
একটি প্রকল্পের আওতায় পাঁচ বছরে টেলিফোন বাবদ খরচ হয়েছে এক কোটি ২৫ লাখ টাকা। উদ্বোধনী ব্যয় ছিল ৪৩ লাখ টাকা। উদ্বোধনীতে কোন খাতে কত খরচ করা হয়েছে তার বিবরণ নেই। শেষ মুহূর্তে পরামর্শক খাতেও ব্যয় বাড়ানো হয়েছে ৬ কোটি ৫৯ লাখ টাকা। এসব বিষয়ে প্রশ্ন তুলে প্রকল্পটির মেয়াদ ও ব্যয় বাড়ানোর অনুমোদন দিয়েছে পরিকল্পনা কমিশন।
‘সরকারের ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পের আওতায় এসব ব্যয় হয়েছে। জুলাই ২০২১ সাল থেকে শুরু হওয়া প্রকল্পের কাজ শেষ হবে ডিসেম্বর ২০২৬ সালে। মোট ব্যয় ৫৯ কোটি ৯৬ লাখ টাকা। পরামর্শক খাতে ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ কোটি ৪৩ লাখ টাকা। এক হাজার ৫৮৪ জনমাসের জন্য এই বিশাল অর্থ ব্যয় করা হয়। এছাড়া ১০টি ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমে ব্যয় করা হয়েছে ১৮ কোটি ৩৮ লাখ ৮৬ হাজার টাকা। কীসের ভিত্তিতে এই ব্যয় করা হয়েছে তার কোনো তথ্য নেই প্রকল্পে। এটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল (বিসিসি)। প্রকল্পের মোট কর্মকর্তা ৪৭ জন, এর মধ্যে অতিরিক্ত দায়িত্বে ২৩ জন এবং পরামর্শক ২৪ জন।
স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্তমান ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমটির কারিগরি দিক হালনাগাদ, আটটি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরে আধুনিক প্রযুক্তির ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম স্থাপন ও ভিডিও কনফারেন্সিং পরিচালনায় প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল নিয়োগ প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য।
এটা টেলিফোন নয়, স্যাটেলাইট বিল। এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কথা বলা হবে। ইন্টারনেট, টেলিফোন ও ফ্যাক্স ব্যয়ও। গাজীপুরের বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইট যোগাযোগ করার জন্য এই ব্যয়। এটা কোনো টেলিফোন বিল নয়।- প্রকল্প পরিচালক বিশ্বজিৎ তরফদার
প্রকল্পের ব্যয় ও সময়
পরিকল্পনা কমিশন জানায়, শেষ সময়ে এসে ‘ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম শক্তিশালীকরণ’ প্রকল্পে পরামর্শক খাতে অতিরিক্ত ছয় কোটি ৫৯ লাখ টাকা বাড়ানো হয়। এ খাতে মূল বরাদ্দ ছিল ছয় কোটি ৩৭ লাখ টাকা। এছাড়া প্রকল্পটির প্রযুক্তি সরঞ্জামাদিসহ কয়েকটি খাতে ব্যয় বাড়ানো হয়। সব মিলিয়ে বাড়বে ১২ কোটি টাকার বেশি। প্রকল্পটির মূল ব্যয় ছিল প্রায় ৪৮ কোটি টাকা। এর আগেও একবার বাড়ানো হয়। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এসে কেন এত টাকার পরামর্শক ব্যয় বাড়বে সেটি নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে পরিকল্পনা কমিশন। তারপরও প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল থেকে জানা যায়, প্রকল্পের আওতায় আপ্যায়নে দুই লাখ ৪০ হাজার, পরিবহনে ৮০ লাখ, ভ্রমণে ২৪ লাখ, সম্মানিতে ৪৩ লাখ, তথ্য যোগাযোগ সরঞ্জমাদি খাতে চার কোটি, অফিস সরঞ্জমাদি খাতে ৬৬ লাখ, মোটরযান সংগ্রহে ৮ কোটি ৭১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। মনোহারি খাতে ১৫ লাখ ৩৪ হাজার ও আসবাবপত্র খাতে ব্যয় এক কোটি ২৫ লাখ টাকা।
প্রকল্পটি ২০২১ সালের জুলাই থেকে শুরু হয়ে ২০২৩ সালের জুনের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা ছিল। এরপর বাড়ানো হয় এক বছর। সবশেষ আরও ছয় মাস বাড়ানো হয়। ফলে আগামী ৩১ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রকল্পটি শেষ হওয়ার কথা।
প্রস্তাবিত ব্যয় বাড়ানো হলে মূল ব্যয়ের তুলনায় ২৪ দশমিক ৬৮ শতাংশ বাড়বে। এছাড়া মেয়াদ বাড়ছে দুই বছর। অর্থাৎ, ২০২৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে প্রকল্পের বাস্তবায়নও শেষ পর্যায়ে। ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত প্রকল্পটির আওতায় ব্যয় হয়েছে ৪৮ কোটি ৮৩ লাখ টাকা। এক্ষেত্রে শুরু থেকে এখন পর্যন্ত ক্রমপুঞ্জিত আর্থিক অগ্রগতি ৯৮ দশমিক ৬২ শতাংশ। এছাড়া বাস্তব অগ্রগতি ৯৮ শতাংশ।
নানান কারণ দেখিয়ে ফের প্রকল্প সংশোধন করা হয়। প্রকল্পের দ্বিতীয় সংশোধনী প্রস্তাবে বলা হয়, স্যাটেলাইট প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্তমান ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমটির কারিগরি দিক হালনাগাদ করা ও ভিডিও কনফারেন্সিং পরিচালনায় প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল নিয়োগের জন্য প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।
এরই ধারাবাহিকতায় সরকারের ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম শক্তিশালীকরণ বিনিয়োগ প্রকল্পটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে ৪৭ কোটি ৩৪ লাখ ১২ হাজার টাকা ব্যয় ধরা হয়। এটি ২০২১ সালের ২৮ নভেম্বর তৎকালীন পরিকল্পনামন্ত্রী অনুমোদন দেন। এরপর মোট ৪৯ কোটি ৫১ লাখ ১২ হাজার টাকা ব্যয়ে চলতি বছরের জুনে বাস্তবায়নের জন্য প্রকল্পের প্রথম সংশোধনী প্রস্তাব আইসিটি বিভাগ থেকে অনুমোদন দেওয়া হয়।
প্রকল্পের টাকা খরচ প্রাসঙ্গিক কি না বিবেচনা করা উচিত। প্রকল্পের মূল কাজ এগুলো কি না সেটাও দেখা উচিত। প্রকল্পের মূল কাজ করলাম না, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও টেলিফোন বিল দিলাম- এটা হয় না। এত টাকা খরচ করে কী অর্জন করলেন এটাও দেখা দরকার।- বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন
প্রকল্পের অগ্রগতি
স্যাটেলাইট-১ ব্যবহার করে বর্তমান ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমটির মাধ্যমে দুর্গম এলাকা ভিডিও কনফারেন্সিং সেবার আওতাভুক্ত করা এবং ভিডিও কনফারেন্সিং পরিচালনায় প্রয়োজনীয় দক্ষ জনবল প্রস্তুত করা প্রকল্পের অন্যতম কাজ। সে লক্ষ্যে নানান পদক্ষেপ নেওয়া হবে। রাষ্ট্রপতির কার্যালয়, প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, একনেক সভাকক্ষ, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সভাকক্ষ, আইসিটি বিভাগ সভাকক্ষ ও বিসিসির সভাকক্ষের ভিডিওর টেকনিক্যাল ডাইমেনশন এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন টেকনোলজির ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেম স্থাপন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ স্যাটেলাইটের ট্রান্সপন্ডার ব্যবহারের জন্য মোবাইল স্যাটেলাইট এন্টেনা সম্বলিত দুটি গাড়ি সংগ্রহ করা হয়েছে। বর্তমানে এই ভ্যানগাড়ির সাহায্যে ভিডিও কনফারেন্স পরিচালনা করা হচ্ছে। বর্তমান ভিডিও কনফারেন্সিং সিস্টেমের সঙ্গে সংগতি রেখে অ্যাপসভিত্তিক ভিডিও কনফারেন্সিং প্ল্যাটফর্ম চালু, ৭শ জন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ ও জাতীয় সংসদের জন্য ডিসপ্লে/টিভি/এলইডি ও সাউন্ড সিস্টেমস সংগ্রহ করে জাতীয় সংসদে স্থাপন করা হয়েছে।
এক কোটি ২৫ লাখ টাকা টেলিফোন বিল প্রসঙ্গে জানতে চাইলে প্রকল্পের পরিচালক বিশ্বজিৎ তরফদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘এটা টেলিফোন নয়, স্যাটেলাইট বিল। এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে কথা বলা হবে। ইন্টারনেট, টেলিফোন ও ফ্যাক্স ব্যয়ও। গাজীপুরের বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইট যোগাযোগ করার জন্য এই ব্যয়। এটা কোনো টেলিফোন বিল না।’
পরামর্শক ব্যয় প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘একসঙ্গে বেশি ব্যয় মনে হলেও বাস্তবে কম। যারা পরামর্শক হিসেবে কাজ করছে হিসাব করলে মাসে এক লাখ টাকাও হবে না।’
উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ৪৩ লাখ টাকা ব্যয় প্রসঙ্গে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘প্রকল্পের আওতায় আউটডোরে কিছু প্রোগ্রাম ছিল। সেজন্য এই ব্যয় করা হয়।’
টেলিফোন ও উদ্বোধন ব্যয়কে অপ্রাসঙ্গিক উল্লেখ করে বিশ্বব্যাংক ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন জাগো নিউজকে বলেন, ‘প্রকল্পের টাকা খরচ প্রাসঙ্গিক কি না বিবেচনা করা উচিত। প্রকল্পের মূলকাজ এগুলো কি না সেটাও দেখা উচিত। প্রকল্পের মূল কাজ করলাম না, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ও টেলিফোন বিল দিলাম- এটা হয় না। এত টাকা খরচ করে কী অর্জন করলেন এটাও দেখা দরকার। উদ্বোধন করলেন কিন্তু কোনো কাজ হলো না তাহলে এই উদ্বোধন দিয়ে কী হবে।’
তিনি বলেন, ‘প্রকল্পের কাজ কী হলো সেটাও দেখতে হবে। সঠিকভাবে প্রকল্পের কাজ না হলে শুধু উদ্বোধন হবে কিন্তু কাজের কাজ হবে না। শেষে দেখা যাবে বাজনা বাজিয়েছেন খাজনা আদায় হয়নি। ফলে আবার বাজনা বাজাতে হবে। সুতরাং, প্রকল্পের প্রতিটি অর্থ খরচের সময় অবশ্যই যাচাই-বাছাই করা উচিত।’