
বাংলাদেশ সীমান্তে ভারতের জোরপূর্বক পুশইনে বড় ধরনের আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। গতকালও পঞ্চগড় সীমান্তে ১১ জন ও ঠাকুরগাঁও সীমান্ত দিয়ে ১৭ জনকে পুশইন করেছে ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। সব মিলিয়ে গত কয়েক দিনে ৩৯৮ জনকে জোরপূর্বক বাংলাদেশে প্রবেশ করানো হয়েছে। এ ছাড়া জোরপূর্বক পুশইন করাতে সীমান্তের কাছে প্রায় সহস্রাধিক মানুষকে জড়ো করেছে বিএসএফ। এর ফলে বাংলাদেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসী প্রবেশ, সীমান্তে সংঘাত ও আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের কারণে দুই দেশের সম্পর্কে উত্তেজনা দেখা দিতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, জাতীয় নিরাপত্তার স্বার্থে সীমান্তে সতর্কতার পাশাপাশি নজরদারিও বাড়াতে হবে।
বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, খাগড়াছড়ি, কুড়িগ্রাম, সিলেট, মৌলভীবাজারের বিভিন্ন সীমান্ত এলাকা দিয়ে এখন পর্যন্ত ভারত থেকে পুশইনের মাধ্যমে আসা ২৯২ জনকে আটক করেছে বিজিবি। তাদের মধ্যে ২৫৩ জন বাংলাদেশি, ১৯ জন রোহিঙ্গা এবং বাকি ২০ জনের পরিচয় এখনো শনাক্ত করা যায়নি। আর সাতক্ষীরা সীমান্ত থেকে কোস্টগার্ড আটক করেছে ৭৮ জনকে। এদের মধ্যে তিনজন জন্মসূত্রে ভারতের নাগরিক। সবশেষ গতকাল পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও সীমান্তে পুশইনের মাধ্যমে আসা আরও ২৮ জনকে আটক করে বিজিবি। এ নিয়ে মোট আটকের সংখ্যা ৩৯৮ জন। এ ছাড়া গত বৃহস্পতিবার ব্রাহ্মণবাড়িয়া সীমান্ত দিয়ে ৭৫০ জনকে পুশইনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় বিএসএফ। পাশাপাশি খাগড়াছড়ি সীমান্তেও পুশইনের জন্য প্রায় ৩০০ জনকে জড়ো করা হয়েছে।
অনুপ্রবেশকারী ব্যক্তিরা জানান, তাদের গুজরাট থেকে উড়োজাহাজে করে প্রথমে ত্রিপুরায় নিয়ে আসেন বিএসএফের সদস্যরা। তারপর কয়েক ঘণ্টা হাঁটিয়ে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে ঠেলে দেওয়া হয়। এদের ভিতর বাংলা ভাষাভাষী ছাড়াও রোহিঙ্গা ও গুজরাটি ভাষায় কথা বলা মানুষও ছিল বলে জানায় স্থানীয় প্রশাসন।
এদিকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় পুশইন না করায় বিএসএফের সঙ্গে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে প্রতিবাদলিপি পাঠিয়ে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। এ ছাড়া পুশইন রোধে বিজিবি সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল তৎপরতা বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে থেকে সজাগ দৃষ্টি রাখছে।
গতকাল সাতক্ষীরার শ্যামনগরে সুন্দরবনে বিজিবির ‘বয়েসিং ভাসমান বিওপি’ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, সিলেটের বিয়ানীবাজার, শ্রীমঙ্গল, হবিগঞ্জ; কুড়িগ্রামের রৌমারী উপজেলার প্রত্যন্ত চর এলাকা এবং পাবর্ত্য চট্টগ্রামের জনবসতিহীন সীমান্ত দিয়ে মূলত পুশইন করছে ভারত। গতকাল সকালেও পুশইন হয়েছে। প্রতিরোধ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে বিজিবি। তবে ভারতের সঙ্গে আমাদের বর্ডার বিস্তৃত হওয়ায় প্রতিটি জায়গা গার্ড করা সম্ভব নয়। এজন্য আমরা জনগণের সাহায্য চেয়েছি। পুশইন নিয়মবহির্ভূত কাজ। আমরা চাই এটা নিয়মমাফিক করা হোক।
তিনি আরও বলেন, পুশইনের ফলে জঙ্গি-সন্ত্রাসী দেশে ঢোকার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আমাদের দেশের জন্য, জাতির জন্য ক্ষতিকর হবে এমন কিছুই যাতে না হয়, সেজন্য আমরা নিরাপত্তা জোরদার করেছি। পুশইনের বিষয়টি আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে। সীমান্তে বিজিবির সার্বিক চেষ্টা অব্যাহত আছে। ফ্ল্যাগ মিটিং, প্রতিবাদলিপি এবং এ ধরনের রুটিন কাজ যেগুলো আছে, সেগুলো চলছে।
একই অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, পুশইনের মাধ্যমে আসা ব্যক্তিদের মধ্যে রোহিঙ্গা এবং ইউএনএইচসিআরের কার্ডধারী ব্যক্তিরাও রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে কূটনীতিক চ্যানেলে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পুশইনের বিষয়ে সরকার কঠোর অবস্থানে রয়েছে। ভারতকে আমরা জানিয়েছি-আমাদের কোনো বাংলাদেশি যদি তাদের (ভারতে) ওখানে থেকে থাকে তাহলে প্রপার চ্যানেলে পাঠান। যেমন ভারতের যারা বাংলাদেশে আছে তাদের আমরা প্রপার চ্যানেলে পাঠাই। আমরা কাউকে পুশইন করি না।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, সম্পর্কে চিড় ধরায় বাংলাদেশকে চাপে রাখার কৌশল হিসেবে পুশইন তৎপরতা চালাচ্ছে ভারত। পাশাপাশি এটি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরির নতুন কৌশলও হতে পারে। পুশইনের মাধ্যমে দেশে জঙ্গি-সন্ত্রাসীদের অনুপ্রেবেশের আশঙ্কা একেবারেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এমন পরিস্থিতিতে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোকে কঠোর নজরদারির আওতায় আনতে হবে। প্রয়োজন হলে পুশব্যাক করানোর পরিকল্পনাও সরকারকে মাথায় রাখতে হবে।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান জানান, ভারত কোনোভাবেই কোনো লোককে এভাবে পুশইন করতে পারে না। কোনো আইন সমর্থনও করে না। আমরা জানি না, ভারত কাদের পুশইন করছে, কেনই বা করছে। যদি তাদের কোনো অভিযোগ থাকে, কোনো বাংলাদেশি অবৈধভাবে ভারতে বসবাস করছে, তাহলে তারা আইনি প্রক্রিয়ায় বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের ফেরত পাঠাতে পারে। কিন্তু কোনোভাবেই এভাবে অজানা ব্যক্তিকে বাংলাদেশে পুশইন করার কোনো আন্তর্জাতিক আইন নাই। এ ব্যাপারে আমাদের সরকারের উচিত হবে খুব পরিষ্কার এবং জোরালো ভাষায় তাদের (ভারত) সরকারের সঙ্গে কথা বলা। নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমডোর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেছেন, এ পর্যন্ত যেটা হয়েছে সেটা অত্যন্ত অমানবিক এবং আন্তর্জাতিক আইনেরও পরিপন্থি। যদি পুশইন হওয়াদের মধ্যে কেউ বাংলাদেশের নাগরিক হয়, তবে আমরা তাদের নিতে বাধ্য, কিন্তু সেটা হস্তান্তরের একটা প্রক্রিয়া আছে। ডিপ্লোমেটিক চ্যানেলে তাদের আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে যোগাযোগ করে পাঠাবে। কিন্তু এভাবে গরু-ভেড়ার মতো সীমান্ত দিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে পাঠানো ঠিক নয়। এখন যেটা (ভারত) করছে সেটা বৈরীভাবাপন্ন রাষ্ট্রের ব্যবহার। এটা যদি বন্ধুরাষ্ট্র হতো তবে এ ধরনের ব্যবহার করতে পারত না। যেহেতু এখন বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক স্বাভাবিক নয়, এজন্য তারা এটা করছে। আমরা তো জানতে পেরেছি, সীমান্ত দিয়ে রোহিঙ্গাদের পুশইন করানো হচ্ছে। সীমান্তের অনেক জায়গা দিয়েই তারা পুশইন করাতে পারে। সেক্ষেত্রে সীমান্তে আমরা বাধা দিতেই পারি। ইতোমধ্যে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কথা বলেছে। বিষয়টি কূটনৈতিকভাবে সমাধানের চেষ্টা করছে।