
২০১১ সালে কীর্তনখোলার পারে প্রতিষ্ঠিত বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) পথচলার ১৪ বছর পেরিয়ে গেলেও অব্যাহত রয়ে গেছে নানামুখী সংকট। এই সময়ে দায়িত্ব পালন করেছেন পাঁচজন উপাচার্য (ভিসি), যার মধ্যে তিনজনই শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে অনাকাঙ্খিত বিদায় নিতে বাধ্য হন। কিন্তু বারবার প্রশাসন বদলালেও বদলায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুরবস্থা। প্রতিনিয়ত শিক্ষার্থীর সংখ্যা বাড়লেও বাড়েনি শ্রেণিকক্ষ, গবেষণাগার, আবাসন কিংবা পর্যাপ্ত শিক্ষক। নেই পর্যাপ্ত একাডেমিক ভবন, নেই আধুনিক সুযোগ-সুবিধাও। শ্রেণিকক্ষ ও শিক্ষক সংকটের কারণে অধিকাংশ বিভাগে সেশনজট এখন স্থায়ী রূপ নিচ্ছে।
সংকটের পাহাড়, পরিকল্পনার ঘাটতি
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্র জানায়, বর্তমানে প্রায় ১১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে মাত্র দুটি একাডেমিক ভবন। ছেলেদের ও মেয়েদের জন্য রয়েছে দুটি করে আবাসিক হল, যেখানে মাত্র ২৩ শতাংশ শিক্ষার্থী আবাসন সুবিধা পাচ্ছেন। ২৫টি বিভাগের জন্য মোটে ৩৬টি শ্রেণিকক্ষ, ফলে এক ব্যাচ ক্লাসে থাকলে অন্য ব্যাচগুলোকে বাইরে অপেক্ষা করতে হয়। বর্তমানে ১৬৭ জন শিক্ষক দিয়ে চলে প্রায় ১৫০টি ব্যাচের শিক্ষা কার্যক্রম। এর মধ্যে অনেকে আবার শিক্ষা ছুটিতে থাকায় পাঠদান কার্যক্রম ব্যাহত হচ্ছে। শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অফিসকক্ষ সংকট, নেই অডিটোরিয়াম, মানসম্পন্ন গবেষণাগার কিংবা আধুনিক গ্রন্থাগার সুবিধা। সবমিলিয়ে শিক্ষার্থীদের হতাশা দিন দিন বাড়ছে।
সংকটের দায় কার?
প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপে অন্তত ১১ জন শিক্ষার্থী অভিযোগ করেন, বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটের পেছনে অন্যতম কারণ শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি। তাদের ভাষ্যে, বেশিরভাগ আন্দোলনের নেপথ্যে ছিল ব্যক্তিগত স্বার্থ ও দ্বন্দ্ব। শিক্ষকদের একটি অংশ শিক্ষার্থীদের উসকে দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধি করে থাকেন। আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে পরে পদ-পদবি নিয়েই ব্যস্ত হয়ে পড়েন অনেকে। এক শিক্ষার্থীর ভাষায়, যতক্ষণ শিক্ষকরা সৎ ও শিক্ষার্থীবান্ধব না হবেন, ততক্ষণ এই সংকট কাটবে না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস ঘেঁটে দেখা যায়, অস্থিরতা আর আন্দোলনের ছায়া যেন কোনো সময়ই থামেনি। সম্প্রতি ৫ম উপাচার্য অধ্যাপক শুচিতা শরমিনকে শিক্ষার্থীদের ২৯ দিনের আন্দোলনের মুখে সরকার অপসারণ করে। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম নারী ভিসি ছিলেন। এর আগে ৩য় উপাচার্য মো. ছাদেকুল আরেফিনের আমলে শিক্ষক ও কর্মকর্তাদের দ্বন্দ্ব থেকে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে রূপ নেয় চার-পাঁচবার। ছাদেকুল আরেফিন ও প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য অধ্যাপক মো. হারুনর রশিদ খানই পূর্ণ মেয়াদ শেষ করতে পেরেছিলেন। ৪র্থ উপাচার্য মোহাম্মদ বদরুজ্জামান ভূঁইয়াও ছয় মাসের মাথায় শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সবচেয়ে বেশি আন্দোলনের মুখে পড়েন ২য় ভিসি এস এম ইমামুল হক। তার বিরুদ্ধে দুই দফায় আন্দোলন হয়ে একবার ১৫ দিন এবং পরের বার টানা ৪৪ দিন বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকে।
যা বলছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা
ববির মৃত্তিকা ও পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থী সাব্বির রহমান বলেন, চৌদ্দ বছর পার হলেও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়নি। অনেক সময় গাদাগাদি করে ক্লাস করতে হয় বা খোলা আকাশের নিচে বসতে হয়। হলে জায়গা না পেয়ে অনেকে উচ্চ ভাড়ায় মেসে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
ববি শিক্ষার্থী মোকাব্বেল শেখ এনামুল দেশ রূপান্তরকে বলেন, গুটিকয়েক শিক্ষকের রাজনৈতিক সম্পৃক্ততার কারণেই আজ বিশ্ববিদ্যালয় এমন অবস্থায় পৌঁছেছে। তারা বিভিন্ন নিয়োগ ও প্রশাসনিক তথ্য রাজনৈতিক নেতাদের কাছে সরবরাহ করে নিজেদের জন্য পদ-পদবি নিশ্চিত করেন। ক্যাম্পাসে শিক্ষক মহলে প্রভাব বিস্তার করে তারা অস্থিরতা তৈরি করছেন, যার ফলেই বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্বিক পরিবেশ দিন দিন নাজুক হয়ে পড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বদলে এটি এখন রাজনৈতিক কার্যালয়ে পরিণত হয়েছে।
সর্বশেষ ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক সুজয় শুভ বলেন, চিন্তাভাবনা এবং পরিবেশের দিক থেকে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয় এখনও একটি পূর্ণাঙ্গ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়নি। মূল চ্যালেঞ্জ হলো অপর্যাপ্ত অবকাঠামো। বিগত উপাচার্যরা এসব সমস্যা সমাধানে আন্তরিক ছিলেন না। বরং বারবার অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠীদ্বন্দ্ব ও রাজনীতির ফাঁদে পড়ে তারা পথভ্রষ্ট হয়েছেন।
পরিসংখ্যান বিভাগের চেয়ারম্যান আহসানুল হক বলেন, আমরা মাত্র দুইজন শিক্ষক ৬-৭টি ব্যাচের ক্লাস চালাচ্ছি। প্রত্যেককে ১৮-২০টি কোর্স পড়াতে হয়। এই চাপ আমাদের ব্যক্তিগত জীবন ও ক্যারিয়ারে প্রভাব ফেলছে। তবুও চেষ্টা করছি যেন সেশনজট না হয়।
জীববিজ্ঞান অনুষদের ডিন ড. হাফিজ আশরাফুল হক দেশ রূপান্তরকে বলেন, শিক্ষকরা নিজেদের পদ পদবির জন্য দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে অসুস্থ প্রতিযোগিতায় নামেন। তাদের একটি অংশ বিভিন্ন প্রশাসনিক পদ বাগিয়ে নিয়ে শিক্ষকদের মধ্যে মাফিয়াতন্ত্র কায়েম করতে চায়। কোনও ভিসি যদি একটি পক্ষের ঘনিষ্ঠ হন, তখনই অন্য পক্ষ তার বিরুদ্ধে অবস্থান নেন। ফলে বারবার সৃষ্টি হয় অস্থিরতা। এতে করে বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরি হয়। যতদিন এই অসুস্থ প্রতিযোগিতা বন্ধ না হবে, ততদিন প্রকৃত উন্নয়ন সম্ভব নয়।
নবনিযুক্ত (অন্তর্বর্তীকালীন) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ তৌফিক আলম বলেন, শিক্ষার্থীরাই আমাদের মূল শক্তি। আমি সবসময় শিক্ষার্থীবান্ধব মনোভাব নিয়ে কাজ করি এবং আগামীতেও সেই লক্ষ্যেই এগিয়ে যেতে চাই। আমার বিশ্বাস, আন্তরিকভাবে চেষ্টা করলে কোনও সমস্যাই সমস্যা থাকে না। একটু বুদ্ধি ও সদিচ্ছা থাকলেই সমাধান বেরিয়ে আসে।