
ভারতের দেওয়া ফারাক্কা বাঁধ যেন বাংলাদেশের নদীগুলো হত্যার এক মেশিন। মরণবাঁধ দেওয়ার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশের ৫০টির বেশি নদী কার্যত মরে গেছে। কোনো কোনোটি নদী থেকে খাল বা নালায় পরিণত হয়েছে। নাব্য হারিয়ে, লবণাক্ততা বেড়ে দেশের আরও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নদী এ বাঁধের কারণে অস্তিত্বের সংকটে আছে। নদীনির্ভর সংস্কৃতি বিলুপ্ত হওয়ার পাশাপাশি নষ্ট হয়েছে মানুষের জীবিকা আর দেশের জীববৈচিত্র্য। যেখানে আগে খরস্রোতা নদী ছিল সেখানে এখন ধুধু প্রান্তর। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নদীর এ অকালমৃত্যুর কারণে ভূ-প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে আছে দেশের মানুষ। অস্তিত্ব সংকটে পড়েছে পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন।
আগামীকাল ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ১৯৭৬ সালের এই দিনে ফারাক্কা ব্যারাজ অভিমুখে লংমার্চ করে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাড়া ফেলে দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। নদীর পানির ন্যায্য হিস্যার দাবিতে এমন সোচ্চার জনমত ফারাক্কা লংমার্চের আগেও দেখা যায়নি, পরেও নয়। ৯৫ বছরের শারীরিক অসুস্থতা বা রাজনৈতিক চাপ দমাতে পারেনি লংমার্চের প্রধান নেতা ও সংগঠক মওলানা ভাসানীকে।
ফারাক্কার কারণে বাংলাদেশের নদীগুলোর এ করুণ পরিণতির বিষয়ে পানিসম্পদ ও জলবায়ু পরিবর্তন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক আইনুন নিশাত যুগান্তরকে বলেন, আমরা আরিচা পর্যন্ত গঙ্গা বলি। যমুনা বলি না ব্রহ্মপুত্র বলি। গঙ্গা আর ব্রহ্মপুত্র মিলে হলো পদ্মা। মাওয়ায় এসে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের প্রবাহ একসঙ্গে যোগ হয়েছে। গঙ্গার যেটি ভারত থেকে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে, আমরা বলি গঙ্গা নদী, একটি ব-দ্বীপ সৃষ্টি করেছে। গঙ্গা এ ব-দ্বীপের মতোই। ব-এর একটি মাথা ভাগীরথী নদী। আরেকটি মাথা গঙ্গা এসে পদ্মা-মেঘনা হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। মাঝখানে যে ট্রাইঅ্যাঙ্গুলার এলাকা হলো হুগলি, ভাগীরথী আরিচা পর্যন্ত এসে গঙ্গা ও ব্রহ্মপুত্রের সঙ্গে মিলিত হলো। তারপর মেঘনার সঙ্গে মিলিত হলো। একটি ব-দ্বীপ হলো। ব-দ্বীপ গঙ্গার ওপর যেটি নির্ভরশীল মানে ভাগীরথী তার প্রথম শাখা নদী, তারপর জলাঙ্গী। এটি ভারতের মধ্যে দুই ভাগ হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। এক ভাগে কপোতাক্ষ, আরেক ভাগে মাথাভাঙ্গা। তারপর হলো গড়াই, মধুমতি, বলেশ্বর ইত্যাদি। তারপর চন্দনা বাড়াশিয়া। চন্দনা, বাড়াশিয়া থেকে কুমার। এরপর আড়িয়াল খাঁ। তিনি বলেন, আগে বর্ষাকালে যে পরিমাণ পানি আসত এখন তা কিছুটা কমে গেছে। কারণ বর্ষার প্রথমদিকে এখন ভারত পানি ধরে রাখে। কিন্তু বন্যার সময় সব পানি ছেড়ে দেয়। তখন শাখা নদীর পানি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়। আর গঙ্গা নদীর বাঁ তীরে শাখা নদী বড়াল, ইছামতি। এরা পদ্মা থেকে পানি নিয়ে যমুনায় ফেলে। ১৯৭৫-এ ফারাক্ক বাঁধের আগে পানির পরিমাণ ছিল ১ লাখ ২০ হাজার থেকে দেড় লাখ কিউবিক পার সেকেন্ডে। এতে নদীর দুই পাড়েই পানি পৌঁছত। কিন্তু যখন ভারত পানি প্রত্যাহার শুরু করল তখন আমাদের শাখা নদীতে আর পানি ঢোকে না। না ঢোকার কারণে সে নদীগুলো ক্রমান্বয়ে মরে গেছে। শাখা নদীগুলো আমাদের দেশে জালের মতো বিস্তৃত ছিল। প্রতিটি নদী ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল মাসে কোনো পানি পায় না। মেরে ফেলা হয়েছে। নদী মরে গেছে মানে-নৌ চলাচল মরে গেছে, মাছ মরে গেছে। এখানে অনেক বিল ছিল। বিলের পানি নদীতে ঢুকেছে। যশোর, খুলনা, বাগেরহাটে সেগুলো শুকিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, আমাদের ক্ষতি হয়েছে আর ভারতের লাভ হচ্ছে। আমাদের পানি তারা ভাগীরথীতে দিচ্ছে। এতে হুগলি, ভাগীরথীর উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা কমে গেছে। তাদের সুন্দরবনের গুণগত মান ভালো হয়েছে। আমাদের সুন্দরবনের গুণগত মান খারাপ হয়েছে।
ফারাক্কা বাঁধের কারণে বাংলাদেশের পদ্মা নদী সবচয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত। ফারাক্কা বাঁধ এ নদীটির গতিপথ থেকে শুরু করে এর শাখা নদ-নদী সব জায়গায় ভয়াবহ প্রভাব ফেলেছে। রাজশাহী ব্যুরো জানায়, চাঁপাইনবাবগঞ্জে পদ্মার তীরবর্তী পাকা ইউনিয়নের বোগলাউড়ি, জগন্নাথপুর, মনোহরপুর, উজিরপুর, নারায়ণপুর, সুন্দরপুর ও চর বাগডাঙ্গা এলাকা ঘুরে দেখা যায়, পদ্মার বুকে এখন শুধু ধুধু বালুচর। একটি সরু চ্যানেলে পদ্মার পানিপ্রবাহ কোনোমতে সচল আছে। বছর বছর পদ্মার পানিপ্রবাহ ক্ষীণ হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার ছয়টি নদ-নদীও পানিশূন্য হয়ে মৃতপ্রায় খালে পরিণত হয়েছে। শিবগঞ্জ উপজেলার মনাকষা, বিনোদপুর ও দুর্লভপুর ইউনিয়নের ওপর দিয়ে প্রবাহিত চকের নদী উজানে ভারতের মালদহ জেলার হরিশচন্দ্রপুর পয়েন্টে গঙ্গার শাখা নদী হিসাবে উৎপত্তি হয়ে বিনোদপুর পয়েন্টে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। প্রায় ৫০০ মিটার প্রশস্ত এককালের খরস্রোতা চকের নদীটি ৩০ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে শিবগঞ্জের বোগলাউড়িতে গিয়ে পদ্মায় পড়েছে। তবে নিষ্কাশন মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বর্ষাকালেও চকের নদী বদ্ধ খাল হয়ে থাকে।
পদ্মার অনেক শাখা নদীও ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে শুকিয়ে গেছে। পানির প্রবাহ না থাকায় শাখা নদীর মধ্যে বড়াল ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। নদীর মাঝখানটা এখন সুরু নালার মতো। জেগেছে বিশাল চর। পানি সংকটে পদ্মার অন্যতম শাখা নদী কুষ্টিয়ার গড়াইও হুমকিতে আছে। কুমার, মাথাভাঙ্গা, ভৈরব, কপোতাক্ষ এ নদীগুলো পানিপ্রবাহ সুন্দরবনে নিয়ে যায়। কার্যত এ নদীগুলোও মরে গেছে। কোথাও কোথাও খুব সামান্য পানি দেখা যায়। নদীতীরবর্তী তেলকুপি গ্রামের শফিকুল ইসলাম বলেন, স্বাধীনতার পরও চকের নদী দিয়ে বড় বড় মালবাহী নৌকা চলাচল করত। নৌকায় করে আশপাশের ২০ গ্রামের মানুষ মনাকষার হাটে এসে ধান, পাটসহ বিভিন্ন কৃষিপণ্য বিক্রি করত। এ নদীটির অস্তিত্ব এখন পুরোপুরি বিপন্ন। এখন নদীর বুকজুড়ে চাষ হচ্ছে ধান। শফিকুল ইসলাম আরও বলেন, কয়েক বছর পর আগামী প্রজন্ম জানবেই না এখানে একটি খরস্রোতা নদী ছিল। ফারাক্কার প্রভাবে চকের নদীটিকে বলা যেতে পারে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত নদীগুলোর একটি।
রাজশাহী ব্যুরো আরও জানায়, ফারাক্কার প্রভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের ওপর দিয়ে প্রবাহিত প্রাচীন নদীগুলোর একটি পাগলা নদী। প্রায় ৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ নদীটি পাঁচ যুগ আগেও একটি গভীর নদী ছিল। গঙ্গার শাখা নদী শিবগঞ্জের শাহবাজপুর দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে কানসাট শিবগঞ্জ বাজার হয়ে ৪১ কিলোমিটার পথ পেরিয়ে কালীনগরের কাছে মহানন্দা নদীতে পড়েছে। এককালের তীব্র খরস্রোতা পাগলা নদী এখন একটি সরু নালায় পরিণত হয়েছে। নৌচলাচল প্রায় বন্ধ।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের আরেক বড় নদী মহানন্দার অবস্থাও মরেমরে। বছরের চার মাস পানি থাকলেও বাকি সময় নদীর দুকূলজুড়ে চাষ হয় ধানসহ বিভিন্ন ফসল।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের অতিরিক্ত প্রধান প্রকৌশলী মোখলেসুর রহমান জানান, মহানন্দা জেলার একটি গুরুত্বপূর্ণ নদী। এ নদীর দুই তীরে গড়ে উঠেছে শহর-বন্দর। মহানন্দার দুই কূলে রয়েছে বেশকিছু সেচপ্রকল্প। জমিতে সেচ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাপক অবদান রাখছিল মহানন্দা। নদী এলাকায় ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপক প্রসার ঘটে। কিন্তু গত কয়েক বছরে নদীটির প্রবাহ কমে গেছে।
ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মায় পানিপ্রবাহ অস্বাভাবিক মাত্রায় কমে যাওয়ায় ব্যাপক বিপন্নতার শিকার হয়েছে রাজশাহীর বড়াল নদী। ফারাক্কার প্রভাবে পদ্মার শাখা নদী রাজশাহীর মুসাখান, নাটোরের নারদ এবং ১১টি নদীর পানিপ্রবাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে বলে রাজশাহী পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্ট শাখার প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে। গত অর্ধশত বছরে রাজশাহীর হারিয়ে যাওয়া পদ্মার শাখা নদীগুলো হলো-নারদ, সন্ধ্যা, স্বরমংলা, নবগঙ্গা, দয়া, হোজা, বারাহী, চিনারকুপ ও মুসাখান।
পাউবোর সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ফারাক্কা বাঁধের কারণে উত্তর-পশ্চিম ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ছোট-বড় প্রায় ৫৩টি নদ-নদীর পানিপ্রবাহ বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
মূলত ফারাক্কা বাঁধের মাধ্যমে গঙ্গা নদীর পানি হুগলি নদীতে স্থানান্তরিত করা হয়। যার ফলে পদ্মা নদীতে পানিপ্রবাহ কমে যায়। শুষ্ক মৌসুমে যখন নদীর পানি স্বাভাবিকভাবেই কম থাকে, বাঁধের কারণে পদ্মা নদীর পানি আরও কমে যায়। যার নেতিবাচক প্রভাব গত ৫০ বছর ধরে পড়ছে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে কৃষি, মৎস্য ও জলজসম্পদের ওপর।