
মঙ্গলবার (১৩ মে) রাত ১১টার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের নবীনবরণ শেষে মোটরসাইকেলযোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে কাবাব খেতে যান শাহরিয়ার আলম সাম্য ও তার দুই বন্ধু। পরে মোটরসাইকেলে করে ক্যাম্পাসে ফিরছিলেন তারা। পথে মুক্ত মঞ্চ এলাকায় অন্য একটি মোটরসাইকেলের সঙ্গে তাদের মোটরসাইকেলের ধাক্কা লাগে। ওই মোটরসাইকেলের দু-তিন আরোহী ও তাদের সঙ্গে থাকা আরও দু-তিনটি মোটরসাইকেলের আরোহীসহ মোট ১০-১২ জনের সঙ্গে সাম্যদের তর্কাতর্কি হয়। একপর্যায়ে ওই ব্যক্তিরা তাদের মারতে শুরু করেন। তারাও আত্মরক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেন। এর মধ্যেই সাম্যকে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে আহত অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসাপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে সাম্যকে মৃত ঘোষণা করা হয়।
সাম্য ঢাবির শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের ২০১৮-১৯ সেশনের শিক্ষার্থী। ঘটনার সময় তার সঙ্গে থাকা সহপাঠী আশরাফুল আলম রাফি অণুজীববিজ্ঞান বিভাগের এবং মো. আব্দুল্লাহ আল বায়েজিদ শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের একই সেশনের।
এ ঘটনায় বুধবার (১৪ মে) সকালে সাম্যের ভাই শরীফুল আলম বাদী হয়ে শাহবাগ থানায় একটি মামলা করেন। পরে বেলা ১১টার দিকে রাজধানীর রাজাবাজারসহ কয়েকটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে তিনজনকে গ্রেপ্তারের কথা জানায় ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশনস বিভাগ। গ্রেপ্তার হওয়া তিনজন হলেন মো. তামিম হাওলাদার (৩০), সম্রাট মল্লিক (২৮) ও মো. পলাশ সরদার (৩০)।
মামলার এজাহার অনুযায়ী, সাম্য তার বন্ধু আশরাফুল আলম রাফি ও মো. আব্দুল্লাহ আল বায়েজিদকে নিয়ে মোটরসাইকেল যোগে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফেরার পথিমধ্যে রমনা কালী মন্দিরের উত্তর পাশে বটগাছের নিকটে পুরাতন ফোয়ারার কাছে পৌঁছালে অজ্ঞাতনামা ১০-১২ জন ব্যক্তি তাদের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল দিয়ে সাম্যের ব্যবহৃত মোটরসাইকেল ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। তখন আমার সাম্য ও তার দুই বন্ধু তাদের কাছে মোটরসাইকেল ধাক্কা দেওয়ার কারণ জিজ্ঞাসা করলে তারা সাম্য ও তার বন্ধুদেরকে আঘাত করে এবং কিল, ঘুসি ও লাথি মারতে থাকে। এসময় তাদের মধ্যকার একজন ধারালো অস্ত্র দিয়ে সাম্যের ডান পায়ের ডান রানের পিছনে উপর্যপুরী আঘাত করে গুরুতর কাটা রক্তাক্ত জখম করে। পরে সাম্যকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে হাসপাতালের কর্তব্যরত ডাক্তার মৃত ঘোষণা করে।
নিহত সাম্য স্যার এ এফ রহমান হল শাখা ছাত্রদলের সাহিত্য ও প্রকাশনা বিষয়ক সম্পাদক। এ হত্যাকান্ডে জড়িতদের বিচার ও ঢাবি ভিসি-প্রক্টরের পদত্যাগ চেয়ে বুধবার সারাদিন উত্তাল ছিল ক্যাম্পাস। ছাত্রদলসহ বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন নানা কর্মসূচি পালন করেন।
ঢাবি প্রক্টর সাইফুদ্দিন আহমেদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, এ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত ঘটনা জানা চেষ্টা করছি। ঘটনাস্থলের আশপাশে শাহবাগ থানা ও বাংলা একাডেমির সিসিটিভি রয়েছে। সেখানকার ফুটেজ সংগ্রহ করার চেষ্টা চলছে। এ ছাড়া ঘটনা তদন্তে ৭ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটিও করা হয়েছে।
এদিকে, ঘটনার বর্ণনা দিয়ে সাম্যের বন্ধু মো. আব্দুল্লাহ আল বায়েজিদ দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, ‘মঙ্গলবার আমাদের ডিপার্টমেন্টের নবীনবরণ অনুষ্ঠান ছিল। অনুষ্ঠান শেষ হতে হতে একটু দেরি হয়ে যায়। পরে আমি, সাম্য ও রাফি উদ্যানে আমাদের এক বন্ধুর কাবাবের দোকানে খেতে যাই। দোকান বন্ধ থাকায় আমরা তখন খাইতে পারিনি। যার কারণে আমরা বের হয়ে চলে আসছিলাম। আসার সময় আমাদের বাইকের সাথে ওই গ্রুপের একটা বাইকের সাথে ধাক্কা লাগলে তারা ক্ষেপে যায়। তারা সংখ্যায় বেশি এবং অনেক বেশি উগ্র হওয়ায় আমাদের উপর এলোপাথাড়ি আক্রমণ শুরু করে। এর মাঝে সাম্যকে ওদের কেউ একজন হঠাৎ একটা স্টেপ (ছুরি আঘাত) মেরে দেয়। তখন সাম্যের অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে মেডিকেলে নিয়ে যাওয়া হয়।’
বুধবার আশরাফুল আলম রাফিকে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসের পক্ষ থেকে মুঠোফোনে কল দেওয়া হলে ফোন ধরেন তার বন্ধু লাবীব। এসময় লাবীব বলেন, ‘রাফি এখানে নেই। আর সে এই মুহূর্তে কথা বলার অবস্থায় নেই। যা বলার আমাকে বলেন।’ এরপর ঘটনা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে লাবীব বলেন, ‘সাম্য দাঁড়িয়ে থাকা অবস্থায় বহিরাগত ওই গ্রুপটার একটা বাইকের ধাক্কা সাম্যের সঙ্গে লাগে এবং বাইকটা পড়ে যায় (তাদের সাথে মূলত ৩টি বাইক ছিল)। পরে সাম্যের সঙ্গে তাদের কথা কাটাকাটি হয়। এসময় রাফি একটু অন্যপাশে ছিল। দুই মিনিটের মধ্যে সাম্যকে আঘাত করার ঘটনা ঘটে যায়। পরে রাফি ঘটনাস্থলে আসলে সাম্য মাটিতে পড়ে যায়। তখন ও বুঝে উঠতে পারেনি যে, আসলে কি হয়েছে। পরে যখন দেখে সাম্যের শরীর থেকে ব্লিডিং হচ্ছে, তখন বুঝতে পারে যে, সিরিয়াস ঘটনা। এরপর তাকে মেডিকেলে নেওয়া হয়।
তবে এর আগে আশরাফুল আলম রাফি নিজে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘আমরা তিনজন (সাম্য, রাফি ও বায়েজিদ) মোটরসাইকেলে করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে ক্যাম্পাসে ফিরছিলাম। এসময় আমাদের মোটরসাইকেলের সঙ্গে আরেকটি মোটরসাইকেলের ছোটখাটো একটা ক্ল্যাশ (সংঘর্ষ) হয়। ওই মোটরসাইকেলের চালক ও যাত্রীর সঙ্গে আরও তিন-চারটার মতো মোটরসাইকেলে মোট ১০-১২ জন ছিলেন। মোটরসাইকেলে ধাক্কা লাগার পর তাদের সঙ্গে আমাদের কথা-কাটাকাটি হয়। কথা-কাটাকাটির একপর্যায়ে তাদের তিনজনের ওপর ওই ব্যক্তিরা আক্রমণ করেন বলে জানান আশরাফুল আলম।’
তিনি আরও বলেন, ‘আমরা আত্মরক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি। কিন্তু এর মধ্যে সাম্যকে ছুরিকাঘাত করা হয়। সাম্যর শরীর থেকে প্রচুর রক্ত ঝরে। বলা যায়, ঘটনাস্থলেই সাম্য মারা যায়। অর্থাৎ স্পট ডেথ।
লাবীবের সঙ্গে রাফি ও বায়েজিদের বক্তব্যে কিছুটা অমিল
তবে দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে দেওয়া রাফির বন্ধু লাবীবের বক্তব্যের সঙ্গে রাফি ও বায়েজিদের বক্তব্যে কিছুটা অমিল রয়েছে। রাফি ও বায়েজিদের বর্ণনায় ঘটনার সময় নিহত সাম্য, রাফি ও বায়েজিদ একসাথে থাকার তথ্য আসলেও লাবীব বলেছেন রাফি ঘটনার সময় একটু দূরে ছিলেন।
বুধবার দুপুরে ঘটনাস্থলের আশপাশে গিয়ে জানা গেছে, সোহারওয়ার্দী উদ্যানে নিয়মিত যেতেন নিহত সাম্য। সেখানকার দোকানীদের সঙ্গে তার ছোট ভাই-বড়ভাই সর্ম্পক। আল আমিন নামে এক চা দোকানি দ্য ডেইলি ক্যাম্পাসকে বলেন, আমার ভাইডারে তারা মেরে ফেলল। ও আমার এ ক্লোজ, ও যদি আমাকে এক ঘণ্টা না দেখে তাহলে আমারে ফোন দিয়ে বলে তুই কইরে। পহেলা বৈশাখের আগের দিন আমার সাথে ছাত্রদলের এক নেতার কথা কাটাকাটি হয়। ও আমার ছোটো ভাই না। ওর লগে তুই কেন কথা কস। তুই ওরে কেন ঝাড়ি দিলি। অথচ ওর লগের কিন্তু ক্যাম্পাসের পোলাপাইন।
‘‘তখন আমি বললাম ওতো আমাকে ছোট ভাই হিসেবে অনেক মানে। পহেলা বৈশাখের দিন আমারে সেই জড়ায়ে ধরছে। কালকে রাতে সাড়ে ১০টা বাজে বলছে ভাই, তোর কাছে আইতেছি। পরে আমি দোকান গুটিয়ে ফেলি।’’
এসময় তিনি চায়ের দোকানের সামনের একটি জায়গা দেখিয়ে দিয়ে তিনি বলেন, এ আইসে আমার এই টুলে বসবে। টুলে হেলান দিয়ে বসবে। ও বইসা রাতে ১২টা বাজে আমার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তারপর যাবে। কালকে কি যে একভুল করলাম, ওরে রেখে আমি চলে গেলাম। আমি ওরে বললাম ভাই তুই থাক, আমি যাই। কেন গেলাম!