Image description
নির্বাচন প্রলম্বিত হওয়ার শঙ্কা

আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধের মধ্যে বিভিন্ন পক্ষের নানান দাবি এবং আইনশৃঙ্খলার অবনতিতে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে বলে মনে করছে বিএনপি। উদ্বিগ্ন দলটির শঙ্কা, ঘটনাক্রম যেভাবে এগোচ্ছে, আগামীতে তা সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে। এতে নির্বাচন নিয়ে যে জনআকাঙ্ক্ষা এবং নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রে উত্তরণের যে পথ, সেটি আরও অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়তে পারে। বিদ্যমান পরিবেশকে ধোঁয়াশাচ্ছন্ন বলে মনে করছে বিএনপি। নেতারা বলছেন, অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদের নয় মাসেও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা না করাটাই একটা রহস্য।

গত কয়েক দিনে দেখা গেছে, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে বিএনপি নেতারা তাদের উদ্বিগ্নতার কথা নানা অনুষ্ঠানে প্রকাশ করছেন। কুমিল্লা শিল্পকলা একাডেমিতে গত বৃহস্পতিবার এক কর্মসূচিতে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, হয়তো আরও দেরিতে নির্বাচনের কথা বলতাম, কিন্তু এখনই কেন বলছি? কারণ আমি দেখছি, আমার দেশের

স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব, ভৌগোলিক অখণ্ডতা নিরাপদ নয় এই সরকারের হাতে। একই দিন জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক মানববন্ধনে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ফ্যাসিবাদকে অনেকে শক্তি দিয়ে সহযোগিতা করছে। তাই সরকারকে বলব, ডানে-বাঁয়ে সবদিকে তাকিয়ে যথাযথভাবে দেশ শাসন করুন, না হলে কেউ রক্ষা পাবেন না। কোনো বিশেষ রাজনৈতিক দল বা আদর্শকে প্রতিষ্ঠিত করতে গেলে জনগণ ধরে ফেলবে। এ ছাড়া গতকাল শুক্রবার লক্ষ্মীপুরে এক অনুষ্ঠানে দলটির যুগ্ম মহাসচিব শহীদউদ্দীন চৌধুরী এ্যানি বলেন, শাহবাগ ও যমুনায় আন্দোলন হচ্ছে, কোনো মিছিলে বা সমাবেশে তো পুলিশ টিয়ার গ্যাসের শেল-লাঠিচার্জ করে না। তাহলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের ওপর হামলা-লাঠিচার্জ কেন করা হয়েছে? আবার এক উপদেষ্টার ওপর হামলা হয়েছে; সবকিছুই ষড়যন্ত্রের অংশ, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য।

বিএনপি মনে করে, অবনতিশীল ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে নির্বাচনই একমাত্র পথ। দলটির নেতারা বলছেন, সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে সরকারের উচিত সংকট উত্তরণে দ্রুত সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়ে দেশকে নির্বাচনমুখী করা। তবে সরকার নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি করলে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে। দলটি মনে করে, চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠান সম্ভব।

অসন্তুষ্টি থাকলেও বিএনপি অবশ্য এই সরকারের বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো আন্দোলনে যেতে চায় না। শুরু থেকেই সরকারকে সর্বতোভাবে সহযোগিতা করে আসছে দলটি। বিএনপি নেতারা বলছেন, এখনো সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ ঘোষিত না হওয়ায় সরকার এবং গণঅভ্যুত্থানের সঙ্গে যুক্ত যারা সরকারে আছেন, তারা আগামী নির্বাচনকে কোন পথে নিয়ে যেতে চান, সেটি পরিষ্কার নয়।

জানা গেছে, দলটি সামনে আরও কয়েক মাস পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করবে। আগামী দু থেকে তিন মাস তারা সরকারের মতিগতি দেখবে। এরপরও নির্বাচন নিয়ে সরকারের তরফ থেকে সুনির্দিষ্ট দিনক্ষণ না পেলে, সেক্ষেত্রে দলীয় অবস্থানে পরিবর্তন আসতে পারে বিএনপির। তখন মাঠের কর্মসূচিতেও যেতে পারে দলটি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু কালবেলাকে বলেন, দেশের মানুষ গত ১৫-১৬ বছর ধরে ভোটাধিকার বঞ্চিত। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারা এখন ভোট দিতে উন্মুখ, এজন্য তারা দ্রুত নির্বাচন চায়। রাজনৈতিক দলগুলোও দ্রুত নির্বাচনের দাবি জানাচ্ছে; কিন্তু সরকার এখনো নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি। রোডম্যাপ দিতে বিলম্ব হওয়ায় দেশে নানা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে। তাই সরকারের উচিত, দ্রুত সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দিয়ে দেশকে নির্বাচনমুখী করা। তখন এসব দাবি-দাওয়া আর আসবে না। অন্তর্বর্তী সরকার তখন বলতে পারবে, নির্বাচিত সরকার আসুক, আপনাদের যা দাবি-দাওয়া আছে, নির্বাচিত সরকারের কাছে তখন জানাবেন।

আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধকরণ ইস্যু থেকে শুরু করে বিভিন্ন সেক্টরের লোকজন নানা ধরনের দাবি-দাওয়া নিয়ে একের পর এক মাঠে নামছে। জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)সহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের আন্দোলনের মুখে গত সোমবার আওয়ামী লীগের যাবতীয় কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে প্রজ্ঞাপন জারি করে সরকার। এর পরপরই শুরু হয় আবাসন সংকট নিরসনসহ তিন দফা দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় (জবি) শিক্ষার্থীদের আন্দোলন, যা চলমান রয়েছে। এর মধ্যেই গত মঙ্গলবার রাতে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে দুর্বৃত্তের ছুরিকাঘাতে নিহত হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্যার এএফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনাবিষয়ক সম্পাদক শাহরিয়ার আলম সাম্য। এসব ঘটনায় রাজনীতি ও রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে।

বিএনপির দায়িত্বশীল একজন নেতা বলেন, কোনো দেশে গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে কোনো সরকার এলে এ ধরনের ঘটনা ঘটে। তবে আমাদের এখানে বেশিই হচ্ছে। নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে পরিস্থিতি ক্রমেই অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। কী হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না।

বিএনপি মনে করছে, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি থেকে শুরু করে সামাজিক, রাজনৈতিক তথা সামগ্রিক পরিস্থিতি ধীরে ধীরে সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। থেমে থেমে নানা ধরনের জটিলতা তৈরি হচ্ছে। সংস্কারের প্রক্রিয়াও ধীরগতিতে এগোচ্ছে। এটা নিয়ে রাজনৈতিক মতৈক্য তৈরি না হওয়া এবং একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে কোন সংস্কারগুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে আগে হওয়া উচিত, সরকার এখনো সেটি ঠিক করতে না পারায় সংস্কারের মূল লক্ষ্য অর্জিত হবে কি না, তা নিয়েও দলটি এক ধরনের শঙ্কার মধ্যে আছে। বিএনপি বারবার বলে আসছিল, একটি অবাধ-সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যে ধরনের সংস্কার প্রয়োজন, সরকারের উচিত সেগুলোকে গুরুত্ব দেওয়া। সরকার গঠিত সংস্কার কমিশনগুলোর রিপোর্ট নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর ভিন্ন ভিন্ন মত রয়েছে। ফলে সব ইস্যুতে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করা খুবই কঠিন কাজ। দলটি মনে করে, এ অবস্থায় সরকারের উচিত, রাজনৈতিক দলগুলো যেসব সংস্কারে একমত হয়েছে, সেগুলোকে ফোকাস করা এবং সেগুলোর ভিত্তিতে সামনে অগ্রসর হওয়া।

জানা গেছে, বিএনপির তরফ থেকে নির্বাচন নিয়ে এখনো ব্যাপক উৎকণ্ঠা রয়েছে। গত ১০ মে রাতে দলের স্থায়ী কমিটি বৈঠকেও এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। সেখানে কোনো কোনো নেতা বলেন, নির্বাচন নিয়ে সরকার টালবাহানা করছে। আগামী নির্বাচনকে তারা কোন পথে নিয়ে যেতে চান, সেটি পরিষ্কার নয়। তারা আসলে নির্বাচন দিতে পারবেন কি না, সেটা নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন কেউ কেউ। দলটি মনে করে, সরকারের এমন কোনো পরিস্থিতি তৈরি করা উচিত নয়, যেখানে নির্বাচনের দাবিতে রাজনৈতিক দলগুলোকে আবার রাস্তায় নামতে হয়। সেটা হবে খুব বিব্রতকর। সরকার কোনো বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়ুক, বিএনপি সেটা চায় না।

বিএনপি নেতারা বলছেন, সরকার নির্বাচন নিয়ে গড়িমসি করলে তাদের বিব্রতকর পরিস্থিতির মধ্যে পড়তে হতে পারে। সম্প্রতি দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, তিনি আশঙ্কা করছেন—গণতান্ত্রিক যাত্রাপথে, গণতান্ত্রিক উত্তরণের পথপরিক্রমায় যদি দীর্ঘায়িত পদক্ষেপ নেওয়া হয়, কৌশল অবলম্বন করা হয়, হয়তো সরকার বিব্রত হতে পারে সামনে। সালাহউদ্দিন আহমেদের এ বক্তব্যকে খুবই তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে করছেন অনেকে।

এদিকে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ নিয়ে স্থায়ী কমিটির আলোচনা ও সিদ্ধান্তের আলোকে গত রোববার বিবৃতি দেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

বিবৃতিতে দ্রুত নির্বাচনের দাবি পুনর্ব্যক্ত করে বলা হয়, দীর্ঘ ১৬ বছর ধরে জনগণ তাদের ভোটাধিকার তথা গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যেই ফ্যাসিবাদের পতনের জন্য গুম-খুন, জেল-জুলুম সহ্য করেও অব্যাহত লড়াই করেছেন। তাদের সেই দাবি এখনো অর্জিত হয়নি। নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ (রূপরেখা) ঘোষিত না হওয়ায় জনমনে যে ক্ষোভের সৃষ্টি হচ্ছে, সে ব্যাপারে সচেতন হওয়ার জন্য অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান বিএনপির মহাসচিব। দলটি এর মধ্য দিয়ে নির্বাচন ইস্যুতে সরকারকে এক ধরনের ‘বার্তা’ দিল বলে মনে করেন অনেকে।