Image description
বিনামূল্যের বইয়ের কাগজ

বিনামূল্যের পাঠ্যবই ছাপানো নিয়ে বিতর্ক যেন কিছুতেই থামছে না। এই বই ছাপানোর জন্য আমদানি করা কাগজে শুল্ক ছাড়ের সুযোগ নিয়ে একটি চক্র হাতিয়ে নিয়েছে প্রায় ২৮ কোটি টাকা। কম দামে কাগজ আমদানি করে বেশি দামে বিক্রি করে তারা বড় অঙ্কের কমিশন বাণিজ্য করেছে বলে অভিযোগ। আর এর সঙ্গে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) কয়েকজন শীর্ষ কর্মকর্তা, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) এক বিতর্কিত নেতা এবং একটি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের নাম উঠে এসেছে।

এনসিটিবির দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, এই কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগে এনসিটিবির সদ্য বিদায়ী চেয়ারম্যান রিয়াজুল হাসানের চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ আটকে গেছে, সচিব আল ফিরোজ ফেরদৌসকে ওএসডি, সদস্য অধ্যাপক ড. রিয়াদ চৌধুরীসহ তিন কর্মকর্তাকে তদন্তের আওতায় আনা হয়েছে। পাশাপাশি কাগজে কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগে গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে দল থেকে সাময়িক বহিষ্কার করেছে এনসিপি।

প্রাপ্ত নথিপত্র অনুযায়ী, গত জানুয়ারিতে বই ছাপার কাজ শুরু হওয়ার পর পেপার মিলগুলো পরিকল্পিতভাবে কাগজের কৃত্রিম সংকট তৈরি করে দাম বাড়াতে থাকে। মাত্র ১৫ দিনের ব্যবধানে প্রতি টনে কাগজের দাম বাড়ে ২৫-৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত। ফলে বাজারে কাগজ সংকট দেখা দেয় এবং বই ছাপার কাজ মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়। নতুন শিক্ষাবর্ষের ক্লাস শুরু হলেও দফায় দফায় সময় বাড়িয়েও সরকার শিক্ষার্থীদের হাতে বই তুলে দিতে ব্যর্থ হয়। সমালোচনার মুখে সরকার দ্রুত বই ছাপানোর জন্য শুল্ক ছাড়ের মাধ্যমে ১০ হাজার টন কাগজ ও আর্টকার্ড আমদানির সিদ্ধান্ত নেয়। অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমতি সাপেক্ষে কাগজ আমদানিতে ৫৩ শতাংশ শুল্কের ওপর ২৮ শতাংশ মওকুফ করা হয়। এই শুল্ক ছাড়ের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল বাজারে কাগজের সরবরাহ বাড়িয়ে প্রিন্টার্সদের (মুদ্রণ প্রতিষ্ঠান) কাছে কম দামে সরবরাহ করা। এরপর ‘ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে ৩৭টি প্রিন্টার্স প্রতিষ্ঠানের চুক্তি হয়।

অভিযোগ উঠেছে, এনসিপির বিতর্কিত নেতা তানভীর এবং এনসিটিবির তিন কর্মকর্তার মধ্যস্থতায় এই আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানকে কাগজ আমদানির জন্য নির্বাচিত করা হয়। প্রতিষ্ঠানটি ফেব্রুয়ারি ও মার্চ মাসে মোট ৯ হাজার ৩৫০ টন কাগজ ও আর্টকার্ড আমদানি করে, যার মধ্যে ৭ হাজার ৭৫০ মেট্রিক টন কাগজ এবং ১ হাজার ৬০০ মেট্রিক টন ছিল আর্টকার্ড। চুক্তিতে উল্লেখ করা হয়, প্রতি টন কাগজ ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা দরে বিক্রি করা হবে।

২৮ শতাংশ শুল্ক মওকুফের পর কাগজ আমদানিতে পরিবহন খরচসহ প্রতি টনের দাম পড়ে ৯৪ হাজার টাকা। অথচ প্রিন্টার্সদের কাছে সেই কাগজ বিক্রি করা হয় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায়। অর্থাৎ প্রতি টনে ৩৬ হাজার টাকা মুনাফা করেছে। সে হিসাবে, ৭ হাজার ৭৫০ টন কাগজেই শুধু মুনাফার পরিমাণ দাঁড়ায় প্রায় ২৮ কোটি টাকা। আর্টকার্ডের শুল্ক মওকুফের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। সেটি যোগ করলে কমিশন বাণিজ্যের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৩ কোটি টাকা।

প্রিন্টার্সদের অভিযোগ, সরকার শুল্ক মওকুফ করেছিল বাজারে কম দামে কাগজ সরবরাহের উদ্দেশ্যে। অথচ ফেব্রুয়ারির শেষে ও মার্চের শুরুতে আমদানি করা কাগজের চেয়েও কম দামে খোলা বাজারে কাগজ পাওয়া যাচ্ছিল। তারা প্রশ্ন তোলেন, তাহলে সরকার কেন শুল্ক মওকুফ করল? তাদের অভিযোগ, একটি চক্র এনসিটিবির যোগসাজশে বিশাল অঙ্কের টাকা মুনাফা করেছে।

আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানটির দাবি, তারা কাগজে ৪-৫ শতাংশ মুনাফা ধরে প্রতি টন ১ লাখ ১০ হাজার টাকা দাম নির্ধারণ করেছিল। এর মধ্যে কাগজের মূল্য ১ লাখ ৫ হাজার এবং পরিবহন খরচ ৫ হাজার টাকা ধরা হয়। বাকি ২০ হাজার টাকা শুল্ক।

তবে সরকারের দেওয়া ট্যাক্সের নথি বলছে ভিন্ন কথা। ‘ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস’ চীন থেকে কাগজ আমদানিতে প্রতি টন কাগজের ইনভয়েস মূল্য দেখিয়েছে (চুক্তি অনুযায়ী) ৬০০ ডলার বা ৭৩ হাজার ৯৩২ টাকা (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে)। ২৫ শতাংশ শুল্ক পরিশোধ করে ১৮ হাজার ৪৮৩ টাকা। পরিবহন খরচ সর্বোচ্চ ২ হাজার টাকা ধরলেও প্রতি টনের মোট খরচ দাঁড়ায় ৯৪ হাজার টাকার সামান্য বেশি।

রাজস্ব বোর্ডের নথি অনুযায়ী, কাগজ আমদানিতে সাধারণত ৫৩ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। সরকার সিডি ও আরডির ২৮ শতাংশ শুল্ক মওকুফ করে ভ্যাট, এআইটি ও এটি বাবদ ২৫ শতাংশ শুল্ক ধার্য করে। ‘ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস’ শুল্কের জন্য ২০ হাজার টাকা ধরলেও প্রকৃতপক্ষে ১৮ হাজার টাকা পরিশোধ করেছে। গত ২৪ মার্চ চট্টগ্রাম কাস্টমস থেকে খালাস হওয়া একটি চালানের নথিতে এর সত্যতা মিলেছে। একই সঙ্গে ৬০০ ডলার বা ৭৩ হাজার টাকার এলসি করে প্রতি টন কাগজের দাম কীভাবে ১ লাখ ৫ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলো, তারও সঠিক ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি।

বই ছাপার সঙ্গে যুক্ত একাধিক প্রিন্টার্স প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার কালবেলাকে অভিযোগ করে বলেন, এনসিটিবির তৎকালীন চেয়ারম্যান, সদস্য (পাঠ্যপুস্তক), সচিব এবং এনসিপির বহিষ্কৃত নেতা তানভীর তাদের মতামত না নিয়েই জোরপূর্বক সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেন। এ ক্ষেত্রে তারা ভুল বুঝিয়ে শিক্ষা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে ব্যবহার করেন।

অনুসন্ধানে জানা যায়, জানুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে ৮২ ব্রাইটনেস কাগজের দাম ছিল প্রতি টন ৯৫ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা এবং ৮৫ ব্রাইটনেসের দাম ছিল সর্বোচ্চ ১ লাখ ৫ হাজার টাকা। বই ছাপার কাজ শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কাগজের দাম অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে শুরু করে এবং জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে সেই কাগজের দাম বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৩০ হাজার টাকায়। এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে একটি চক্র বিদেশ থেকে কাগজ আমদানির সুযোগ তৈরি এবং তৎকালীন শিক্ষা উপদেষ্টাকে ভুল বুঝিয়ে অর্থ উপদেষ্টাকে শুল্ক কমানোর জন্য রাজি করান। শিক্ষা উপদেষ্টা শুল্ক কমানোর জন্য চিঠি দিলে সেই আবেদন মঞ্জুর হয়।

আরও জানা যায়, জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে এনসিটিবি চেয়ারম্যান সব প্রিন্টার্সদের ডেকে পাঠান। মিটিং রুমে প্রবেশ করেই প্রিন্টার্সরা এনসিপি নেতা তানভীরকে দেখে অপ্রস্তুত হয়ে পড়েন। ওই মিটিংয়ে সচিব শাহ মুহাম্মদ ফিরোজ আল ফেরদৌস, সদস্য (পাঠ্যপুস্তক) রিয়াদ চৌধুরীও উপস্থিত ছিলেন। বিতরণ ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রক তথ্য ও কারিগরি সহযোগিতা করেন। অভিযোগ রয়েছে, ওই সময় তানভীর প্রিন্টার্সদের উদ্দেশ করে বলেন, তারাই কাগজ আমদানির সিদ্ধান্ত নিয়েছেন এবং সবাইকে এই কাগজ কিনতে হবে। অন্যথায় তাদের বিল আটকে দেওয়া হবে। ব্যবসায়িক ক্ষতির ভয়ে সেই সময় কেউই প্রতিবাদ করার সাহস পাননি। এনসিটিবিতে এমন গুঞ্জনও রয়েছে, তানভীরের ক্লিয়ারেন্স ছাড়া পেপার মিল থেকেও কাগজ কেনা যেত না এবং দামও তিনিই নির্ধারণ করে দিতেন। একপর্যায়ে প্রিন্টার্সদের আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করতে ভয়ভীতি দেখিয়ে কাগজ কেনার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। যদিও ১১৭টি মুদ্রণ প্রতিষ্ঠানের মধ্যে মাত্র ৩৭টি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি হয়। কোন প্রিন্টার্স কত কাগজ কিনবে, সেই বিষয়ে কারসাজি করেন এনসিটিবির সচিব ও সদস্য রিয়াদ চৌধুরী। বড় প্রেসগুলোকে কম কাগজ দিয়ে মাঝারি ও ছোট প্রেসগুলোকে বেশি কাগজ কেনার জন্য চাপ দিয়ে চুক্তি করান তারা।

এনসিটিবি সূত্র বলছে, প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন চেয়ারম্যান, সচিব, এনসিপি নেতা তানভীর এবং এনসিটিবির সদস্য কাগজ আমদানির মূল পরিকল্পনাকারী ছিলেন। বিতরণ ও উৎপাদন নিয়ন্ত্রক কারিগরি সহযোগিতা করেন। চেয়ারম্যানের হয়ে বিভিন্ন প্রিন্টার্সের সঙ্গে যোগাযোগ করতেন আর্টিস্ট-কাম-ডিজাইনার সুজাউল আবেদীন। তার মাধ্যমেই কমিশনের টাকা লেনদেন হতো বলে অভিযোগ উঠেছে। তবে, সুজাউল আবেদীন কালবেলাকে বলেন, তিনি শুধু চেয়ারম্যানের সঙ্গে বিভিন্ন প্রেসে যেতেন এবং ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটসের আমদানি করা কাগজের খোঁজ নিতেন। এর বাইরে অন্য কোনো অভিযোগ সত্য নয়।

সদস্য রিয়াদ চৌধুরী কালবেলাকে বলেন, কাগজ আমদানির শুরুতে চেয়ারম্যান তাকে ডেকেছিলেন, পরে আর ডাকেননি এবং তিনিও এসবের খোঁজ নেননি। এর মাঝে কী হয়েছে, তা তার জানা নেই। যেহেতু কেনাকাটার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, তাই এসব অভিযোগ ভিত্তিহীন বলে দাবি তার।

প্রেস মালিকরা অভিযোগ করে বলেন, এনসিটিবির সঙ্গে বই ছাপানোর জন্য ডিসেম্বরে প্রিন্টার্সদের চুক্তি হয় এবং বাজারে কাগজের দাম বাড়ুক বা সংকট হোক, সেটি এনসিটিবির দেখার বিষয় নয়। তাদের কাজ ছিল সময়মতো বই বুঝে নেওয়া। তা না করে এনসিটিবির উদ্যোগে তৃতীয়পক্ষের মাধ্যমে শুল্ক ছাড়ের কাগজ আমদানি করাই সন্দেহজনক। নতুন করে শুল্ক ছাড় দেওয়ায় সরকার দুবার ক্ষতির শিকার হয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মুদ্রণ শিল্প সমিতির সাবেক সভাপতি তোফায়েল খান কালবেলাকে বলেন, এনসিটিবি এখানে কারসাজি করেছে। সরকারের শুল্ক মওকুফের সুবিধা ভোক্তা হিসেবে প্রিন্টার্সদের পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু তা চলে গেছে তৃতীয় কোনো পক্ষের কাছে। ওই সময় এনসিটিবির চেয়ারম্যান, সচিবসহ আরও কিছু কর্মকর্তা, একজন ছাত্র সমন্বয়ক জোর করে তাদের কাছ থেকে কাগজ কিনতে বাধ্য করে। এই কাগজ না কিনলে অন্যান্য বিল আটকে দেওয়ার হুমকি দেন এনসিটিবি চেয়ারম্যান এবং তানভীর। যেহেতু এই কাগজ তাদের কোনো কাজেই আসেনি, তাই সরকারের উচিত ওই প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে শুল্কের টাকা আদায় করা এবং তদন্ত করা।

ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটসের চেয়ারম্যান ও সিইও ফখরুল আলম ফারুক কালবেলাকে বলেন, ‘কাগজের দাম ও পরিবহন খরচসহ দাম ধরি ১ লাখ ১০ হাজার, সঙ্গে ২০ হাজার শুষ্ক। সে হিসেবে চুক্তি অনুযায়ী প্রতি টন কাগজ এক লাখ ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। বাজারে দাম কত ছিল, সেটি আমার বিবেচ্য বিষয় নয়।’ তার দাবি, ৪-৫ শতাংশ লাভ ধরেই কাগজ আমদানি করা হয়েছে। চুক্তি থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রিন্টার্স কাগজ নেয়নি, ফলে তাদের কম দামে বিক্রি করতে হচ্ছে এবং এতে তাদের বড় ধরনের ক্ষতি হয়েছে। কাগজ আমদানি না হলে কাগজের দাম দেড় লাখ টাকা ছাড়িয়ে যেত।

এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে এনসিটিবির সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজুল হাসানের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল এবং বার্তা পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। প্রতিষ্ঠানটির তৎকালীন সচিব ফিরোজ আল ফেরদৌস কোনো মন্তব্য না করে প্রাক্তন চেয়ারম্যান, সদস্য এবং কাগজ সংশ্লিষ্ট ঊর্ধ্বতন ভান্ডার কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করার পরামর্শ দেন।

এনসিপির বহিষ্কৃত নেতা সালাউদ্দিন তানভীর কালবেলাকে বলেন, তৎকালীন পরিস্থিতি ও বাস্তবতার নিরিখে কাগজ আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং তিনি এনসিটিবিকে সহযোগিতা করেছেন। তার দাবি, ইউনিয়ন অ্যাসোসিয়েটস যেভাবে বুঝিয়েছিল, সেভাবে শিক্ষা উপদেষ্টাকে বুঝিয়ে শুল্ক মওকুফের কথা বলা হয়েছিল। তবে তারা এখানে কী করেছে, তা তাদের জানা নেই। কাগজ কেনাকাটায় কমিশন বাণিজ্যের অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘সরকারকে সহযোগিতা করা কোনো দোষের কিছু নয়।’