
রাজধানীর শহর খিলগাঁও মৌজার সিএস ৩১২ নম্বর দাগে প্রায় ৩২ কাঠা সরকারের জমি আছে। এ জমির বাজারমূল্য প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা। অধিগ্রহণ করা এসব জমি সঠিকভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করায় আগের মালিকদের নামে খতিয়ান সৃষ্টি হয়েছে। ওই খতিয়ানমূলে অবৈধ দখলদাররা ওইসব জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।তারা জানান, শহর খিলগাঁও মৌজায় ৮০/৬০-৬১ নম্বর এলএ কেসের মাধ্যমে এ জমিসহ আশপাশের বেশকিছু জমি অধিগ্রহণ করা হয়। সরকারের অধিগ্রহণ করা ওই এলাকার অধিকাংশ জমিই বেদখল হয়ে গেছে। অধিগ্রহণ করা ওইসব জমি থেকে একসময় মাটি কেটে রেলওয়ের লাইন তৈরিতে ব্যবহার করায় সেখানে বড় জলাশয়ের সৃষ্টি হয়েছিল।
সরকারের অধিগ্রহণকৃত জায়গাজুড়ে তৈরি জলাশয় ভরাট করে সেমিপাকা স্ট্রাকচার গড়ে তুলে ভাড়া বাণিজ্যও করছেন দখলদাররা। স্থানীয় অসাধু চক্র সরকারি জমি দখল করে গড়ে তুলেছে রিকশার গ্যারেজ। এছাড়া খুপরি ঘর তুলে সেখানে মাদক ব্যবসা এবং অসামাজিক কার্যক্রমও পরিচালনা করছে। এসব কারণে ওই এলাকায় প্রায় ২০০ পরিবারের বসবাস করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শহর খিলগাঁও মৌজার সিএস ৩১২ নম্বর দাগের ৩২ কাঠা জমির দখলে রয়েছেন শেখ মো. সারওয়ার হোসেন।
অনুসন্ধানে জানা যায়, শহর খিলগাঁও মৌজার অধিগ্রহণকৃত জমির সিএস রেকর্ডের দাগ নম্বর ৩১২। ওই দাগে জমির পরিমাণ ৫২ শতক বা প্রায় ৩২ কাঠা। এসএ রেকর্ডে জমির পরিমাণ বেড়ে হয়েছে ৩৮ কাঠা বা ৬৩ শতক এবং আরএস ও সিটি জরিপে জমির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪০ কাঠা বা ৬৫ শতক। ওই পুরো জমির শ্রেণি হিসাবে দেখানো রয়েছে ঝিল। কিন্তু দখলদাররা বহুদিন থেকে ওই জায়গার একাংশে মাটি ফেলে ভরাট করে উঁচু করেছে। সেখানে সেমিপাকা ঘর তুলে ভাড়া বাণিজ্যের পাশাপাশি কয়েকজনের কাছে বিক্রি করে মোটা অঙ্কের টাকাও আত্মসাৎ করেছে। বিক্রির পর দলিলও করে দিয়েছে। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, ২০১০ সালের ১ এপ্রিল সিটি খতিয়ান ৫৭৬ থেকে শেখ মো. সারওয়ার হোসেন, পিতা মৃত শেখ নূর মোহাম্মদ শহর খিলগাঁও মৌজার ৬৫ শতক সরকারি সম্পত্তির ভুয়া মালিক নিযুক্ত হন। সাবরেজিস্ট্রি অফিসের ৩০৯৮নং আমমোক্তারনামা দলিলের মাধ্যমে তিনি মালিকানার (ভুয়া) দাবিদার হন। এরপর ওই ভুয়া মালিক সিটি ৫৭৬ খতিয়ানের ৭০৬ নম্বর দাগ থেকে ২০১০ সালের ৫ এপ্রিল খিলগাঁও সাবরেজিস্ট্রি অফিসে ৩৫৫২/১০ নম্বর বায়নানামা দলিল মারফতে সরকারি অধিগ্রহণকৃত ৭ কাঠা জমি বিক্রি করেন। ফিরোজ মিয়া গং ওই জমি কিনে নেন। এরপর সিটি খতিয়ানের ৫৭৬-এর ৭০৬ নম্বর দাগ থেকে ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর আরও ৮ কাঠা জমি বিক্রি করেন। ১৩ হাজার ১৯০ নম্বর দলিল মারফতে ওই জমি কিনেন আবু হেনা মোস্তফা রফিক। বাকি অংশও বিক্রির প্রক্রিয়া চলছে। এছাড়া ৩১১ নম্বর দাগের দখলদার মতি গংয়ের থাবায় ঝিল ও খাল ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।
এলাকাবাসী গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং রামপুরা থানায় বিভিন্ন সময়ে একাধিকবার অভিযোগ করেছন। সেখানে তারা বলেছেন, সরকারের অধিগ্রহণকৃত জায়গায় দখলদাররা বেশকিছু রিকশা, অটোরিকশা, সিএনজি গ্যারেজ, দোকান, গরুর খামার, কারখানাসহ বিভিন্ন ধরনের স্থাপনা নির্মাণ করেছেন। ওইসব জায়গায় বখাটে ছেলেরা আড্ডা দেয়, চিৎকার-চ্যাঁচামেচি করে। তাদের মধ্যে মারামারিও লেগেই থাকে। এতে ওই এলাকার বাসিন্দারা এবং বিশেষ করে নারী ও শিশুরা সব সময় আতঙ্কে থাকে। মেয়েরা অলিগলিতে প্রতিদিনই ইভটিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন।
ভুক্তভোগীদের আরও অভিযোগ, গণপূর্ত অধিদপ্তরের আওতাধীন শহর খিলগাঁও মৌজার ঝিল ও খাল ভরাট করে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ করায় ওই এলাকা বসবাস উপযোগিতা নষ্ট হয়েছে। অসাধু ও দখলদারচক্রের অবৈধ ও অসামাজিক কার্যক্রমের কারণে মানুষের জানমালের নিরাপত্তা এবং পরিবেশ মারাত্মক হুমকিতে পড়েছে। অবৈধ দখলে নেওয়া জায়গায় গড়ে তোলা ঘরগুলোয় লোকজন ধরে নিয়ে নির্যাতনের ঘটনা ঘটছে। গভীর রাতে সেখান থেকে কান্নাকাটি, চ্যাঁচামেচির আওয়াজ পাওয়া যায়। দিনরাত চলে অস্ত্রের মহড়া।
দখলদারদের বক্তব্য : অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সিএস ৩১২ নম্বর দাগের দখলদার শেখ মো. সারওয়ার হোসেন যুগান্তরকে জানান, অভিযোগ সত্য নয়। তিনি এ সম্পর্কে কিছুই জানেন না। তার নামের ভুয়া দলিল এবং যাদের কাছে বিক্রি করেছেন, তাদের বিষয় তুলে ধরলে সত্যতা স্বীকার করেন। যুগান্তরকে বলেন, জমি নিয়ে অনেক মামলা চলছে। যাদের নামে আমি জমি দলিল করেছি, তারা রেজিস্ট্রি অফিসের লোক। আমাকে ভুল বুঝিয়ে এটা করেছে। এখন তাদেরকে এ এলাকায় দেখি না। এরপর এই প্রতিবেদকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে বিশেষ অনুরোধ জানান।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামীম আখতার যুগান্তরকে জানান, শহর খিলগাঁও মৌজার গণপূর্তের জায়গাগুলো বেদখল এবং জালজালিয়াতি করে বিক্রির ঘটনা তার জানা নেই। দায়িত্বপ্রাপ্ত সংশ্লিষ্টদের বিষয়টি খতিয়ে দেখতে নির্দেশ দেবেন। অবৈধ দখলদারচক্র সেখানে থাকলে তাদের উচ্ছেদ করা হবে এবং সরকারি সম্পদ রক্ষায় আইনানুগ ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হবে।