Image description
যুক্ত হচ্ছে আগাম অবসর ও অক্ষমতাজনিত সুবিধা

গ্রহণযোগ্যতা আরও বাড়াতে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে বড় ধরনের সংস্কার আনা হচ্ছে। এর আওতায় ‘স্বেচ্ছায় আগাম অবসর পেনশন’ ও ‘অক্ষমতাজনিত পেনশন’ নামে দুটি নতুন সুবিধা যুক্ত হবে। এছাড়া মেয়াদ শেষে জমাকৃত অর্থের ৩০ শতাংশ আনুতোষিক সুবিধার বিধান চালু হচ্ছে। অর্থাৎ মোট জমার ৩০ ভাগ টাকা তুলে নিতে পারবেন পেনশনারভোগী। আর ১০ বছর স্কিমের চাঁদা দেওয়ার পর অগ্রিম অফেরতযোগ্য ২০ শতাংশ টাকা গ্রহণ করা যাবে। মাঠ পর্যায়ে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে ডিজিটাল মার্কেটিংসহ আউটসোর্সিংয়ে নিয়োজিত জনবলকে স্কিমের আওতায় নিয়ে আসা হচ্ছে।

বুধবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে ‘জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের’ পরিচালনা পর্ষদ বৈঠকে এসব সংস্কারের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তবে ‘স্বেচ্ছায় আগাম অবসর পেনশন’ এবং ‘অক্ষমতাজনিত পেনশন’ আরও পর্যালোচনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষকে। ওই বৈঠকে সর্বজনীন পেনশনের যে চারটি স্কিম আছে, এর মধ্যে প্রবাসী ও প্রগতি স্কিমের চাঁদার হার প্রতি মাসে দুই হাজার থেকে কমিয়ে এক হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়। প্রগতি পেনশন স্কিমের একাংশে বেসরকারি খাতের কর্মকর্তাদের (যাদের গড় মাসিক আয় তুলনামূলক বেশি) জন্য মাসিক সর্বোচ্চ জমার অঙ্ক ১৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে, যা আগে ছিল ১০ হাজার টাকা। এছাড়া ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সর্বজনীন পেনশন স্কিমে ইসলামিক ভার্সন ও মোবাইলভিত্তিক অ্যাপ চালু করা হবে। এই অ্যাপ ব্যবহার করে চাঁদা জমা দেওয়াসহ পেনশন স্কিমের সংশ্লিষ্ট সব ধরনের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে।

বৈঠক সূত্রে জানা যায়, বাণিজ্যিক ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রগতি স্কিমের আওতায় আনতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে এ বিষয়ে উদ্যোগ নিতে অনুরোধ জানানো হয়। এছাড়া বিদ্যমান স্কিমগুলো আরও আর্কষণীয় করতে স্বাস্থ্যবিমা চালু এবং ট্রেজারি বিল ও বন্ডের বাইরে পেনশনের টাকা অন্য খাতে বিনিয়োগ নিয়ে আলোচনা হয়। বর্তমান পেনশনের টাকা ট্রেজারি বিল ও বন্ডে বিনিয়োগ হচ্ছে। ২০২৪ সালের অক্টোবর পর্যন্ত পেনশনের টাকা বিনিয়োগ থেকে মুনাফা এসেছে ২ কোটি ১২ লাখ টাকা। নতুন খাতে বিনিয়োগের জন্য সর্বজনীন পেনশন তহবিল (বিনিয়োগ ও সংরক্ষণ) সংশোধনের বিষয় আলোচনায় উঠে আসে। তবে সেখানে বলা হয়েছে, যখন ভিন্ন খাতে পেনশনের অর্থ বিনিয়োগ করা হবে, ওই সময় সংশোধনী আনা হবে।

সূত্র আরও জানায়, জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষকে আরও শক্তিশালী করতে ৫৭টি পদে জনবল নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এছাড়া এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) অর্থায়নে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষ একটি প্রকল্প নিয়েছে, যা ২০২৬ সালের জুন থেকে শুরু হবে বলে বৈঠকে জানানো হয়। সেখানে আরও বলা হয়, ইতোমধ্যে প্রাথমিক উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব (পিডিপিপি) অনুমোদন হয়েছে এবং প্রকল্পের সম্ভাব্য সমীক্ষা ও উন্নয়ন প্রকল্পের প্রস্তাব (ডিপিপি) প্রণয়ন শুরু হয়েছে। জানতে চাইলে জাতীয় পেনশন কর্তৃপক্ষের সদস্য (ফান্ড ম্যানেজমেন্ট) মো. গোলাম মোস্তফা বুধবার যুগান্তরকে জানান, স্বেচ্ছায় আগামী অবসর পেনশন ও অক্ষমতাজনিত পেনশন সুবিধা চালুর বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে। এ বিষয়ে আরও পর্যালোচনা করা হবে। আগামী দিনে এ দুটি স্কিম ছাড়াও সংস্কারের মাধ্যমে সর্বজনীন পেনশনের আওতায় নতুন নতুন বিষয় যুক্ত হবে। এটি চলমান প্রক্রিয়া, যা বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এভাবেই করছে।

স্বেচ্ছায় আগাম অবসর পেনশন : পেনশনপ্রাপ্তির জন্য বর্তমান বয়সসীমা হচ্ছে ৬০ বছর। কিন্তু এ সময়ের আগে যেসব ব্যক্তি অস্থায়ী চাকরি করছে বা ৬০ বছরের আগে চাকরি থাকার সম্ভাবনা কম অর্থাৎ যে কোনো সময় চাকরি হারাতে পারেন-এমন ব্যক্তিরা পেনশনের চাঁদা পরিশোধ এবং সর্বজনীন পেনশনে যুক্ত হতে আগ্রহী নন। এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হচ্ছে। প্রস্তাব অনুযায়ী, কেউ যদি চাকরি হারান অথবা কর্মহীন হয়ে পড়েন-সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির বয়স ৪০ বছর হলেই পেনশন পাবেন। তবে শর্ত হচ্ছে-ন্যূনতম ১০ বছর বা মোট ১২০টি পেনশন স্কিমে চাঁদা পরিশোধ করতে হবে। উল্লেখ্য, বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী, পেনশন পাওয়ার জন্য ৬০ বছর পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।

ওই বৈঠকে আলোচনায় পোশাকশিল্পের ৭৩ শতাংশ শ্রমিকের চাকরি অস্থায়ী। যে কোনো সময় চাকরি হারানোর ঝুঁকি থাকায় তারা পেনশন স্কিমে আসতে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। ফলে তাদের পেনশন পাওয়ার বয়সসীমা কমিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা হয়।

অক্ষমতাজনিত পেনশন : পেনশন স্কিমে যুক্ত হওয়ার ১০ বছর অথবা মোট ১২০টি মাসিক চাঁদা প্রদানের পর কোনো চাঁদাদাতা দুর্ঘটনা বা গুরুতর অসুস্থজনিত কারণে শারীরিক অক্ষম হয়ে পড়লে তাকে নির্ধারিত সময়ের আগেই পেনশন সুবিধা প্রদান করা হবে। এক্ষেত্রে শারীরিকভাবে অক্ষমতা মেডিকেল বোর্ডের সুপারিশ থাকতে হবে, তবেই পেনশনের জন্য আবেদন করতে পারবেন। সেক্ষেত্রে মাসিক পেনশনের পরিমাণ চাঁদাদাতার মোট জমাকৃত অর্থের ওপর ভিত্তি করে নির্ধারিত হবে।

পেনশনারদের এককালীন আনুতোষিক প্রদান : নিয়মিত মাসিক চাঁদা দেওয়ার পর পেনশনযোগ্য বয়স অর্থাৎ ৬০ বছরে পা রাখলে সংশ্লিষ্ট পেনশনার আগ্রহী হলে জমাকৃত অর্থের সর্বোচ্চ ৩০ শতাংশ অর্থ আনুতোষিক হিসাবে প্রদান করা হবে। সেক্ষেত্রে আনুতোষিক অর্থ তুলে নেওয়ার পর অবশিষ্ট অর্থের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট পেনশনারকে মাসিক পেনশনের টাকা দেওয়া হবে। তবে কোনো চাঁদাদাতা আনুতোষিক নিতে আগ্রহী না হলে জমাকৃত পুরো অর্থের ওপর মাসিক পেনশন পাবেন।

২০২৩ সালের ১৭ আগস্ট সর্বজনীন পেনশন স্কিম আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করলেও চাঁদার বিপরীতে সুদহার ব্যাংকের আমানতের সুদহারের চেয়ে কম হওয়া এবং অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা কম থাকায় নিবাসী ও অনিবাসীদের এসব স্কিমে কাঙ্ক্ষিত মাত্রায় আগ্রহী করা যায়নি। সোমবার পর্যন্ত প্রবাস স্কিমে যুক্ত হয়েছেন ৯৭২ জন। সরকার এ কর্মসূচি জনপ্রিয় করতে প্রচার-প্রচারণার বিভিন্ন উদ্যোগ নিলেও তা সফলতার মুখ দেখছে না। সর্বজনীন পেনশন স্কিম কর্তৃপক্ষের হিসাব অনুযায়ী, সোমবার পর্যন্ত স্কিমগুলোয় মোট রেজিস্ট্রেশন করেছেন ৩ লাখ ৭৩ হাজার ৭৪১ জন। মোট টাকা আদায় হয়েছে ১৭৬ কোটি ৬৬ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা। এর মধ্যে প্রগতি স্কিমে যুক্ত হয়েছেন ২৩ হাজার ১১০ জন, সুরক্ষায় ৬৩ হাজার ৫০৮ জন, সমতায় ২ লাখ ৮৬ হাজার ১৫১ জন।

জমা অর্থের ২০ শতাংশ এককালীন উত্তোলন : পেনশন স্কিমে ১০ বছর বা ১২০টি কিস্তির টাকা পরিশোধের পর বিশেষ প্রয়োজনে জমা অর্থের সর্বোচ্চ ২০ শতাংশ টাকা অগ্রিম হিসাবে প্রদান করার বিধান থাকছে। অর্থাৎ ৪০ বছরে এসে কেউ স্থায়ীভাবে চাকরি হারালে বা কর্মহীন হয়ে পড়লে সেসময় কোনো আয়বর্ধক কাজের জন্য ওই টাকা তুলে নিতে পারবেন। এই অর্থ আর ফেরত দিতে হবে না। সেক্ষেত্রে অবশিষ্ট অর্থের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট পেনশনারকে মাসিক পেনশনের টাকা দেওয়া হবে।