Image description

দীর্ঘদিন অপেক্ষার পরও লেবার কন্ট্রাক্ট (শ্রমচুক্তি) ইস্যু না হওয়ায় দক্ষিণ কোরিয়ায় কর্মসংস্থানের প্রত্যাশায় থাকা বাংলাদেশি রোস্টারদের মধ্যে হতাশা বিরাজ করছে। লেবার কন্ট্রাক্ট ইস্যু না হওয়ায় অনেকের নাম জব রোস্টার থেকে ডিলিট হয়ে যাচ্ছে।

ফলে কয়েক হাজার তরুণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বৈদেশিক কর্মসংস্থানসংক্রান্ত সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেডের (বোয়েসেল) ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে।

এ সমস্যা সমাধানে ভিসাপ্রত্যাশীরা মানববন্ধন, স্মারকলিপি প্রদানসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করার ফলে বোয়েসেল এবং রোস্টারকৃতদের অবস্থান মুখোমুখি। তাদের দাবি, বোয়েসেল সঠিকভাবে ফাইল পাঠায় না। ফলে নির্ধারিত কোটা খালি থাকার পরও বাংলাদেশি শ্রমিকরা যেতে পারছেন না।

জানা যায়, বাংলাদেশি কর্মী নেওয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর জন্য সেখানকার দূতাবাসে কোনো প্রতিনিধি নেই। তবে বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিমিটেড (বোয়েসেল) বলছে, এখানে তাদের কিছু করার সুযোগ নেই। ‘হিউম্যান রিসোর্সেস ডেভেলপমেন্ট সার্ভিস অব কোরিয়া (এইচআরডি কোরিয়া) জব রোস্টারের যে কোটা দেয়, সে অনুযায়ী তারা সার্কুলার প্রকাশ করে। সবকিছু যাচাই-বাছাই করে এইচআরডি কোরিয়া।

এ ছাড়া অনলাইনে প্রাথমিক নিবন্ধনের প্রার্থীর সংখ্যা ২০ হাজারের বেশি হলে এইচআরডি কোরিয়া কর্তৃক কম্পিউটারাইজড লটারির মাধ্যমে কোরিয়ান ভাষা পরীক্ষায় অংশগ্রহণের চূড়ান্ত প্রার্থী নিবন্ধন করা হয়। সবকিছু তাদের ওপর ‍নির্ভর করে। তবে তারা রোস্টারদের সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করছে। ইতোমধ্যে বোয়েসেলের পক্ষ থেকে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলেও তাদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কোরিয়ার কোম্পানি এবং নিয়োগকর্তার সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বাংলাদেশি কর্মী নেওয়ার প্রতি আগ্রহ বাড়ানোর জন্য সেখানকার বাংলাদেশ দূতাবাসে কোনো প্রতিনিধি নেই। সেক্ষেত্রে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে নিশ্চিত করা হয়েছে।

দক্ষিণ কোরিয়ায় শ্রমবাজার সম্প্রসারণের লক্ষ্যে চলতি মাসে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার পিএসের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দেশটি সফর করার কথা। জুনে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল অথবা সিনিয়র সচিব ড. নেয়ামত উল্ল্যা ভূঁইয়ার নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল দক্ষিণ কোরিয়া সফর করবে বলে জানা গেছে।

জানা গেছে, ইপিএস কর্মসূচির আওতায় জিটুজি পদ্ধতিতে এইচআরডি কোরিয়ার মাধ্যমে ইপিএস-৯ প্রকল্পে ২০০৮ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত ৩৪ হাজার শ্রমিক কোরিয়ায় গেছেন। এইচআরডি কোরিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে বোয়েসেল অভিবাসন কার্যক্রম সম্পন্ন করে থাকে।

তথ্যমতে, অতীতে মোটামুটি ভালোভাবে জব রোস্টাররা কোরিয়ায় গেলেও ২০২২ সাল থেকে মন্দা দেখা দিয়েছে। ২০২৩ সালে সর্বোচ্চ ১৮ হাজার ৭৫২ জনের কোটার বিপরীতে ১০ হাজার ২০০ জনের তালিকা দিয়েছিল এইচআরডি কোরিয়া, যেখানে একটি কোটার বিপরীতে চূড়ান্ত নিবন্ধিত প্রার্থীদের মধ্যে তিনটি করে ফাইল পাঠানো হয়। কিন্তু ওই সার্কুলারে প্রাথমিক নিবন্ধন করেন এক লাখ ১২ হাজারের মতো লোক।

ফলে নিয়মানুয়ায়ী ভাষা পরীক্ষা দেওয়ার জন্য লটারির মাধ্যমে চূড়ান্ত নিবন্ধিত করা হয় ৫৫ হাজার ৪০৩ জনকে। পরে ভাষা শেখার জন্য নির্দিষ্ট একটি সময় দেওয়ার পর তাদের পরীক্ষা নেওয়া হয়। পরীক্ষা, মেডিকেল, স্কিল টেস্টসহ প্রয়োজনীয় সব যোগ্যতা প্রমাণ করে এ তালিকা থেকে উত্তীর্ণ হন ১৬ হাজার ৬৩৮ জন।

চাহিদাকৃত কোটা থেকে চার হাজার ৮০৪ জন কোরিয়ায় গেলেও বাকি কোটা খালি রয়ে যায়। ২০২৪ সালেও একই অবস্থা। এ অবস্থার জন্য বোয়েসেল দায়ী করছে বাংলাদেশি শ্রমিকদের কর্মকাণ্ড ও অদক্ষতাকে। তবে বোয়েসেল এবং কোরিয়ায় বাংলাদেশি দূতাবাসের নিষ্ক্রিয়তাকে দায়ী করে পাল্টা অভিযোগ করছেন জব রোস্টাররা।

সূত্রের তথ্যনুযায়ী, দেশে বর্তমানে ১৪ হাজারের মতো জব রোস্টার রয়েছেন। এ ছাড়াও রোস্টারের তালিকায় প্রবেশ করার জন্য অপেক্ষমাণ আরো চার-পাঁচ হাজার। আগের রোস্টারদের বেশিরভাগের মেয়াদ চলতি মাসে শেষ হবে। অনেকে তালিকা থেকে চূড়ান্তভাবে বাদ পড়ে যাবেন।

এদিকে জব রোস্টাররা বলছেন, পরীক্ষা দেওয়ার জন্য চূড়ান্ত নিবন্ধিত হলে আমরা ভাষা শেখার জন্য অনেক টাকা ও সময় ব্যয় করি। কিন্তু বছরের পর বছর অতিবাহিত হলেও এর কোনো ফল পাই না। তাদের দাবি, এখন নতুন করে পরীক্ষা নেওয়া হলে বা জব রোস্টার তালিকা বৃদ্ধি করা হলে সংকট আরো বাড়বে।

কামরুল ইসলাম নামে এক ভুক্তভোগী আমার দেশকে বলেন, বোয়েসেল আমাদের ফাইল না পাঠিয়ে বলছে পাঠিয়েছে। ফাইল পাঠালে শ্রমচুক্তি কেন ইস্যু হবে না? সব ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা প্রমাণ করেই তো আমাদের রোস্টার করা হয়েছে।

সাগর নামে আরেক ভুক্তভোগী বলেন, জব রোস্টার নিবন্ধনের জন্য বোয়েসেল আলাদা সার্কুলার প্রকাশ করে। প্রাথমিক নিবন্ধন ফি ৫০০ টাকা। তারপর লটারিতে টিকলে ভাষা পরীক্ষা দিতে চূড়ান্ত নিবন্ধনের ফি প্রায় তিন হাজার টাকা। স্কিল টেস্টের জন্য নেওয়া হয় চার থেকে পাঁচ হাজার টাকা।

এইচআরডি কোরিয়া নির্ধারিত সংখ্যার চেয়ে বোয়েসেল চার-পাঁচগুণ বেশি আবেদন কেন গ্রহণ করেÑ এ প্রশ্ন ভুক্তভুগেীদের। তারা বলেন, নির্ধারিত আবেদন জমা হওয়ার পর আবেদনের সাইট বন্ধ করে দেওয়া হয় না কেন? জব রোস্টার প্রার্থীদের আবেগকে কাবু করে তারা টাকা আয় করার জন্য এমনটা করে বলে অভিযোগ করেন তারা।

অনেক জব রোস্টার থাকার পরও কোটা অপূর্ণ থাকছে কেন- এমন প্রশ্নে বোয়েসেল জানায়, অনলাইন সাইটের মাধ্যমে ফাইল করে সব জব রোস্টারের তালিকা এইচআরডি কোরিয়াকে পাঠানো হয়। প্রতি কোটার বিপরীতে তিনজন প্রার্থীর বায়োডাটা থাকে, যেখানে নিয়োগকর্তা তিনজন থেকে একজনকে বাছাই করে। এখানে বোয়েসেলের কিছু করার সুযোগ নাই।

বোয়েসেলের সহকারী মহাব্যবস্থাপক (আইটি) নুরুল ইসলাম কিরণ বলেন, কারো ফাইল আটকে রাখার সুযোগ নেই। সব ধাপে পরীক্ষা দিয়ে যারা উত্তীর্ণ হয়েছেন, তাদের ফাইল আমরা পাঠিয়ে দেই।

বোয়েসেলের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, জব রোস্টারদের কথা চিন্তা করে ২০২৪ সালের দুটি পরীক্ষা স্থগিত করেছে প্রতিষ্ঠানটি। চলতি বছর একটি পরীক্ষা নিয়েছে তারা। তবে নতুন করে জব রোস্টারের তালিকাভুক্ত করেনি। কিন্তু এতকিছু করার পরও কতিপয় জব রোস্টার প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে।

সূত্র আরো জানায়, জব রোস্টারদের কথা চিন্তা করে ই-৯-এর পাশাপাশি ই-৮ প্রকল্পের (সিজনাল কর্মী) প্রক্রিয়া শুরু করার জন্য কোরিয়া কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হচ্ছে। পাশাপাশি ই-৭ (দক্ষ কর্মী) প্রকল্প নিয়েও তারা জোরালোভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছে।

বোয়েসেলের মহাব্যবস্থাপক (যুগ্ম সচিব) এবিএম আবদুল হালিম বলেন, জব রোস্টাররা ভালো করে জানেন জব রোস্টার মানে চাকরির নিশ্চয়তা নয়। তবুও তারা অহেতুক ‍বিতর্কিত করার চেষ্টা করছেন। আমরা তাদের প্রতিটা ফাইল পাঠিয়ে দেই। কোটা খালি থাকার পরও নিয়োগকর্তারা পছন্দ না করার পেছনে অনেক কারণ থাকে। এর মধ্যে রয়েছে অদক্ষতা, ভাষাগত দুর্বলতা, আচার-আচরণ ভালো না হওয়া এবং কর্মক্ষেত্র থেকে চলে যাওয়া।

বোয়েসেলের নির্বাহী পরিচালক (যুগ্ম সচিব) মো. শওকত আলী বলেন, জব রোস্টার নিয়ে যারা না বুঝে বিতর্কিত করার চেষ্টা করছে, কোরিয়ার শ্রমবাজারে এর দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব পড়বে। একটি পক্ষের স্বার্থ হাসিলের জন্য পুরো সিস্টেমকে বিতর্কিত করা হচ্ছে।

তিনি বলেন, দুই সরকারের মধ্যে সম্পাদিত সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী ইপিএস ব্যবস্থাপনা অনুসরণ করে একজন প্রার্থী রোস্টারভুক্ত থেকে কোরিয়ান নিয়োগকর্তা কর্তৃক শ্রমচুক্তি ইস্যুর মাধ্যম দক্ষিণ কোরিয়ায় যেতে পারেন। ডিলিটকৃতদের অটো রোস্টারভুক্তি এবং রোস্টারভুক্তদের ক্রমানুযায়ী চাকরির নিশ্চয়তা প্রদান করার কোনো সুযোগ নেই।

দক্ষিণ কোরিয়ায় রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক মন্দা যাচ্ছে বিধায় মানবিক কারণে ডিলিটকৃতদের অটো রোস্টারের সুযোগ প্রদানের বিষয়ে মন্ত্রণালয় থেকে এইচআরডি কোরিয়াকে প্রস্তাব দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। জব রোস্টারদের স্বপ্ন যেন পূরণ হয়, সে লক্ষ্যে আমরা কাজ করে যাচ্ছি।