
লক্ষ্মীপুরে অবৈধ অস্ত্রের গরমে সন্ত্রাসীরা আবার বেপরোয়া হয়ে উঠছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সাম্প্রতিক সময়ে ছোট-বড় অন্তত ২২টি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তাদের হাতে বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক দেশি-বিদেশি আগ্নেয়াস্ত্র আছে। অস্ত্র ঠেকিয়ে চাঁদাবাজি, হত্যা, গুলি, ধর্ষণ, অপহরণ, ডাকাতি, দখল, মাদক ব্যবসা, মুক্তিপণ আদায়সহ বিভিন্ন অপরাধের প্রতিযোগিতা চালানো হচ্ছে।
ভুক্তভোগীরা ভয়ে আইনের আশ্রয়ও নিতে পারছে না। বাহিনীগুলোর বহু সদস্যের বিরুদ্ধে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলায় মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশও আছে। তদুপরি তারা প্রকাশ্যেই অস্ত্রের মহড়া দিচ্ছে। লক্ষ্মীপুরে সন্ত্রাসীর গুলি থেকে রেহাই পাচ্ছে না শিশু, সাংবাদিক, রাজনৈতিক নেতা। সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার, অবৈধ ও থানা থেকে লুট হওয়া অস্ত্র উদ্ধারে স্থানীয় লোকজন, বিএনপি ও জামায়াত নেতারা দাবি জানালেও ফল মিলছে না।
লক্ষ্মীপুরে একের পর এক অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। যেমন গত ৭ এপ্রিল আধিপত্য বিস্তার নিয়ে স্থানীয় রায়পুরের উত্তর চরবংশীতে দুই গ্রুপের রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে বিএনপি ও স্বেচ্ছাসেবক দল নেতা নিহত হন। ৩ ফেব্রুয়ারি সদরের গণশ্যামপুরে চার সাংবাদিককে গুলিবিদ্ধ করা হয়।
১ এপ্রিল সদরের বশিকপুরের কাশিপুরে ঘরে ঢুকে ছয় বছরের শিশুকে গুলি করা হয়। ১২ এপ্রিল পূর্ব চৌপল্লীতে রুবেল হোসেনের বাঁম হাতের কবজিতে গুলি করে সন্ত্রাসীরা। লক্ষ্মীপুর প্রেস ক্লাবের সাধারণ সম্পাদক সাঈদুল ইসলাম পাভেল বলেন, সদরের পূর্বাঞ্চলে অবৈধ অস্ত্রের ঝনঝনানি চলছে। সন্ত্রাসীরা প্রকাশ্যে অস্ত্র নিয়ে ঘুরছে। অস্ত্রের ব্যবহারে খুনসহ অপরাধ বাড়ছে।জনজীবনের নিরাপত্তা নেই।
গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ত্যাগ করলে আওয়ামী লীগবিরোধী বিক্ষুব্ধ নেতাকর্মীরা রায়পুর ও রামগঞ্জ থানায় হামলা, অগ্নিসংযোগ করেন। থানা থেকে পুলিশের বিভিন্ন অস্ত্র লুট করে নেওয়া হয়। জেলা পুলিশ জানায়, জেলায় এক বছরে ১৬টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। র্যাব-১১ নোয়াখালী ক্যাম্প জানায়, অভিযানে দেড় বছরে ৩৭টি আগ্নেয়াস্ত্র উদ্ধার করা হয়। এ সময় মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ৭৬ এবং অস্ত্র মামলার আরো ২০ আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়। জেলা প্রশাসন সূত্র জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারির পর দেওয়া অস্ত্রের লাইসেন্স বাতিল করে জমা দেওয়ার জন্য নির্দেশনা দিয়ে প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। ৩ সেপ্টেম্বর অস্ত্র জমা দেওয়ার শেষ দিনের মধ্যে ৩৩টি লাইসেন্স করা অস্ত্র জমা পড়ে। তবে তার মধ্যে জেলা যুবলীগের সাবেক সভাপতি এ কে এম সালাহ উদ্দিন টিপুর লাইসেন্সকৃত অস্ত্রটি ছিল না।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৯৪ সালের ১০ জুন লক্ষ্মীপুরে প্রথম রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হয়। তখন বিএনপির হরতাল চলাকালে হামছাদীর হাসন্দি গ্রামে জেলা ছাত্রলীগের সদস্য শহিদুল ইসলাম বাচ্চুকে পিটিয়ে ও কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক আবু তাহের ও তাঁর পরিবারের সদস্যরা বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। ২০০০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর জেলা বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা জজ আদালতের পিপি নুরুল ইসলামকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করে লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। তখন তাহের ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বেপরোয়া সন্ত্রাসে জনপদ জিম্মি হয়ে পড়ে। ২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় এলে সন্ত্রাসীরা আরো এক ধাপ বেপরোয়া হয়ে ওঠে। নিজেদের নামে ৫০টি সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে তোলে। আধিপত্য বিস্তারে প্রতিযোগিতা করে চলে খুনাখুনি, চাঁদাবাজি, ধর্ষণ, অপহরণ, লুটপাটসহ নানা অপকর্ম। প্রতিটি বাহিনীতে ৫০ থেকে ২০০ সদস্য ছিল। ২০১৮ সাল থেকে সক্রিয় থাকে কমপক্ষে ২২টি বাহিনী। তখন অবশ্য পরিস্থিতি সামাল দিতে সন্ত্রাসবিরোধী যৌথ অভিযানে বেশির ভাগ বাহিনীর প্রধান ও সহযোগীরা ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা যান।
সন্ত্রাস রুখতে চাঁদা তুলে থানা নির্মাণ : সদর উপজেলার পূর্বাঞ্চলে অহরহ খুনসহ অন্য সব অপরাধে মানুষ অতিষ্ঠ। গুলির মুখে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকেও পিছু হটতে হয়েছে। বহু পুলিশও গুলিবিদ্ধ হয়েছে। ২০১৪ সালের ২ জুন চন্দ্রগঞ্জ পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রকে থানা ঘোষণা করা হয়। তখন পূর্বাঞ্চলের সন্ত্রাসকবলিত চন্দ্রগঞ্জ, চরশাহী, দিঘলী, হাজীরপাড়া, দত্তপাড়া, বশিকপুর, উত্তর জয়পুর, মান্দারী, কুশাখালী ইউনিয়ন নিয়ে চন্দ্রগঞ্জ থানার কার্যক্রম শুরু হয়। তৎকালীন পুলিশ সুপার (এসপি) শাহ মিজান শাফিউর রহমান বাজারের ব্যবসায়ীসহ গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে থানা বাস্তবায়ন কমিটি করেন। সন্ত্রাস রুখতে তাঁরা প্রায় ৩০ লাখ টাকা চাঁদা তুলে নিজেরাই চন্দ্রগঞ্জ থানা ভবন নির্মাণ করেন। যদিও পরে অন্য স্থানে থানা ভবন করা হয়েছে।
শুধু বশিকপুরেই ২৪ খুন : তথ্যানুসন্ধানে জানা গেছে, শুধু সদর উপজেলার বশিকপুর ইউনিয়নেই ২৫ বছরে ২৪ রাজনৈতিক নেতাকর্মী খুন হন। সন্ত্রাসীরা গুলি করে ও কুপিয়ে তাঁদের হত্যা করেছে। ১৯৯৮ সালে প্রথম প্রকাশ্যে দফাদার আবুল কাশেমের পায়ে গুলি করেন আবুল কাশেম জিহাদী। সেই থেকে শুরু। সর্বশেষ একসঙ্গে হত্যার শিকার হন জেলা যুবলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আবদুল্লাহ আল নোমান ও জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক রাকিব ইমাম। এ হত্যার প্রধান আসামি বাহিনীর প্রধান আবুল কাশেম জিহাদী পালিয়ে ভারতে অবস্থান করছেন। সেখান থেকে তিনি ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ব্যক্তিকে ভয়েস এসএমএস পাঠিয়ে হুমকি দিচ্ছেন। কাশেম জিহাদীর কলকাঠিতে বশিকপুরে এখন আবার সন্ত্রাসীরা সংগঠিত হচ্ছে বলে তথ্য পাওয়া গেছে। নোমান-রাকিব হত্যা মামলার বাদী ও বশিকপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান কালের কণ্ঠকে বলেন, সন্ত্রাসীরা ঘাপটি মেরে বসে আছে। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নাজুক থাকায় সন্ধ্যার পর থেকে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বাড়ে।
বাহিনীর প্রধান মারা গেলে আতঙ্ক বাড়ে : সদর উপজেলায় একসময় ৫০টি সন্ত্রাসী বাহিনী রাজত্ব চালায়। বলা হতো, বিরোধ বাধলেই গুলি, পান থেকে চুন খসলেই গুলি। প্রতিদিনই কোথাও না কোথাও গোলাগুলির ঘটনা ঘটত। রক্ষা পেতে পরিবার-পরিজন নিয়ে এলাকা ছেড়ে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালীতে পালিয়ে গেছে অনেকেই। তবে কোনো বাহিনীর প্রধান মারা গেলে মানুষের আতঙ্ক বেড়ে যেত। বাহিনীর প্রধানরা মারা গেলে সন্ত্রাসীরা বিভক্ত হয়ে পড়ে, তৈরি করা হয় উপবাহিনী। অস্ত্র ভাগবাটোয়ারা ও হাত বদল হয়। স্থানীয় সূত্র জানায়, বিভিন্ন সময়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর অভিযানে শীর্ষ সন্ত্রাসী বাহিনীর প্রধান সোলেমান উদ্দিন জিসান, দিদার বাহিনীর দিদার, সোলেমান বাহিনীর সোলেমান, নাছির বাহিনীর নাছির, শামীম বাহিনীর শামীম, সেলিম বাহিনীর সেলিম, বাবুল বাহিনীর আসাদুজ্জামান বাবুল, লাদেন বাহিনীর মাসুম বিল্লাহ ওরফে লাদেন মাসুমসহ আরো কয়েকজন নিহত হন। বাহিনীর প্রধান মনির, আনোয়ার, মামুন, ভুলু, সুজন, কামাল, সাফু, রতন, মোসলেহ উদ্দিন মুন্নাও নিহত হন। তাঁদের বিপুল অস্ত্র উদ্ধার করা হয়নি। বাহিনীগুলোর তৎপরতা সাময়িকভাবে থেমে গেলেও পরে বেশির ভাগ বাহিনীর নেতৃত্ব দলের অন্য কেউ নিয়েছে। নিহতদের স্ত্রী, ভাই, ছেলেসহ নিকটাত্মীয়রা ‘নিজেদের ত্যাগের’ কথা তুলে নতুন বাহিনী গড়ার চেষ্টা করছেন। বাহিনীর প্রধানরা নিহত হলেও সংশ্লিষ্ট বাহিনীর সদস্যরা কেউ এলাকা ছেড়েছিল, কেউ পেশা বদল করেছিল। রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ও পুলিশের নিষ্ক্রিয়তার দরুন তারা এলাকায় ফিরেছে। প্রকাশ্যে সশস্ত্র মহড়া দিচ্ছে তারা।
লক্ষ্মীপুরের বিভিন্ন দুর্গম এলাকায় বিভিন্ন বাগানে মুখোশ পরে অবস্থান করছে সন্ত্রাসীরা। তাদের হাতে থাকছে রাইফেল, শটগান ও একনলা বন্দুকসহ বিভিন্ন ধরনের অস্ত্র। একাধিক বাহিনী সূত্র জানায়, পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা এসব বাহিনীর কাছ থেকে মাসোহারা নেন। ফলে সন্ত্রাসীরা নিরাপদেই আছে। জানা গেছে, জেলার শীর্ষ সন্ত্রাসী আবুল কাশেম জিহাদী ভারতে অবস্থান করছে। গ্রেপ্তার হয়নি সন্ত্রাসী কদু আলমগীর, পিচ্চি সোলায়মান, বাবর, কাউসার মানিক বাদল, আবদুর রহিম অনিক, রামগতির জলদস্যু খোকন ও শেখ ফরিদ। সন্ত্রাসীদের মধ্যে আওয়ামী লীগ নেতা নুর উদ্দিন নুরু হত্যা মামলার আসামি মো. খোকনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) জেলা সভাপতি কামাল হোসেন বলেন, দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক দলের নেতাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সন্ত্রাসী বাহিনী গড়ে উঠছে। অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর তেমন সফলতা নেই। এতে মানুষ নির্যাতনের শিকার হয়েও আরো বড় বিপদের ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পায় না।
বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব ও জেলা কমিটির আহবায়ক শহীদ উদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, আওয়ামী লীগ আমলের অবৈধ অস্ত্র আর ৫ আগস্ট থানা থেকে লুট হওয়া সব অস্ত্র এখন সন্ত্রাসীদের হাতে। তারা অস্ত্র দিয়ে সমাজে অপকর্ম করছে। এই অস্ত্র দিয়ে আবার ভোটকেন্দ্র দখলে যাবে, এ জন্য নির্বাচনের আগেই অস্ত্র উদ্ধার করতেই হবে।
জেলা জামায়াতের সাধারণ সম্পাদক ফারুক হোসেন নুরনবী বলেন, রাষ্ট্রীয়ভাবে অস্ত্র উদ্ধারে আরো কঠোর নির্দেশনা প্রয়োজন। র্যাব-১১-এর নোয়াখালী ক্যাম্পের কম্পানি অধিনায়ক (ভারপ্রাপ্ত) মিঠুন কুমার কুণ্ডু বলেন, আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটলে অপরাধীরা ছাড় পাবে না। আমাদের নিয়মিত অভিযানে অস্ত্র উদ্ধার এবং মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজাপ্রাপ্ত বেশ কিছু আসামি ধরা হয়।
লক্ষ্মীপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ক্রাইম অ্যান্ড আপস) মো. হাসান মোস্তফা স্বপন বলেন, ‘আগ থেকেই চন্দ্রগঞ্জ থানা এলাকায় বিভিন্ন সন্ত্রাসী বাহিনীর দাপট ছিল। তারা সহিংসতা চালাত। অস্ত্র উদ্ধার ও সন্ত্রাস দমনে আমরা কাজ করছি। এরই মধ্যে দুটি থানা থেকে লুট হওয়া চার-পাঁচটি ছাড়া বাকি অস্ত্রগুলো উদ্ধার হয়েছে।