
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বারবার আশার বাণী শোনাচ্ছেন। নতুন নতুন স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। একটি সমৃদ্ধ ও গণতান্ত্রিক দেশ গড়ে তুলতে তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। তাঁর যুগোপযোগী উদ্যোগ আর আশার বাণীতে কেউ আশস্ত হতে পারছেন না। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনশৃঙ্খলা, মামলাবাণিজ্য, চাঁদাবাজি, শিক্ষাঙ্গনে লাগাতার আন্দোলনসহ সব ক্ষেত্রে দিনদিন অসন্তোষ বাড়ছে। আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ ও একটি বিদেশি বিনিয়োগ সম্মেলন আয়োজন ছাড়া এখন পর্যন্ত কোনো দৃশ্যমান অগ্রগতি নেই।
যে ছাত্র-জনতা এ সরকারকে ক্ষমতায় বসিয়েছে, তাদের মধ্যেও অসন্তোষ দিনদিন বাড়ছে। ঢাকা নগর যেন সভা-সমাবেশ ও দাবি আদায়ের মোক্ষম ক্ষেত্রে পরিণত হচ্ছে। এ যেন চারদিকেই অস্থিরতা। আর এ দাবি আদায়ে সবার টার্গেট প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনা। অতীতে কোনো সরকারপ্রধানের বাসভবন মুখে এমন ঘন ঘন অভিযাত্রা দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতি নতুন মোড় নিয়েছে। প্রতিদিনই নতুন দাবিতে আন্দোলনে নামছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সচিবালয়ের উচ্চপদের কর্মকর্তা থেকে গ্রামপুলিশ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কলেজ, রিকশাচালক থেকে রেলকর্মী সবাই দাবি আদায়ের মিছিলে। ঢাকা যেন হয়ে উঠেছে ‘দাবির নগরী’। প্রশ্ন উঠছে, দাবির আন্দোলন থামছে না কেন? বিশ্লেষকরা বলছেন, দাবির আন্দোলনগুলো বিভিন্ন ধরনের। কিছু দাবি যৌক্তিক ও সময়োপযোগী। যেমন শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা বৃদ্ধি ও রেলকর্মীদের চাকরির নিশ্চয়তা ইত্যাদি। এ ছাড়া সামাজিক অস্থিরতা, বিশেষ করে শিক্ষা, চিকিৎসা ও কর্মসংস্থানসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অসন্তোষ বাড়ছে, যা দাবির আন্দোলনে রূপ নিচ্ছে।
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে রাষ্ট্র সংস্কার করতে ১১টি কমিশন গঠন করে। সংস্কার কমিশনের রিপোর্টের সঙ্গে রাজনৈতিক দল ও অংশীজনের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে একমত পোষণের জন্য গঠন করা হয়েছে ‘ঐকমত্য কমিশন’। বিভিন্ন কমিটি ও অংশীজনের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশন কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। তবে দৃশ্যত রাজনৈতিক ঐকমত্যের অগ্রগতি হয়নি। বরং পারস্পরিক অবিশ্বাস, বিদ্বেষ, কাদা ছোড়াছুড়ি আরও বাড়ছে। কেউ কেউ সরকারের দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার পক্ষে। আবার কেউ চায় চলতি বছরের ডিসেম্বরেই নির্বাচন হোক। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, চলতি বছরের ডিসেম্বর থেকে আগামী জুনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু সরকারের এ ঘোষণার প্রতি বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলের আস্থা নেই।
এদিকে মানবিক করিডর, বন্দর, পুশইনসহ নানা ইস্যুতে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থার সংকট বাড়ছে। করিডর ও বন্দর স্পর্শকাতর বিষয়গুলো বিদেশিদের হাতে তুলে না দিতে রাজনৈতিক দলের নেতারা সরকারকে বারণ করছেন। ফলে সংকট তীব্র হচ্ছে। ভালো নেই ব্যবসায়ীরা। নানা সংকটে গতিহীন ব্যবসাবাণিজ্য। ব্যবসায়ীদের কাছে কোথায়ও কোনো সুখবর নেই। না পারছেন ভালোভাবে ব্যবসা করতে, না পাচ্ছেন অনুকূল পরিবেশ। ব্যবসায়ী সংগঠনের শীর্ষ নেতারা বলছেন, অনেক দিন ধরেই বিনিয়োগে চরম মন্দাভাব অব্যাহত রয়েছে। এর সঙ্গে নতুন করে গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধি দেশের বেসরকারি খাতের প্রতিযোগিতা-সক্ষমতাকে রীতিমতো চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। অন্যদিকে ব্যাংক ঋণের উচ্চ সুদহার, ডলারের উচ্চমূল্য, তীব্র গ্যাসসংকট ও শিল্পোদ্যোক্তাদের নানাভাবে হয়রানি করা হচ্ছে। বিশেষ করে ভুয়া মামলায় ব্যবসায়ীদের নাম ঢুকিয়ে চাঁদাবাজির অভিযোগ উঠছে। ফলে নানা সংকটে রয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তারা নির্বিঘ্নে ব্যবসা করতে না পারলে অর্থনীতির চাকাও ঘুরবে না। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর দেশের বিভিন্ন থানায় জুলাই গণ অভ্যুত্থানে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় যেমন মামলা হয়েছে, তেমনি আহত হওয়ার বিষয়েও মামলা হয়েছে অনেক। এসব মামলায় প্রকৃত আসামি, সন্দিগ্ধ ব্যক্তির পাশাপাশি হয়রানিমূলকভাবেও অনেককে আসামি করা হয়েছে। যাদের মধ্যে বেশির ভাগ প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, অন্যত্র থাকা মানুষ ও অরাজনৈতিক ব্যক্তি রয়েছেন। একটি পক্ষ সুকৌশলে মামলা দিয়েও বাণিজ্য করছেন। কোনো কোনো ব্যবসায়ীর কাছ থেকে কোটি কোটি চাঁদা দাবি করছেন, সে টাকা না দিলেই নাম ঢুকিয়ে দিচ্ছেন হত্যা মামলায়। এমন হয়রানি মামলার নজির আগে কখনো দেখা যায়নি বলেই জানান সংশ্লিষ্টরা।
এদিকে অর্থনীতির উল্লেখযোগ্য খাত দেশের শেয়ারবাজার নিয়ে বিনিয়োগকারী ও সংশ্লিষ্টরা মোটেই স্বস্তিতে নেই। বাজারের বেহাল দশায় দিশাহারা বিনিয়োগকারীরা প্রায় প্রতিদিনই আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। এ অবস্থায় গত রবিবার প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে অংশীজনের বৈঠকের পর দুই দিন বাজারে ইতিবাচক প্রভাব পড়লেও তৃতীয় দিন থেকে আবারও পতনের ধারায় ফিরে গেছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিনিয়োগকারীরা নতুনভাবে আন্দোলন কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছেন। শেয়ারবাজারের লেনদেন তলানিতে নেমে যাওয়ায় ব্রোকারেজ ও মার্চেন্ট ব্যাংক মালিকদের মধ্যেও হতাশা তৈরি হচ্ছে। তারা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতনসহ আনুষঙ্গিক ব্যয় কীভাবে নির্বাহ করবেন তার কূলকিনারা পাচ্ছেন না। শিক্ষা খাতেও স্বস্তির কোনো খবর নেই। মঙ্গলবার মধ্যরাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহরিয়ার আলম সাম্য রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ছুরিকাতঘাতে নিহত হন। মেধাবী শিক্ষার্থী হত্যার বিচার চেয়ে বৃহস্পতিবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্ধদিবস হরতাল পালন করা হয়েছে। গতকালও বিচারের দাবিতে শাহবাগ থানা ঘোরাও করেন শিক্ষার্থীরা। গত ৯ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন শিক্ষার্থী নিহত হয়েছেন দুর্বৃত্তের হাতে। এদিকে আবাসন ব্যবস্থাসহ চার দফা দাবি আদায়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে নামে। ধারাবাহিক আন্দোলনের কারণে সরকার জবির ছাত্র-শিক্ষকদের দাবি মেনে নিয়েছে। খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়েও কয়েক দিন আগে অচলাবস্থা ছিল। রবিবারও এ বিশ্ববিদ্যালয়ে আন্দোলনের খবর গণমাধ্যমে এসেছে। এ ছাড়া বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে উপাচার্যসহ কয়েকজনকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন দাবিদাওয়া নিয়ে শাহবাগে আন্দোলন করেছেন নার্সি ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। প্রায় প্রতিদিনই দেশের বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নতুন নতুন ইস্যূ নিয়ে অশান্তি ও সংকট তৈরি হচ্ছে। জুলাই অভ্যুত্থানের আন্দোলন সংগ্রামের পর পুলিশ এখনো পুরোপুরি ‘ট্রমা’ কাটিয়ে উঠতে পারেনি। নানামুখী উদ্যোগ নেওয়া হলেও এখনো ট্রমার মধ্যে রয়েছে পুলিশ। সশস্ত্র বাহিনীকে বিচারিক ক্ষমতা দিয়ে মাঠে নামানোর ফলে আইনশৃঙ্খলা কিছুটা স্বাভাবিক হচ্ছে। তবে পুরোপরি বন্ধ হয়নি ‘মব জাস্টিস’। যেখানে-সেখানে যে কেউই মবের শিকার হচ্ছেন। দ্রুত মব জাস্টিজ বন্ধ না হলে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি আরও অবনতির ঘটার শঙ্কা রয়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। আওয়ামী লীগ আমলের চেয়ে বর্তমানে চাঁদাবাজির পরিমাণ বেড়েছে। চাঁদা না পেয়ে বাড়িঘর জায়গা ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানও দখল করে নিচ্ছে। চাঁদাবাজদের চাহিদা পূরণ না হলে করা হচ্ছে নানা হয়রানি। ফাঁসিয়ে দেওয়া হচ্ছে মিথ্যা মামলায়।