
বাংলায় একটি প্রবাদ আছে ‘গাধাকে মুলা দেখানো’। সুকুমার রায় এ নিয়ে চমৎকার ছড়া লিখেছেন ‘অসম্ভন নয়’ শিরোনামের ছড়া হলো, ‘গাধার পিঠে বস্ল চেপে/মুলোর ঝুটি ঝুলিয়ে নাকে/মুলোর গন্ধে টগবগিয়ে/দৌড়ে চলে লম্ফ দিয়ে/যতই ছোটে ধরবো বলে/ততই মুলো এগিয়ে চলে/খাবার লোভে উদাস প্রাণে/কেবল ছোটে মুলোর টানে’। গাধার সামনে মুলো ঝোলানোর মতোই বাংলাদেশের জনগণের সামনে ‘ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন’ মুলা ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন চলতে শুরু করেছে। স্বল্প সংস্কার হলে ডিসেম্বর, বৃহৎ সংস্কার হলে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন হবে’। এখন মে মাস চলছে। ডিসেম্বরে নির্বাচন হলে সামনে মাত্র ৭ মাস সময়। অথচ নির্বাচনের দিনক্ষণের চূড়ান্ত ঘোষণা নেই। প্রশ্ন হচ্ছে ‘নির্বাচন মুলা’ কি দেশবাসীর সামনে ঝুলেই থাকবে?
প্রায় দেড় যুগ থেকে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারছে না। ভারতের নীল নকশায় ২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৪ তিনটি জাতীয় নির্বাচনের নামে নাটক হয়েছে। ভোটাররা ভোট দিতে পারেনি। ১৮ বছর বয়সে ভোটারের তালিকায় নাম উঠলেও দেশে যাদের বয়স ৩৫ বছর তারা এখনো ভোট দিতে পারেনি। জনগণের ভোটের অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ছাত্র-জনতা ফ্যাসিস্ট হাসিনাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে। ঢাকার রাজপথ রক্তে রঞ্জিত করে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতে পালিয়ে গেছেন। অতপর অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করা হয়েছে। জনগণ ভোটের অধিকার চাচ্ছে, রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচন দাবি করছে। ’৯১ সালে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের অন্তর্বর্তী সরকার, ’৯৬ সালে বিচারপতি হাবিবুর রহমান খানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার, ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশাসনের রুটিন ওয়ার্ক করেও ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন উপহার দিয়েছে। তিনটি নির্বাচনই দেশ ও জাতির কাছে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য ছিল। অথচ ৮ আগস্ট অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে সংস্কারের অজুহাতে নির্বাচন নিয়ে চলছে তালবাহানা। অন্তর্বর্তী সরকার ‘স্বল্প সংস্কারে ডিসেম্বর বেশি সংস্কার করতে চাইলে আগামী বছরের মাঝামাঝি নির্বাচন হবে’ প্রতিশ্রুতি দিয়ে মানুষের সামনে ‘নির্বাচনী কলা’ ঝুলিয়ে রেখেছে। অনেকটা বাংলাদেশের সামনে ভারতের ‘তিস্তা চুক্তি’ কলা ঝুলিয়ে রাখার মতোই। দিন যায়, মাস যায়, বছর যায় তিস্তা চুক্তি আর হয় না।
দেশের ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা বলছেন, দেশের অর্থনীতির বেহাল দশা। বিদেশি বিনিয়োগ না আসায় জোড়াতালি দিয়ে চালানো হচ্ছে। অনিশ্চয়তার কারণে নতুন বিনিয়োগ আসছে না; দেশি বিনিয়োগও বাড়ছে না।
এপ্রিলের আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ সম্মেলন-২০২৫ এ বিদেশিরা বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিলেও তারা বিনিয়োগের আগে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার নিশ্চয়তা চায়। অন্তর্বর্তী সরকারের মেয়াদকাল অনিশ্চিত; নির্বাচিত সরকার ক্ষমতায় এলে বিনিয়োগ করবে বলে বার্তা দেয়। অথচ নির্বাচন কখন হবে তা কেউ জানেন না। উল্টো সংস্কারের নামে উপদেষ্টাদের কেউ কেউ দীর্ঘমেয়াদি ক্ষমতায় থাকার অপচেষ্টা করছেন। আবার রাখাইনে ‘মানবিক করিডোর’ দেয়ার ইস্যু সৃষ্টি করে নতুন করে জাতীয় সংকটের সৃষ্টি করছেন। ডিজিটালের এই যুগে সোশ্যাল মিডিয়া অনেক শক্তিশালী হয়ে উঠেছে। ‘মানবিক করিডোর’ ইস্যুতে ডিজিটাল এ মিডিয়ায় নেটিজেনদের অনেকেই বলতে শুরু করেছেন, আওয়ামী লীগ ও অন্তর্বর্তী সরকারের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে ফ্যাসিস্ট হাসিনা ভারতের প্রেসক্রিপশনে চলতো; আর বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রেসক্রিপশনে চলছে। যার কারণে দেশবাসীকে অন্ধকারে রেখে দেশের সার্বভৌমত্বকে হুমকির মুখে ফেলে মানবিক করিডোর দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এমন স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল।
গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে বলেছেন, ‘নির্বাচনের ট্রেন যাত্রা শুরু করেছে। ভোট না হওয়া পর্যন্ত এ ট্রেন থামবে না’। অতপর দেশি-বিদেশি গণমাধ্যম দেয়া সাক্ষাতকার ও জাতিসংঘ থেকে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রতিনিধি যারাই ঢাকা সফরে এসেছেন তাদের সামনে ডিসেম্বর থেকে আগামী বছরের জুনের মধ্যে নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলো যখনই চাইবে তখনই নির্বাচন হবে। স্বল্প সংস্কারে ডিসেম্বর ও বৃহৎ সংস্কারে আগামী বছরের মাঝামাঝি সময়ে নির্বাচন হবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসিরউদ্দিন দেশবাসীকে জানিয়েছেন, নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে। জুন মাসে নির্বাচনের কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করা হবে। সরকার যখনই চাইবে তখনই নির্বাচনের আয়োজন করা হবে। কিন্তু সে নির্বাচনী ট্রেন থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে কয়েকজন উপদেষ্টা, সংস্কার কমিশনের দায়িত্বশীল ব্যক্তি ও ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেয়া ছাত্র সমন্বয়কদের নেতৃত্বে জন্ম নেয়া নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)। তাদের সঙ্গে সুর মিলিয়েছে জামায়াত ও একাধিক ইসলামী ধারার দল। তারা সংস্কারের পর নির্বাচনের পাশাপাশি অন্যের শিখিয়ে দেয়া বুলি তোতাপাখির মতোই ‘স্থানীয় নির্বাচনের পর জাতীয় নির্বাচন’ দাবি করছেন। দেশের রাজনীতিতে নতুন বন্দোবস্তের ঘোষণা দিয়ে নতুন দল গঠন করলেও এনসিপি এখন পর্যন্ত জাতির সামনে নতুনত্ব কিছু হাজির করতে পারেনি। বরং দলটির কারো কারো বিরুদ্ধে চাঁদাবাজী, টেন্ডারবাজী, নিয়োগ-বদলি বাণিজ্যের অভিযোগ রয়েছে। সংস্কারের নামে দলটির নেতারা নিজেদের দল গোছানোর লক্ষ্যে বেশি সময় পেতেই সংস্কারের পর নির্বাচন দাবি করছে। অন্যদিকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন ‘সংস্কার ইস্যু’তে কচ্ছপ গতিতে কেতাবি ঢংয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপ চালিয়ে যাচ্ছে। ভাবখানা ‘সময় চলে যাক, চলে যাক’। কিন্তু দীর্ঘ ১৭ বছর রাজপথে আন্দোলন করা রাজনৈতিক দলগুলো ওই কচ্ছপ গতির সংস্কারের নামে সময়ক্ষেপণ চায় না। দেশের প্রায় অর্ধশতাধিক রাজনৈতিক দল চায় আগামী ডিসেম্বর থেকে মধ্য ফেব্রুয়ারি রোজার আগে জাতীয় নির্বাচন।
দিল্লির পুতুল হাসিনা পালানোর পর ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের পর থেকে সাধারণ ভোটাররা ভোট দেয়ার জন্য মুখিয়ে রয়েছে। নির্বাচনের দেখা নেই। নির্বাচনের আকাশে এখনো কালোমেঘের ঘনঘটা। অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তুতির লক্ষ্যে নির্বাচনের টাইমফ্রেম খুবই অপরিহার্য। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার কারণে বিদেশি বিনিয়োগ আসছে না। দেশের অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে হলে একদিকে বিদেশি বিনিয়োগ অন্যদিকে কর্মসংস্থান করতে হবে। কিন্তু বিদেশি বিনিয়োগ অস্বাভাবিকভাবে কমে গেছে। গত বছরের ৫ আগস্ট হাসিনা পালানোর পর প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রতিযোগিতায় নামেন। বিপুল পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে। ওই রেমিট্যান্স এখন অন্তর্বর্তী সরকারের অর্থনীতির প্রধান চালিকাশক্তি। ব্যাংকগুলোর এখনো বেহাল দশা। রুগ্নতা দূরীকরণে কয়েকটি ব্যাংক একত্রিত করার উদ্যোগ নেয়া হলেও সরকার বেশিদূর এগোতে পারেনি। টাকা ছাপিয়ে পুঁজি দিয়ে বেসরকারি ব্যাংকগুলোকে সচল রাখা হচ্ছে। শুধু তাই নয় কঠিন শর্ত মেনে আইএমএফ থেকে ঋণের কিস্তি না নেয়ার প্রচারণা চালানো হলেও বাধ্য হয়েই কঠিন শর্তে সে কিস্তি নেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। বিদেশি বিনিয়োগ বাড়াতে এপ্রিল মাসে ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫’ শীর্ষক বিনিয়োগ সম্মেলন করা হয়। ঢাকঢোল পিটিয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) আয়োজিত এ সম্মেলন ৫০ দেশের বিনিয়োগকারী বিনিয়োগের আগ্রহ প্রকাশ করেন। বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরী দাবি করেন ৫০ দেশের ৪১৫ প্রতিনিধি সম্মেলনে ৩ হাজার ১০০ কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে বিনিয়োগ করার প্রস্তাব আর বিনিয়োগ আসা কি এক জিনিস? ‘বাংলাদেশ ইনভেস্টমেন্ট সামিট-২০২৫’ অনুষ্ঠানের পর থেকে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করার চেয়ে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান আশিক চৌধুরীকে হিরো বানানোর প্রতিযোগিতা শুরু হয়। প্রচারণা এমনভাবে করা হচ্ছে যে বিডার নির্বাহী চেয়ারম্যান দেশকে বিদেশি বিনিয়োগে ভাসিয়ে দিয়েছেন। বাস্তবতা উল্টো এবং খুরিয়ে খুরিয়ে চলছে অর্থনীতি। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতির বিশ্লেষকরা বলছেন, বিদেশি বিনিয়োগ অনেক বিষয়ের ওপর নির্ভর করে। বর্তমানে দেশে এক ধরনের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা চলছে। এ সরকার কতদিন থাকবে, আগামী নির্বাচন কবে হবে, একটা নির্বাচিত সরকার কবে আসবে। এখন যে সংস্কার কর্মসূচিগুলো নেয়া হচ্ছে, পরবর্তী সরকার সেগুলো রক্ষা করবে কিনা। এই অনিশ্চিতার কারণে বিনিয়োগকারীরা আস্থা পাচ্ছেন না। দেশী বিনিয়োগকারীর চেয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা থাকে বিদেশীদের। তারা অনিশ্চয়তার মুখে কোনো বিনিয়োগ করতে রাজী হন না।
এদিকে নির্বাচন ইস্যুতে মেরুকরণ শুরু হয়েছে কয়েক মাস আগেই। নতুন মেরুকরণের প্রধান উপাদান বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটির উদ্যোগে নতুন একটি রাজনৈতিক দল এনসিপির আত্মপ্রকাশ। তাদের সঙ্গে জামায়াত কখনো সুর মেলাচ্ছে কখনো বিরোধে জড়িয়ে পড়ছে। বিএনপি আগে থেকেই বলছে বিএনপি ক্ষমতায় গেলে ৩১ দফা রাষ্ট্র সংস্কার করবে। তবে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সর্বশেষ বৈঠকের পর বিএনপি নির্বাচন নিয়ে কিছুটা উদ্বিগ্ন। এর মধ্যে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম নিষিদ্ধের পর জাতীয় পার্টি ও ১৪ দলীয় জোটভুক্ত দলগুলো নিষিদ্ধের দাবি উঠেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে যতই দাবি উঠবে ততই নির্বাচন নিয়ে সংশয় বাড়বে। এর মধ্যে সংস্কারের নামে নির্বাচন বিলম্বের লক্ষে নানান ফন্দিফিকির করা হচ্ছে। উপদেষ্টাদের কেউ কেউ ৫ বছর ক্ষমতায় থাকার মানসে সোশ্যাল মিডিয়ায় জনমত গঠনের চেষ্টা করছেন। এমনিতেই ভারত দীর্ঘদিন থেকে বাংলাদেশকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছে। ভারতে পলাতক নিষিদ্ধ আওয়ামী লীগের নেত্রী ফ্যাসিস্ট হাসিনা বাংলাদেশে অঘটন ঘটানোর চেষ্টায় মরিয়া। এর মধ্যে নতুন করে বিরোধের সৃষ্টি আরাকান আর্মিকে মানবিক করিডোর দেয়ার ইস্যু। এতে মিয়ানমারও বাংলাদেশের উপর বিক্ষুব্ধ। যুদ্ধবিধ্বস্ত মিয়ানমারের রাখাইনে সহায়তা পৌঁছাতে এই করিডোর প্রস্তাব মেনে নেয়া সার্বভৌমত্বের নতুন সংকটের সৃষ্টি করতে পারে এমন আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা। রাজনৈতিক দল ও জনগণের সামনে ‘নির্বাচনের মুলা’ ঝুলানো থাকলেও কেউ জানে না নির্বাচন কবে হবে।