫ জন দালালকে ফোন দেন। তখন গোপন সংকেত ‘কলার’ কথা ওই লোককে জানাতে বলেন। কোডটি জানানোর পর সবার টিকিট নিয়ে নেওয়া হয়। এরপর সবাইকে আলাদা রেখে তিনি পুলিশের সঙ্গে কথা বলে নতুন টিকিট দেন, যেখানে ইন্ডিগো বিমানের ঢাকা-কলকাতা, কলকাতা-হো চি মিন সিটি ফ্লাইট উল্লেখ ছিল।

এভাবে ২৬ বাংলাদেশিকে ২০২৪ সালের অক্টোবরে বাংলাদেশ- ভারত-ভিয়েতনাম-কম্বোডিয়া-থাইল্যান্ড হয়ে পাচারের মাধ্যমে মালয়েশিয়ায় মাফিয়াদের হাতে তুলে দেওয়া হয়। সেখানে তারা দেখতে পান বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে পাচার করা আরো ৭৬ বাংলাদেশি জিম্মি রয়েছেন। নতুন ২৬ জনের স্থান হয় আগে থেকে সেখানে থাকা বন্দিদের সঙ্গে। এ প্রতিবেদককে এভাবেই ঘটনার বর্ণনা দেন পাচারের শিকার সাইদুর।

তিনি জানান, বন্দিশালায় তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চলত। মুক্তিপণ না দিলে হত্যার হুমকি দেওয়ার পাশাপাশি বাড়িয়ে দেওয়া হতো নির্যাতনের মাত্রা। তবে যারা চাহিদামতো টাকা দিতে পারেন, তারা মুক্তি পান।

মা-বাবা ও পাঁচ ভাইবোনসহ টানাপড়েনের সংসার সাইদুরদের। একমাত্র উপার্জনক্ষম তার বাবা আবদুল মান্নান। তিনি স্থানীয় একটি স’মিলে ৫০০-৬০০ টাকা দৈনিক মজুরিতে কাজ করে সংসার চালান। কিন্তু কুখ্যাত বন্দিশালায় দুই মাস থাকার পর টাকা দিয়ে মুক্তি পেয়েছেন সাইদুর। বর্তমানে রয়েছেন মালয়েশিয়ায়। তবে সেখানে অবৈধ হওয়ায় কাজ করতে পারছেন না। অর্থাভাবে দিন কাটছে অনাহারে-অর্ধাহারে। সাইদুর মুক্তি পেলেও তার সফরসঙ্গী অপর ২৫ জন এবং বন্দিশালায় আগে থেকে থাকা বাংলাদেশিদের কপালে কী ঘটেছে, সে বিষয়ে কোনো তথ্য দিতে পারেননি তিনি।

সাইদুরের ভাষ্যমতে, ২০২২ সালের শেষদিকে প্রথমে দালালদের সঙ্গে মৌখিক চুক্তি হয় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকার। এর মধ্যে পাসপোর্টের সঙ্গে এক লাখ টাকা এবং ভিসা হওয়ার পর আরো এক লাখ। বাকি টাকা মালয়েশিয়া পৌঁছানোর পর। সে অনুযায়ী পাসপোর্টের সঙ্গে টাকা দেওয়ার দুই বছর পর ২০২৪ সালের জুনের ১৭ তারিখ মাহফুজুর রহমান ওরফে মাহফুজ মৃধা জানান, ভিসা হয়ে গেছে। টিকিটও অনলাইনে বুকিং দেওয়া হয়ে গেছে। তিনদিনের মধ্যে টিকিটের পুরো টাকা পরিশোধ না করলে বাতিল হয়ে যাবে। তাছাড়া টিকিটের টাকার সঙ্গে চুক্তির সব টাকা না দিলে সব বাতিল হয়ে যাবে। ব্যর্থ হলে ক্ষতিপূরণ হিসেবে মাহফুজদের পুরো টাকা দিতে হবে তার পরিবারকে।

এমন খবর জানার পর গোয়ালের গরু, মায়ের কানের গহনা বিক্রি এবং ঋণ করে জুনের ২০ তারিখ টাকা দেয় তার পরিবার। ৩০ তারিখ মালয়েশিয়া যাওয়ার জন্য ২৭ তারিখ বাড়ি থেকে বের হর ঢাকার উদ্দেশে। পরবর্তী সময়ে তিনি জানতে পারেন তার ফ্লাইট হবে না। মাহফুজ মৃধা, রুবেল, সজীব জমাদ্দাররা তাকে জানানÑ কেউই যেতে পারছে না। টাকা ফেরত চাইলে দালালরা বলেন, সব টাকা কোম্পানিকে দিয়ে ফেলেছেন। তবে সে যদি সময় দেয় তাহলে পরবর্তী পাঁচ মাসের মধ্যে তারা তাকে মালয়েশিয়া পাঠাবেন। এজন্য তারা স্ট্যাম্প করতেও রাজি। পরবর্তী সময়ে ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের মধ্যে মালয়েশিয়া না পাঠালে পূর্ণ টাকা ফেরত দেওয়ার চুক্তিতে একটি অঙ্গীকারনামায় স্বাক্ষর করেন রুবেল, মাহফুজ মৃধাসহ আরো দুজন।

গল্প এখানে শেষ হতে পারত। কিন্তু সাইদুরের ভাষ্যমতে, তিনি নিজেও জানতেন না তার জন্য কত ভয়াবহ অবস্থা অপেক্ষা করছে। তার ভাষ্যে, চুক্তির সময় পার হওয়ার পর অক্টোবরের দ্বিতীয় সপ্তাহে তাকে জানানো হয় ১৭ তারিখ সন্ধ্যায় ফ্লাইট। এজন্য ওই দিন সকালে ঢাকা এসে পাসপোর্ট সংগ্রহ করতে হবে।

পাসপোর্ট সংগ্রহ করার সময় তিনি দেখেন বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে আসা তারা ২৬ জনের গ্রুপ। প্রয়োজনীয় সবকিছু দিয়ে বলা হয়, এয়ারপোর্টের ভেতরে আমাদের লোক আছে। সেখানে প্রবেশ করে আমাদের ফোন দেবে। এরপর ঢাকা হযরত শাহজালাল (রহ.) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্রবেশ করার পর একজন এসে জিজ্ঞাসা করে তারা কার লোক। তখন মাহাবুবকে ফোন দিলে একটি সাংকেতিক কোড ‘কলা’ উচ্চারণ করার কথা বলা হয়।

কোড বলার পর সবার কাছ থেকে মালয়েশিয়ার টিকিট নিয়ে আরেকটি টিকিট দেওয়া হয়। বলা হয় টিকিটের অর্ধেক অর্থাৎ ঢাকা টু কলকাতা লেখা অংশ যেন বিমানে ওঠার পর ছিঁড়ে ফেলা হয় বা লুকিয়ে রাখা হয়।

তিনি জানান, ইমিগ্রেশনে যাওয়ার পর টিকিট দেখে জানতে চাওয়া হয় কোড কত? বলার পর কোনোকিছু বুঝে ওঠার আগেই দ্রুততার সঙ্গে বিকাল ৫টার দিকে বিমানে তুলে দেওয়া হয়। বাংলাদেশ সময় বিকাল ৫টা বেজে ১৫ মিনিটে ফ্লাইট ছাড়ার ৩০ মিনিট পর কলকাতায় নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করে।

তারপর স্থানীয় সময় রাত সাড়ে ৮টায় একই ফ্লাইটে তাদের নিয়ে ভিয়েতনামের উদ্দেশে ছেড়ে যায়। ভিয়েতনামের স্থানীয় সময় ১৮ তারিখ দুপুর ১টা বেজে ৪০ মিনিটে বিমান অবতরণ করে। ইমিগ্রেশনে তাদের কাছে ৮০০ ডলার দেখার পর পাস দেওয়া হয়।

বিমানবন্দর থেকে বের হয়েই বাস্তবতার সম্মুখীন হতে হবে তাদের। অপেক্ষারত দুই-তিনজন লোক জানতে চায় কোথা থেকে এসেছে এবং কোড কত? তখন দেশ ও কোড বলা হলে দ্রুততার সঙ্গে ছয়-সাতটা ছোট কারে তোলা হয়।

তিনি জানান, ইন্ডিয়ায় তাদের অল্প খাবার দেওয়া হয়েছিল। এ পর্যন্ত আর কোনো খাবার পেটে পড়েনি। তাছাড়া ভিয়েতনামের এই লোকেরা তাদের রিসিভ করার পর বাংলাদেশ থেকে কোনো দালাল আর যোগাযোগ রাখেনি। তখন তাদের বাধ্য হয়ে কম্বোডিয়া যেতে হয়।

পরে কয়েক ঘণ্টা গাড়িতে চড়ার পর তাদের কম্বোডিয়া নেওয়া হয়। এরপর পাঁচ-ছয় ঘণ্টা জঙ্গলে-খালে, নৌকায় ও হাঁটার পর হাতবদল করে আরেক গ্রুপের কাছে তাদের দেওয়া হয়। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কেন নিয়ে যাচ্ছেÑ জানতে চাইলে মারপিট করত। প্রায় দুদিন অনাহারে থাকায় অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ে। তখন তাদের বলা হতো খাল থেকে পানি ভরে রাখার জন্য। তাদের জন্য যদি ধরা পড়ে, তাহলে কাউকেই রাখবে না।

তিনি জানান, এভাবে আরো দুদিন চলার পর আরেক গ্রুপের কাছে হাতবদল করা হয়। অনুমানিক দুদিন হাঁটার পর থাইল্যান্ড বর্ডারে যখন পৌঁছান, ঠিক তখনই বর্ডার থেকে তাদের ওপর গুলি ছোড়া হয়। এমন পরিস্থিতে দালালরা তাদের রেখে দৌড়ে পালিয়ে আড়ালে গিয়ে হাতের ইশারায় দেখায় পেছনে চলে আসতে। কয়েক ঘণ্টা পর আরেক হাতবদল করে তারা। নদী পার হয়ে আখক্ষেতের ভেতর দিয়ে নিয়ে একটা কন্টেইনার ট্রাকে গাদাগাদি করে তোলে। ওই গাড়িতে করে সাত-আট ঘণ্টা পর তাদের নামিয়ে দেওয়া হয়। তখন তিনি একটা সাইনবোর্ডে কুয়ালালামপুর লেখা দেখে বুঝতে পারেন মালয়েশিয়া পৌঁছেছেন।

তখন আরেক হাতবদল করে একটি ভবনের কয়েক তলা উপরে তোলা হয়। দুই-তিনজন থাকার উপযুক্ত রুমে আমাদের তিন রুমের মধ্যে গাদাগাদি করে রাখা হয়। সঙ্গে পাসপোর্ট, মোবাইলসহ সবকিছু তাদের কাছে নিয়ে যায়। সেখানে দেখি আরেক দালালের আরো ৭০-৭৫ জন বাংলাদেশি আমাদের মতো অবস্থায়। তখন আর বুঝতে বাকি নেই যে, আমরা মাফিয়াদের হাতে পাচার হয়েছি।

সাইদুর বলেন, তখন সজীব জমাদ্দার নামে মালয়েশিয়া প্রবাসী দালাল তাদের ফোন দিয়ে বলে কেউ টাকা দেয়নি। এজন্য আমাদের কাছ থেকে যেন টাকা আদায় করা হয়। তখন প্রতিবাদ করায় আমার ওপর সবার আগে অমানবিক নির্যাতন নেমে আসে। এমন কোনো অত্যাচার নেই, তারা আমাকে করেনি। সবাইকে অত্যাচার করেছে। এরপর বাড়িতে ফোন দিয়ে টাকা চাওয়ার কথা বলে। না হলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয়। আমি বাড়িতে ফোন দিয়ে সবাইকে জানাই চার-পাঁচ লাখ টাকা সংগ্রহ করার জন্য। না হলে আমি ফিরতে পারব না। পরবর্তী সময়ে আমার পরিবার রুবেল, সজীব, মাহফুজদের সঙ্গে এলাকার মানুষ নিয়ে যোগাযোগ করার পর তারা অস্বীকার করে কিছু জানে না এবং টাকাও দেওয়া হয়নি। যখন স্ট্যাম্প দেখানো হয়, তখন তারা স্বীকার করে। এরপর হাত-পা ধরে দেশে রুবেলের হাতে ৩০ হাজার টাকা দিয়ে দুই মাস নির্যাতনের শিকারের পর টর্চার সেল থেকে মুক্তি পাই।

তার ভাষ্যে, মাহফুজ মৃধা লোক সংগ্রহ করে দেন, ক্যাশিয়ারের দায়িত্ব রুবেল আহমদের, বিমানবন্দর ম্যানেজ করেন আড়ালে থাকা মাহবুব এবং আন্তর্জাতিক রোড দেখেন সজীব জমাদ্দার।

সাইদুরের বর্ণনা অনুয়ায়ী সেলে থাকা আরেক গ্রুপের নোয়াখালীর সাইফুল ইসলাম নামে একজনের খোঁজ পায় আমার দেশ। তার কথায় সাইদুরের ভাষ্যমতে নির্যাতনের বর্ণনার মিল পাওয়া গেছে। তিনি বলেন, আমাদের গ্রুপের কারো ওপর তেমন নির্যাতন হয়নি, দালাল ভালো ছিল তাই। তবে নিজ চোখে দেখেছি সাইদুরের ওপর কীভাবে অত্যাচার হয়েছে। ছেলেটার চিৎকারে সবার কান্না পেতÑ বলেন সাইফুর।

এ বিষয়ে মাহফুজুর রহমান ওরফে মাহফুজ মৃধা আমারে দেশকে বলেন, সাইদুর আমার সম্পর্কে ভাতিজা হয়। আমি তার উপকার করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জানতাম না সজীব, রুবেলরা যে মানুষের সঙ্গে এমন করে। তিনি আরো বলেন, সজীব মাঝেমধ্যে দেশে আসেন। কিছুদিন থাকে আবার চলে যান। আমি এসব কিছু জানি না। মাহাবুবের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি ওনাকে চিনি না। রুবেল আর সজীব জমাদ্দার ছাড়া আর কাউকে চিনি না আমি। এ বিষয়ে রুবেল আহমদকে একাধিকবার ফোন দিলে রিসিভ না করায় তার বক্তব্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।

সজীব জমাদ্দার আমার দেশকে বলেন, কেউ যদি বিদেশ যেতে চায় আমার কী করার আছে। এখন সে যদি নিজ থেকে না জানে, তাহলে এই দায় আমার নয়। কোড ‘কলা’ বলে মালয়েশিয়া মাফিয়া পর্যন্ত কীভাবে গেলÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, সরাসরি আলাপ করব, আপনি কোথায় আছেন? তার মানে আপনি দেশে, প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, হ্যাঁ দেশে আসছি। মালয়েশিয়ার শ্রমবাজার বন্ধ তারপরও অবৈধভাবে কেন আপনারা নিয়ে পাচার করেছেনÑ এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, এটা পাচার না। কেউ যেতে চাইলে আমি আটকাব কেন বলে ফোনের সংযোগ বিচ্ছিন করেন তিনি।