Image description
যাত্রাবাড়ীতে সংঘবদ্ধ ধর্ষণ

রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে দায়ের করা মামলার এজাহারভুক্ত আসামিদের গ্রেপ্তার করলেও টাকার বিনিময়ে তাদের ছেড়ে দিয়ে নিরপরাধ এক ব্যক্তিকে আসামি সাজিয়ে আদালতে চালান দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে পুলিশের বিরুদ্ধে। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করা ভুক্তভোগী নারীই এমন অভিযোগ করেছেন। তিনি বলছেন, পুলিশ যে ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে পাঠিয়েছে, তিনি তাকে চেনেন না। তবে থানা পুলিশ বলছে, তারা যাকে ধরে চালান করেছে তিনিই আসল অপরাধী। এদিকে, এই মামলা সম্পর্কিত তথ্য চাইতে গিয়ে যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রমজানুল হকের কক্ষে মারধরের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন এক সাংবাদিক।

মামলার এজাহার সূত্রে জানা যায়, মামলার বাদী ভুক্তভোগী নারী ডিভোর্সি। তার সঙ্গে মাহবুবুল হাসান আপেল খান নামে একজনের প্রেমের সম্পর্ক চলছিল। গত ১৮ মার্চ আপেল খান তার কয়েকজন বন্ধুকে নিয়ে ওই নারীর বাসায় গিয়ে বিয়ের প্রস্তাব দেয়। তবে ছেলের পরিবারের সম্মতি ছাড়া এই নারী বিয়েতে রাজি না হওয়ায় আপেল ও তার বন্ধুরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওই নারীকে ধর্ষণ করে। পরে ভুক্তভোগী নারী ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন এবং পরদিন ১৯ মার্চ যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়ে ধর্ষণের অভিযোগে মামলা করেন। মামলায় আসামি করা হয় মাহবুবুল হাসান আপেল খান, রফিকুল ইসলাম রনি ও হুমায়ুন কবির খান ওরফে মিরাজকে। ধর্ষণে সহায়তাকারী হিসেবে আসামি করা হয় মো. ইয়াছিন, হায়াত আলী ও মো. রুবেল নামে আরও তিনজনকে। এ ছাড়া ধর্ষণের ভিডিও ধারণ করার অভিযোগে রুনিয়া ও শিরিন নামের দুই তরুণীকে আসামি করা হয়।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, থানায় মামলা দায়েরের পরপরই অভিযান চালায় পুলিশ। অভিযানের সময় সঙ্গে রাখা হয় এজাহারভুক্ত আসামি কথিত সাংবাদিক রফিকুল ইসলাম রনিকে। অভিযানে আসামি মিরাজকে আটক করা হয়। একই সময়ে বেলাল শেখ নামে একজনকে আটক করা হয়, যিনি একটি কলার দোকানের কর্মচারী। পরে এজাহারভুক্ত আসামিদের ছেড়ে দিয়ে বেলালকে মিরাজ সাজিয়ে আদালতে চালান করা হয়। এরপর ‘২৪ ঘণ্টার মধ্যেই ধর্ষণ মামলার আসামি গ্রেপ্তার যাত্রাবাড়ী থানা পুলিশের’ শিরোনামে এজাহারভুক্ত আসামি কথিত সাংবাদিক রনি সেই অভিযানের ভিডিও বানিয়ে ফেসবুক ও ইউটিউবে প্রচারও করেন। আবার কিছুক্ষণ পরই সেই ভিডিও তিনি সরিয়েও নেন। তবে ভিডিওটি কালবেলার হাতে রয়েছে।

ভুক্তভোগী ওই নারী কালবেলাকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে যারা খারাপ কাজটি করেছে তাদের সবাইকে আমি চিনি। আমি তাদের নাম ঠিকানা, পিতার নামসহ থানায় মামলা করেছি। কিন্তু পুলিশ অভিযানেই গেছে আমার মামলার এজাহারভুক্ত আসামি রনিকে নিয়ে। এরপর তারা মিরাজকে ধরেও ছেড়ে দিয়েছে। পুলিশ ওই দুই আসামির কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। অন্যদিকে বেলাল শেখ নামের একজনকে তারা আসামি সাজিয়ে চালান করে দিয়েছে। ওই বেলাল শেখকে আমি চিনি না। আমি বিষয়টি থানায় গিয়েও বলেছি। কিন্তু পুলিশ সেটা মানতে চাচ্ছে না।’

এই নারী আরও জানান, পরে শহিদুল ইসলাম রাজু নামে স্থানীয় এক সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মীকে সঙ্গে নিয়ে তিনি থানায় যান। থানায় গিয়ে রাজু আসামিকে ছেড়ে দিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি বানিয়ে চালান দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে উত্তেজিত হয়ে পড়েন থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. রমজানুল হক। একপর্যায়ে রুমের মধ্যেই ওই সাংবাদিককে মারধর করেন পরিদর্শক রমজান।

সাংবাদিক শহিদুল ইসলাম রাজু কালবেলাকে বলেন, ‘আসামিকে ছেড়ে দিয়ে নিরপরাধ ব্যক্তিকে আসামি বানিয়ে চালান দেওয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মো. রমজানুল হক উত্তেজিত হয়ে পড়েন। একপর্যায়ে রুমের মধ্যেই আমাকে মারধর করেন তিনি। এ বিষয়ে মুখ খুললে বিভিন্ন মামলায় ফাঁসিয়ে দেওয়ারও হুমকি দেন তিনি। পরে সেখান থেকে বের হয়ে স্থানীয় ডিসি অফিসসহ পুলিশের বিভিন্ন দপ্তরে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি।’

ভুক্তভোগী ওই নারীর বক্তব্যের সত্যতা মেলে মামলার নথিপত্র ঘেঁটেও। মামলার এজাহারে দেখা যায়, ৬ নম্বর আসামির নাম হুমায়ুন কবির খান ওরফে মিরাজ, তার বাবার নাম মান্নান, ঠিকানা দেওয়া ঝালকাঠির নলছিটি থানার সরমহল গৌড়িপাশা গ্রাম। অন্যদিকে পুলিশের আদালতে চালান দেওয়া নথিতে দেখা যায়, তিন নম্বরে লেখা হুমায়ুন কবির খান ওরফে মিরাজ ওরফে বেলাল শেখ। পিতার নাম আ. মালেক। আর ঠিকানা দেওয়া বাঘেরহাটের মোরলগঞ্জ থানার গোবিন্দপুর গ্রাম। অর্থাৎ এজাহারে থাকা আসামির সঙ্গে পুলিশের আটক করা আসামির নাম ঠিকানা কিংবা পিতার নাম—কোনোটিরই মিল নেই।

জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থানার পরিদর্শক (তদন্ত) রমজানুল হক বলেন, ‘বাদী যে আসামির বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেছেন আমরা তাকেই আটক করে আদালতে চালান করেছি। এখন বাকিটা আদালতে সিদ্ধান্ত হবে।’ কিন্তু বাদী তো বলছেন মিরাজ বলে আপনারা যাকে হাজতে পাঠিয়েছেন বাদী তাকে চেনেন না— এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।

জানতে চাইলে যাত্রাবাড়ী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফারুক আহমেদ কালবেলাকে বলেন, ‘এমন ঘটনা কোনোভাবেই কাম্য নয়। আমি বিষয়টি জানি না। আপনি পরিদর্শক তদন্তের (রমজানুল) সঙ্গে কথা বলেন। তার সঙ্গে কথা হয়েছে জানালে ওসি বলেন, ‘তাহলে আমি আর কী বলব!’

সার্বিক বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপপুলিশ কমিশনার হারুন অর রশিদ কালবেলাকে বলেন, ‘সাংবাদিককে লাঞ্ছনার বিষয়টি আমার জানা নেই। সংঘবদ্ধ ধর্ষণের একটি মামলা হয়েছে। মামলা তদন্ত চলছে—সংঘবদ্ধ ধর্ষণে যে যে আলামত হয়, সেগুলো আমরা আমলে নেব। তদন্ত শেষে বলা যাবে।’

কলা দোকানের কর্মচারীকে ফাঁসানোর বিষয়ে বলেন, ‘ওই অফিসারকে স্যাক (বরখাস্ত) করা হয়েছে। বিষয়টি তদন্ত চলছে। কেউ ভুক্তভোগী হলে সে যেন বিচার পায় আবার কেউ যাতে বিনা অপরাধে হয়রানির শিকার না হয়—দুটি বিষয়েই আমরা দেখব।’